ইঞ্জিন বন্ধ থাকলেও উল্টো পথে গাড়ি চলে জিন পল্লীতে

আচ্ছা ভাবুনতো রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছেন, অথচ ইঞ্জিন বন্ধ করে। তারপরও গাড়ি চলছে। আর চলাটা স্বাভাবিক নয়, রীতিমতো ৬০ থেকে শুরু করে ১০০ পর্যন্ত গতিবেগে চলছে গাড়ি। 

তাও আবার নিচ থেকে উপরের দিকে উঠছে! তাজ্জব বনে যাবেন নিশ্চয়ই! এখানে আপনার কাজ হবে শুধু স্টিয়ারিং ধরে গাড়ির দিকটি ঠিক রাখা। বিষয়টি অলৌকিক মনে হলেও এমনি ঘটনা ঘটে মদিনার রহস্যময় জিনের পাহাড়ের রাস্তায়।

এই জিনের পাহাড়কে ঘিরে মানুষের মাঝে রয়েছে হাজারো কৌতূহল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য পর্যটক পাহাড়টি দেখতে ভীড় জমায় স্থানটিতে। এখানে বিভিন্ন দেশ থেকে ওমরা বা হজ পালন শেষে মদিনায় আসা হাজীদের অনেকেই রসহ্যময় পাহাড়টি দেখার জন্য ভীড় জমান। পৃথিবীতে এমন আরো পাঁচটি স্থান রয়েছে। তবে মদীনার এই জিন পল্লীই বেশি আকর্ষণের জায়গা সবার কাছে।

এই সেই জিন পল্লীর রাস্তা

এই সেই জিন পল্লীর রাস্তা

মদিনার রহস্যময় পাহাড়। মানুষের কাছে যেটা ওয়াদিয়ে জিনের পাহাড় বা জিন পল্লী নামে খ্যাত। আরবরা অবশ্য এই পাহাড়কে জিনের পাহাড় বলেন না। তাদের কাছে এই পাহাড়ের নাম ওয়াদি আল আবইয়াজ বা ওয়াদি আল বায়জা। ‘ওয়াদি’ বলা হয় পানি জমা হওয়ার ছোট ছোট খালকে। মদিনার এই পাহাড়ের কাছ দিয়ে একটি ছোট খাল বয়ে গেছে। যদিও শীতের সময় এটি শুকনো, পানিশূন্য। তবে বৃষ্টির সময় জমা হওয়া পানির স্বাদ বেশ মিষ্টি হয়ে থাকে। ২০০৯ থেকে ২০১০ সালের দিকে সৌদি সরকার ওয়াদি আল বায়জায় একটি রাস্তা বানানোর পরিকল্পনা করে। তবে ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত কাজ করার পর সমস্যা শুরু হয়।

হঠাৎ দেখা যায় রাস্তা নির্মাণের যন্ত্রপাতি আস্তে আস্তে মদিনা শহরের দিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যাচ্ছে। যেনো অদৃশ্য কোনো শক্তি যন্ত্রপাতিগুলো মদিনার দিকে ঠেলছে। এমনকি পিচ ঢালাইয়ের ভারী রোলারগুলোও বন্ধ থাকা অবস্থায় আস্তে আস্তে ঢালু বেয়ে ওপরের দিকে উঠতে থাকে। এসব দেখে কর্মরত শ্রমিকরা ভয় পায়, তারা কাজ করতে অস্বীকার করে। ফলে রাস্তার নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। যেখানে রাস্তার কাজ বন্ধ করা হয় সেখানে চারদিকে বিশাল খাড়া কালো পাহাড়। ওই পাহাড়ের পাদদেশে গোল চত্বরের মতো করে আবার সেই রাস্তা দিয়েই মদিনায় আসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাস্তাটি ২০০ কিলোমিটার করার কথা থাকলেও মাত্র ৪০ কিলোমিটার করেই নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়।

ড্রাইভার ছাড়াই চলছে গাড়ি

ড্রাইভার ছাড়াই চলছে গাড়ি

কথিত ওয়াদিত আল জিনের অবস্থান মদিনা শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। মদিনা থেকে বের হয়ে কিছু খেজুর বাগান পার হয়ে যেতে হয় এলাকাটিতে। খেজুর বাগানের পর পাহাড়ি পথ। এই এলাকার পাহাড়গুলোও ব্যতিক্রম। ন্যাড়া পাহাড়, পাহাড়ের ওপর ধারালো সূচের ন্যায় ফলা ফলা মাটি দাঁড়িয়ে আছে। দেখলে মনে হবে, এখনই বুঝি ভেঙে পড়বে; তবে না। এমন পাহাড় মক্কা, মদিনা কিংবা তায়েফের অন্য কোনো এলাকায় দেখা যায় না। এমন পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে পিচঢালা সড়ক। আর সেই সড়কেই লুকিয়ে আছে এমন অপার বিস্ময়।

যেখানে ইঞ্জিন বন্ধ থাকলেও গাড়ি চলতে শুরু করে ঢালুর বিপরীতে। আর গাড়ির গতিও কিন্তু কম নয়, ধীরে ধীরে রীতিমতো তা ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার বেগে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গাড়ি চলতে থাকে। শুধু গাড়ি চলা নয়, পানির বোতল কিংবা পানি ফেললে, জুতা রেখে দিলে তাও ঢালুর বিপরীত দিকে গড়াতে থাকে। এটা কোনো গল্প নয়, বাস্তবের ঘটনা।

রাস্তায় গড়াচ্ছে পানির বোতলও

রাস্তায় গড়াচ্ছে পানির বোতলও

অবশ্য ওয়াদি আল জিন এলাকায় প্রবেশের সময় গাড়িকে কিছুটা বেগ পেতে হয়। পরে নামার সময় শুধু স্টিয়ারিং ধরে থাকা। ওয়াদি আল জিন এলাকার রাস্তা খুব উঁচু নয়, তার পরও শো শো আওয়াজে কান আপনি থেকে বন্ধ হয়ে যায়, পাহাড়ের ঢালে নেমে দাঁড়ালে মনে হয়, কেউ যেন পেছন থেকে ঠেলছে।  এমন দুলুনি ভাব হয়। এখানে ভাবতে পারে মধ্যাকর্ষণের জন্য এমনটা হচ্ছে। তাহলে ভালোভাবে খেয়াল করুন এখানে উপর থেকে নিচের দিকে যায় না। নিচের দিক থেকে উপরের দিকে উঠতে থাকে।

এমনিতেই সৃষ্টির অপার রহস্যময় বিষয় পাহাড়-পর্বত। কেউ কেউ ধারণা করেন, জায়গাটিতে প্রচুর চুম্বকজাতীয় পদার্থ আছে তাই এমনটি হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো- পানি, পানির বোতল বা জুতায় চুম্বক কীভাবে আকর্ষণ করে? অনেকেই আবার বলেন, এটা জিনদের কারসাজি! স্থানীয়দের কাছে এসব বিষয়ের কোনো সমাধান নেই। ফলে প্রচুর লোককথা এটা নিয়ে প্রচলিত। অনেকে মনে করেন ‘এখানে কোনো জিন নেই, এটা ‘আরদে মুকাদ্দাস’ বা পবিত্র মাটি। এই পাহাড়ের ওপর দিয়ে প্লেনও যেতে পারে না। এই পাহাড়ে উঠে নবী করিম (সা.) জিনদের ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন। তখন নাকি কিছু জিন দুষ্টুমি করে পালিয়ে যেতে যায়। পরে বয়ষ্করা তাদের পালানো রোধ করতে বিশেষ ব্যবস্থা নেয় তাদের পথ উল্টে দিয়ে। তাই এখানে সবকিছু উল্টো ভাবে চলে।’

এই অবাক কাণ্ডগুলো দেখতে পর্যটকের ভীড় বাড়তেই থাকে

এই অবাক কাণ্ডগুলো দেখতে পর্যটকের ভীড় বাড়তেই থাকে

যদিও ইসলামের ইতিহাসে এমন কোনো ঘটনার প্রমাণ মেলে না। হাদিসে উল্লেখ পাওয়া যায়, নবী করিম (সা.) জিনদের ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন মক্কায়। তবে মদিনায় জিনদের সঙ্গে এমন কোনো ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যায়নি হাদিসে। বর্তমানে ওয়াদিয়ে আল জিন এলাকাটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ধীরে ধীরে পরিচিতি পাচ্ছে। স্থানীয় আরবরা ছুটির দিন এখানে অবসর কাটাতে আসেন। এখানে বেশ কিছু স্থানে ছোট ছোট গাড়ি ভাড়া দেয়ার দোকান গড়ে উঠেছে। সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া নিয়ে উল্টো পথে গাড়ি চলার অভিজ্ঞতা কেমন তা পরখ করে দেখার সুযোগ মেলে।

রহস্যময় পর্বতটি জিনের পাহাড়, যাদুর পাহাড় কিংবা চুম্বকের পাহাড় যে নামেই পরিচিত হোক না কেন এটি পৃথিবীর অবাক এক বিস্ময়ের নাম। এ বিস্ময়ের রহস্য অজানা। স্থানটি দেখার কৌতুহল আরো বাড়ে। তবে এ কৌতুহল মেটানোর কোনো উপায় নেই। এমন অতৃপ্তি নিয়েই ফিরতে হয় দর্শনার্থীদের।

সূএ-ডেইলি বাংলাদেশ

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)