এবার সুন্দরবনে রাজা-বাদশা নতুন দস্যু বাহিনীর দাপট!

সুন্দরবনে শীর্ষ বনদস্যুরা শত শত আগ্নেয়াস্ত্র হাজার হাজার গোলাবারুদসহ র‌্যাবের কাছে আত্মসমার্পণ করলেও নতুন করে রাজা-বাদশা বাহিনী নামের একটি নতুন দস্যু বাহিনীর আর্বিভাব ঘটেছে। জেলে বাওয়ালীদের জন্য আতংক হয়ে দেখা দিয়েছে।গডফাদার সোর্স অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে । এ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা পাঁচ থেকে ছয় জন। তাদের মধ্যে পাথরঘাটা উপজেলার পদ্মা সুলিজ এলাকার একজন ও শরনখোলা উপজেলার বন-সংলগ্ন বিভিন্ন গ্রামের পাঁচ-জন সদস্য রয়েছে। চলতি বছরের মার্চ মাসের প্রথম দিকে পুর্ব সুন্দরবনে ওই বাহিনীর আত্মপ্রকাশ ঘটে।

সুন্দরবনের শরনখোলা রেঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থানরত জেলে ও মৌয়ালীদের জিম্মি করে হাজার হাজার টাকা মুক্তিপন আদায়ের পাশাপাশি বনে অবস্থানরত পেশাজীবীদের উপর নানা প্রকার নির্যাতন শুরু করেন ওই দস্যুরা।

মুক্তিপনের টাকা পরিশোধ করে দস্যুদের জিম্মিদশা থেকে সম্প্রতি নিজ পরিবারের কাছে ফিরে আসা উপজেলার কয়েকজন জেলে জানায়, ওই দস্যুরা নামবিহীন একটি ইঞ্জিন চালিত ট্রলার যোগে শরনখোলা রেঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় জেলে, বাওয়ালী ও মৌয়ালদের উপর হানা দেয়া শুরু করেছেন।

বাহীনিটির নেতৃত্বে আছেন শরনখোলা উপজেলার সোনাতলা (মডেল বাজার) এলাকার বাসিন্দা মৃত চাঁন মিয়া বয়াতির ছেলে মোঃ কবির হোসেন বয়াতি (৩৫), সেকেন্ডইন কমান্ড হিসেবে আছেন পদ্মাশুলিজ এলাকার বাসিন্দা আঃ হালিম খানের ছেলে মোঃ বেল্লাল হোসেন খান (২৫), সদস্য হিসেবে রয়েছেন, সোনাতলা গ্রামের আইয়ুব আলী হাওলাদারের ছেলে মোঃ আঃ রহমান হাওলাদার (৪২), একই গ্রামের বাসিন্দা মোঃ জয়নাল সর্দারের ছেলে মোঃ আসাদুল সর্দার (৩৮) ও মোঃ দুলাল সর্দার (৩৬) এবং পার্শ্ববর্তী শরনখোলা গ্রামের আনোয়ার হোসেন ফরাজীর ছেলে মোঃ নবী হোসেন ফরাজী (৩৪) সহ ছয়জন। এদের কাছে ২টি পাইপ গান, একটি সাটার গান, দেশীয় তৈরী ধারালো ২টি অস্ত্র সহ বেশ কিছু লাঠি রয়েছে।অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহকারী শরনখোলা উপজেলার রাজাপুর গ্রামের বাসিন্দা মৃত মইনুদ্দিন ওরফে মনু আকনের ছেলে শহিদুল ইসলাম টুকু।খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা থেকে ভারত চোরাই পথে অস্ত্র সরবরাহ করে সাগরে বনদস্যুর কাছে দিয়ে মসোহারা ঊঠায়।টুকু অস্ত্র সহ খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গায় সোনাবাহিনীর হাতে ধরা পরে  তার বিরুদ্ধে অস্ত্র মাটিরাঙ্গা থানায় অস্ত্র আইনে মামলা দাযের করা হয়।

সুন্দরবন সংলগ্ন উপজেলার উত্তর রাজাপুর গ্রামের বাসিন্দা ও জেলে মোঃ ফজলুল হক হাওলাদার (৬৫) বলেন, চলতি মাসের ১২, এপ্রিল ওই দস্যুরা তাকে সহ তার বড় ভাই আঃ জব্বার হাওলাদার (৭০) কে শরনখোলা রেঞ্জের কটকা এলাকার ডোরা খাল থেকে অস্ত্রের মুখে ধরে নিয়ে যায় এবং তাদের নৌকায় থাকা নগদ ১০, হাজার টাকা, নিত্য প্রয়োজনীয় মালামাল সহ মোবাইল ফোন লুটে নেয়। এসময় দস্যুরা তাদেরকে রাজা-বাদশা বাহনী পরিচয় দিয়ে ৫০হাজার টাকা মুক্তিপন দাবি করে জব্বারকে আটক রেখে ফজলুকে ছেড়ে দেয়। একই গ্রামের জেলে ইদ্রিস হাওলাদার (৬০) বলেন, গত ১৪এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে তিনি সুন্দরবনের টিয়ার চরের (গাব-বাড়িয়া) পুকুরে খাবার পানি আনতে গেলে সেখানে ৫ জন লোক বসা অবস্থায় দেখতে পান। এক পর্যায়ে তিনি পানি নিয়ে নৌকার দিকে রওয়ানা হলে ওই লোক গুলো তার পিছু নেয়। পরে তাকে সহ তার সংঙ্গী জেলে কুদ্দুসকে (২৮) অস্ত্রের মুখে জিম্মি করেন এবং লাখ টাকা মুক্তিপনের দাবিতে কুদ্দুসকে আটক রেখে তাকে ছেড়ে দেয় দস্যুরা।

এছাড়া একই এলাকার মৎস্য আড়ৎদার ছগির আকন বলেন, গত ২৪ মার্চ ওই দস্যুরা তার অধীনস্থ ৫টি নৌকা থেকে ৫জন জেলেকে জিম্মি করেন। এ সময় তাদের নৌকায় থাকা প্রায় ৪৫ হাজার নগদ টাকা, ৫টি মোবাইল ফোন সহ কয়েক হাজার টাকার নিত্য প্রয়োজনীয় মালামাল লুটে নেয় দস্যুরা। তার পরেও বিকাশের মাধ্যমে আরো ৩০হাজার টাকা পরিশোধ করে আমার জেলেদের ছাড়িয়ে আনতে হয়েছে। তবে, পরবর্তীতে সোনাতলা ওর্য়াডের ইউপি সদস্য মোঃ শরিফুল ইসলাম ডালিম ও স্থানীয় বাসিন্দা মোঃ রস্তুম বয়াতির সমন্বয়ে ওই দস্যুদের কাছ থেকে কিছু টাকা ফেরৎ ফেরত পেয়েছি।

এব্যাপারে, জানতে চাইলে উত্তর রাজাপুর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোঃ জাকির হোসেন বলেন, অনেক দিন ধরে সুন্দরবন দস্যুমুক্ত ছিল। তাই বনে যেতে জেলেদের মধ্যে কোন ভয়-ভিতী ছিলনা কিন্তু হঠাৎ করে নুতন বাহিনীর আর্বিভাব হওয়ায় জেলে ,বাওয়ালী ও মৌয়ালীদের মাঝে নুতন করে আতংঙ্ক দেখা দিয়েছে। শুরুতে এই দস্যুদের দমন করতে না পারলে সুন্দরবন আবারও অশান্ত হয়ে উঠতে পারে।

ধান সাগর নৌ-পুলিশ ফাড়ির ইনচার্জ (এ.এস.আই) মোঃ আজিম উদ্দিন জানান, এ সংক্রান্ত খবর তার জানা নেই। তবে খোঁজ-খবর নিয়ে দেখবেন। শরনখোলা রেঞ্জের সহকারি বন সংরক্ষক মোঃ জয়নাল আবেদীন জানান, ওই বাহিনীর সাথে ইতোমধ্যে দুবলা ও শেলা ক্যাম্পের বনরক্ষীদের সাথে গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে। তবে, ওই সময় দস্যুরা পালিয়ে গেলেও তাদের জিম্মিদশা থেকে উত্তর রাজাপুর এলাকার বাসিন্দা কুদ্দুস (২৮), গিয়াস উদ্দিন (৩৬) ও মহসিন (২৬) নামের তিন জেলে এবং দস্যুদের একটি ট্রলার উদ্বার করেছে বনরক্ষীরা।

এছাড়া ওই দস্যুদের আটকের জন্য বনের সকল ফাড়ি ও ক্যাম্পের অভিযান জোরদার করা হয়েছে। তবে, কবির বয়াতি মুঠোফোনে বলেন, আমি এঘটনার সাথে আদৌ জড়িত নাই। একসময় জঙ্গলে খারাপ কাজের সাথে জড়িত ছিলাম কিন্তু বর্তমানে সম্পুর্ন ভালো হয়ে গেছি। অভিযুক্ত অন্য-অন্যদের

পরিবারের সদস্যরা দাবি করেন, দস্যুতার তালিকায় যাদের নাম বলা হয়েছে তারা সকলেই নীরিহ জেলে। তাদের বিরুদ্বে এই অভিযোগ গভীর ষড়যন্ত্র। সুন্দবনের বিভিন্ন এলাকায় মাছ শিকার নিয়ে জেলে মহাজনদের মধ্যে রেশারেশি থাকায় ওই জেলেদের নামে মিথ্যা অপবাদ ছড়ানো হচ্ছে। দেশের মৎস্য সম্পদের খনি বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশী সীমানায় নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের তৎপরতা ও টহল বৃদ্ধি ছাড়া এ দস্যুতা বন্ধ করা সম্ভব নয় বলে সংশ্লি­ষ্টরা জানান।টেকনাফ থেকে সুন্দরবন সংলগ্ন দক্ষিণ তালপট্টী পর্যন্ত বঙ্গোপসাগর এবং শাখা নদীগুলোতে ফিশিং ট্রলারগুলো সারা বছরই মাছ ধরায় নিয়োজিত থাকে। প্রতি বছর এ ফিশিং ট্রলারগুলো প্রায় ১৫ লক্ষ টনেরও বেশী মাছ সাগর থেকে সংগ্রহ করে। গত ৫ বছরে সাগর দস্যুদের নিহত হয়েছে শতাধিক জেলে ও মাঝি মাল­া। অপহৃত হয়েছে কয়েক হাজার জেলে। সাগরদস্যুরা মুক্তিপণ বাবদ আদায় করেছে কোটি কোটি টাকা।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)