অবিশ্বাস্য! তিনদিন পর সাগরের নিচে থেকে বেঁচে ফিরলেন তিনি

রাতের বেলা টয়লেটে যাওয়া ভীষণ বিরক্তিকর লাগে, তাই না? কার ই বা ইচ্ছে হয় এতো আরামের বিছানা ছেড়ে উঠতে? শীতকালে তো কাঁথার ভেতর থেকেই বের হতে ইচ্ছে হয় না। কিন্তু, রাতের বেলা বিছানা ছেড়ে টয়লেটে যাওয়াই ২৯ বছর বয়সী নাইজেরিয়ান ‘হ্যারিসন ওকিনি’র জীবন বাঁচিয়েছিল।

হ্যারিসন পৃথিবীর একমাত্র ব্যক্তি, যিনি সমুদ্রের একেবারে নিচে ডুবে যাওয়া জাহাজে প্রায় তিন দিন আটকে ছিলেন। এমনকি কোনো অঘটন ছাড়াই জীবিত ফিরে এসেছেন। চলুন আজ আপনাদের হ্যারিসন ওকিনির বেঁচে যাওয়ার গল্পটা জানাই। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে হ্যারিসন ওকিনি তিন দিন পর্যন্ত সমুদ্রের তলদেশে জীবিত অবস্থায় ছিলেন।

ডুবন্ত জাহাজ

ডুবন্ত জাহাজ

আটলান্টিক মহাসাগরের দক্ষিণ পূর্ব দিকে নাইজেরিয়ার পার্শবর্তী একটি জায়গা গালফ অব গিনি। যেটি তেল আহরণের জন্য বেশ পরিচিত। অয়েল রিগের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত সেখান থেকে প্রচুর পরিমাণে তেল আহরণ করা হয়। ২০১৩ সালের ২৬ মে নাইজেরিয়া থেকে প্রায় ২০ মাইল দূরে একটি জাহাজে তেল উত্তোলনের কাজ চলছিল। সেভ্রোন অয়েল ট্যাংকার নামক জাহাজটিকে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ থেকে রক্ষা করতে রয়েছে তিনটি ট্যাগ বোর্ট।

কিন্তু জ্যাসকোন ৪ নামে একটি ট্যাগ বোর্ট হঠাৎ ভোর ৫ টার দিকে সমুদ্রের তীব্র স্রোতে ডুবে যায়। দুর্ভাগ্যক্রমে বোর্টের সবাই তখন ঘুমাচ্ছিল। কিন্তু সে সময়টায় বোর্টের বাবুর্চি হ্যারিসন ওকিনি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে উঠেছিল। আর এটাই ছিল তার বেঁচে যাওয়ার ইঙ্গিত। বোর্টটি ডুবে যাওয়ার পর হ্যারিসন টয়লেটে আটকে যান। পানির প্রবল স্রোতে টয়লেটের দরজাও আটকে যায়। অনেক চেষ্টার পর যখন হ্যারিসন দরজাটি খুলতে পারলেন, তখন পানির স্রোত তাকে ভাসিয়ে অন্য একটি টয়লেটে নিয়ে যায়।

সমুদ্রে ডুবে যাওয়া জাহাজ

সমুদ্রে ডুবে যাওয়া জাহাজ

এদিকে জ্যাসকোন ৪ তখন উল্টে গিয়ে পানির নিচে তলিয়ে গেছে। হ্যারিসন বেসিনের পাইপ ধরে কোনোমতে তার নাক পানির উপরে ভাসিয়ে রাখেন। বোর্টটি ডুবে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অন্যান্য জাহাজ থেকে তাদের উদ্ধার করার চেষ্টা চালানো হয়। তবে ডুবুরিরা বোর্টটির অবস্থান জানতে পারলেও সমুদ্রের ১০০ ফিট নিচে পৌঁছানো তাদের সম্ভব ছিল না। বোর্টের কেউ জীবিত নেই ভেবে তারা উদ্ধার কাজ সমাপ্ত ঘোষণা করে।

উল্টে যাওয়া বোর্টের ভেতর আটকে থাকা বাতাসে তখনো হ্যারিসন ভেসে ছিলেন। একদিন টয়লেটে থাকার পর হ্যারিসন অন্ধকারের মধ্যেই সাঁতরে আগাতে থাকেন। এক সময় তিনি ইঞ্জিনিয়ারের কক্ষে গিয়ে পৌঁছান। সৌভাগ্যক্রমে এখানে প্রায় ৪ ফুট উচ্চতায় বাতাস জমে ছিল। ঠিকভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারার পরই হ্যারিসন অন্য ব্যাপারগুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। তার পরনে ছিল শুধু একটি হাফপ্যান্ট। সমুদ্রের ঠাণ্ডা পানিতে থাকতে থাকতে হ্যারিসনের শরীরের তাপমাত্রাও কমতে শুরু করে। হ্যারিসন অন্ধকারেই হাতরে কিছু কাঠের টুকরা আর ম্যাট্রেক্স খুঁজে পান। তা দিয়েই একটি ভেলার মতো বানিয়ে তার উপর বসে থাকতে চেষ্টা করেন।

ডুবুরি

ডুবুরি

চারদিক থেকে নানা রকম শব্দ হ্যারিসনের কানে আসছিল। সেইসঙ্গে পচে যাওয়া লাশের গন্ধ। হ্যারিসন তার পরিবারের কথা মনে করতে থাকেন। আর সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে থাকেন। এদিকে দ্য লিউ এ টোকেন নামে একটি উদ্ধারকারী জাহাজ ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায়। হ্যারিসনের কোম্পানি ওয়েস্ট আফ্রিকান ভেঞ্চার মৃত নাবিকদের লাশ খুঁজে আনার জন্য ডিসিয়েন গ্লোবাল নামে উদ্ধারকারী সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করে। ৬ জন ডুবুরি অভিযানের জন্য প্রস্তুত হন। একজন সুপারভাইজার ডুবুরিদের মাথায় লাগানো ক্যামেরার সাহায্যে সব তদারকি করছিলেন। বোর্টের লোহার দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকতে ডুবুরিদের প্রায় ১ ঘন্টা সময় লেগে যায়।

ডুবুরিরা বোর্টের ভেতরে ঢুকেই নাবিকদের লাশ খুঁজতে থাকে। প্রথমে তারা চারটি লাশ খুঁজে পায়। একজন ডুবুরি পানির মধ্যে থেকে তার হাত কেউ ধরেছে এমন অনুভব করেন। এরপরই হ্যারিসনকে দেখতে পান ডুবুরি। এদিকে হ্যারিসন দরজা ভাঙ্গার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন। কিন্তু কেউ তার দিকে না আসায় তিনি নিজেই সাঁতরে এগিয়ে যেতে থাকেন। প্রথমে ডুবুরি আঁতকে উঠলেও হ্যারিসনকে জীবিত পেয়ে খুশিই হন।

ডুবুরিদের সঙ্গে হ্যারিসন ওকিনি

ডুবুরিদের সঙ্গে হ্যারিসন ওকিনি

তবে সমুদ্রের ১০০ ফুট নিচে ডুবুরিদের ২০ মিনিটের বেশি থাকা ঝুঁকিপূর্ণ। অথচ সেখানে গত তিন দিন ধরে কোনো রকম কোনো সাহায্য ছাড়াই হ্যারিসন বেঁচে আছেন। যা সবাইকেই বেশ অবাক করে দিয়েছিল। সমুদ্রের নিচে থাকার ফলে হ্যারিসনের শরীরে যে পরিবর্তন এসেছে তাতে সঙ্গে সঙ্গেই উপরে আনা সম্ভব ছিল না। ততক্ষণাৎ তার মৃত্যুও হতে পারে। তাই হ্যারিসনকে গরম পানি খাওয়ানো হয়। এরপর অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে একটি যন্ত্রের সাহায্য পানির উপরে উঠিয়ে আনা হয়।

উদ্ধারকারী জাহাজে থাকা ডাক্তাররা তাকে একটি কম্প্রেসর চেম্বারে রেখে চিকিৎসা দিতে শুরু করেন। প্রায় ৬৩ ঘণ্টা পর হ্যারিসন সমুদ্রের নিচ থেকে উদ্ধার পান। জ্যাসকোন ৪ এ থাকা ১২ জন নাবিকের মধ্যে ১০ জনের মৃতদেহ এবং হ্যারিসনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। আর অন্য একজন নাবিকের লাশ খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি।

হ্যারিসন ওকিনি

হ্যারিসন ওকিনি

প্রায় তিনদিন পর সুস্থ হয়ে হ্যারিসন তার পরিবারের কাছে ফিরে যান। এরপর হ্যারিসন তার জীবনকে সাজিয়েছেন অন্যভাবে। বর্তমানে তিনি একটি রেস্টুরেন্টে রাঁধুনির চাকরি করছেন। হ্যারিসন আর কখনোই সমুদ্রে ফিরে যাননি। বোর্টে আটকে থাকা অবস্থায় তিনি শপথ করেছিলেন, বেঁচে থাকলে তিনি আর কখনো সমুদ্রে ফিরে আসবেন না।

জীবন কতো বিচিত্র। “রাখে আল্লাহ মারে কে”? প্রচলিত কথাটিই যেন প্রযোজ্য এখানে। হ্যারিসনের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ায় তিনি তিন দিন সমুদ্রের ১০০ ফুট গভীরে থেকেও বেঁচে গিয়েছেন। জাহাজের ভেতরে আটকে থাকা বাতাসের কারণেই হ্যারিসন বেঁচে ছিলেন এতো সময় পর্যন্ত। সবার ভাগ্যে এমনটা নাও হতে পারে।

সূ্এ-ডেইলি বাংলাদেশ

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)