চিতায় জ্বলছে স্ত্রীর শরীর; ঝাঁপ দিলো স্বামীও

অতীব সুন্দরী এক নারী। যদিও তার গাত্র বর্ণ কালো। তাতে কি? সৌন্দর্য যেন তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চুঁইয়ে পড়ছে। নাম তার নাঙেলী। বয়স তার ৩৫। প্রায়ই কাজের জন্য তাকে বাইরে যেতে হতো। তবে সে সবসময় তার স্তন ঢেকে রাখতো। হঠাৎ একদিন সে শুল্ক সংগ্রাহকের নজরে পড়লো, শুল্ক সংগ্রহকরা তার কাছে স্তন শুল্ক দাবি করলো। 

অস্বীকৃতি জানিয়ে মেয়েটি বললো, স্তন আমার, আমি তাকে আবৃত রাখব, নাকি আনবৃত রাখব তা ঠিক করার তুমি কে। আমি শুল্ক দেবো না। প্রতিদিন শুল্ক সংগ্রাহকরা তার বাড়িতে এসে তাকে শুল্ক দেয়ার জন্য চাপ দিতে লাগলো। দিনে দিনে করের বোঝাও বাড়তে থাকে। অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই!

ভারতের দলিত সম্প্রদায়ের ইতিহাস নির্যাতিত আর নিপীড়নের ইতিহাস। একদিকে উচ্চবর্ণের শাসক গোষ্ঠী আরেকদিকে সমাজপতি-উভয় সম্প্রদায়ই দলিতদের ওপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়েছে যুগ যুগ ধরে। এমনই এক নির্যাতনের ইতিহাস হচ্ছে দেশটির কেরালা রাজ্যে দলিত নারীদের ওপর আরোপিত বক্ষকরের ইতিহাস। শাসকগোষ্ঠীর এই অন্যায় করের প্রতিবাদে নিজের স্তন দু’টি কেটে ফেলেছিলেন নাঙেলী নামে স্থানীয় এক দলিত নারী।

নাঙেলী

নাঙেলী

২১৫ বছর আগে কেরালার রাজা ছিলেন ত্রিভাষ্কুর। তার আমলের পুরুষরা গোঁফ রাখতে চাইলেও কর দিতে হতো। আর নারীদের দিতে হতো স্তনকর। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হতো ‘মূলকক্কম’। আইনটি এরকম ব্রাহ্মণ ব্যতীত হিন্দুধর্মের অন্য কোনো নারী তার স্তন আবৃত রাখতে পারবেন না।

নারীর স্তন রাখতে হতো অনাবৃত, উন্মুক্ত। আবৃত করতে হলে বা স্তন ঢেকে রাখতে চাইলে দিতে হবে স্তনশুল্ক। আবার এই শুল্কের পরিমাণ নির্ভর করবে স্তনের আকারের উপর। যার স্তন যত বড় তার শুল্ক ততো বেশি। এই স্তন শুল্কের মোটা অংশ চলে যেত পদ্মনাভ মন্দিরে। গিনেজ বুকের তথ্য অনুযায়ী, এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধনী মন্দির।

এবার ফিরে আসা যাক নাঙেলীর কঠিন বাস্তবতায়- অবশেষে একদিন কর দিতে রাজী হলো মেয়েটি। শুল্ক সংগ্রাহকদের বাইরে অপেক্ষা করতে বলে দরজা বন্ধ করে ঘরের ভিতরে চলে যায় সে, তারপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে ফেলল তার স্তন দুটি। তারপর নিজের স্তনদ্বয়কে কলাপাতার আবরণে মুড়িয়ে শুল্ক সংগ্রাহকের হাতে শুল্কস্বরূপ তুলে দেয় তার রক্ত মাখা স্তন। তারপর বলে, যে জিনিসের জন্য আমাকে অতিরিক্ত শুল্ক গুনতে হয়, সেই জিনিসই আমি রাখবো না।

বস্ত্র পরিধান করায় স্তনশুল্ক গুনতে হয় তাকে

বস্ত্র পরিধান করায় স্তনশুল্ক গুনতে হয় তাকে

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় শুল্ক সংগ্রাহকসহ পাড়া-প্রতিবেশী সবাই। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মেয়েটির মৃত্যু হয়। পুরো ভারতে ছড়িয়ে পড়ে এই ঘটনা। কয়েকদিন পর রাজা ত্রিভাষ্কুর স্তনশুল্কসহ সকল প্রকার অবৈধ শুল্ক বাতিল করতে বাধ্য হন। নিজের অজান্তেই মেয়েটি ১৮৫৯ সালে ভারতে সংগঠিত ‘কাপড় দাঙ্গা’র বীজ বপন করে যায়। নিজেকে কতটা ভালবাসলে এমনটা করা যায় ভাবতে পারেন?

মানুষ নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে অথচ নিজের আত্মত্যাগের বিনিময়ে পুরো কেরালার নারীদের আব্রু রক্ষা করেছিলো বীরাঙ্গনা নাঙেলী। সেও পারতো বাকি সব নারীদের মতো স্তনশুল্ক মেনে নিতে। শুল্ক দেয়ার মতো সক্ষমতাও তার ছিলো। তবে পৃথিবীতে কেউ কেউ বুকে আগুন নিয়ে জন্মায়। কোনো অন্যায় তাদের সামনে আসলেও তা তাদের বুকে স্থান পায় না, বুকের আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যায় সব অন্যায়গুলো। তাইতো নিজের সুখ, শান্তি, চাওয়া-পাওয়া সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে নারীদেরকে অন্যায় প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছিল নাঙেলী।

কাহিনী এখনো বাকি। নাঙেলীর শরীর চিতায় তখনো দাউ দাউ করে জ্বলছে। হঠাৎ একটা লোক দৌড়ে এসে সেই চিতার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। লোকটা নাঙেলীর স্বামী। ভারতের ইতিহাসে, স্ত্রীর সঙ্গে সহমরণে যাওয়া কোনো পুরুষের প্রথম এবং শেষ ঘটনা। ইতিহাসে এই প্রেমিক পুরুষের নাম খোদাই করা।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)