কলারোয়ায় বিলুপ্ত প্রায় জাতীয় ফুল শাপলা

কলারোয়া উপজেলার বিভিন্ন খাল-বিলে বর্ষা মৌসুমে ফোটে বিভিন্ন প্রজাতির শাপলা। এর মধ্যে নয়নাভিরাম মনোমুগ্ধকর লাল শাপলার প্রতি আকর্ষণ সব চেয়ে বেশী। বর্ষা মৌসুমের শুরুতে এ ফুল ফোটা শুরু হয়ে প্রায় ছয় মাস পর্যন্ত বিল-ঝিল জলাশয় ও নিচু জমিতে প্রাকৃতিক ভাবেই জন্ম নেয় নানা প্রজাতির শাপলা। এটি একটি গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। আবহমান কাল থেকে শাপলা মানুষের খাদ্য তালিকায় সবজি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল। বাসাইলের লক্ষীখোলার বিল, বেড়ির বিল, কুশোডাঙ্গার বিল, ছলিমপুরের বিল, রায়টার বিল এ অঞ্চলের স্বল্প আয়ের মানুষেরা এক সময় শাপলা বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করতো বলে শোনা যায়। সাদা ফুল বিশিষ্ট শাপলা সবজি হিসেবে ও লাল রঙ্গের শাপলা ঔষধি গুন সমৃদ্ধ।

ছোটদের কাছে শাপলা ফুল অনন্য সৌন্দর্যের একটি প্রিয় খেলনা। বর্ষার শুরুতে শাপলার জন্ম হলেও হেমন্তের শিশির ভেজা রোদ মাখা সকালের জলাশয়ে চোখ পড়লে রং-বেরঙের শাপলার বাহারি রূপ দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত। এ যেন সাজানো ফুল বাগানের মধ্যে শ্রষ্টার অপরূপ সৃষ্টি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। এমন দৃশ্য চোখে না দেখলে কারও বোধগম্য হবে না। বর্ষা মৌসুমে নৌকা নিয়ে সৌন্দর্য মন্ডিত এ দৃশ্য অবলোকন করতে ছুটে আসতেন প্রকৃতি প্রেমীরা। আবার নিম্ন আয়ের লোকেরা শাপলা বিক্রি করে জীবিকাও নির্বাহ করতো।

স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য হওয়ায় কারণে এলাকার লোকজন শাপলা তুলে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে। এছাড়া এসময় সবজির দর চড়া থাকার কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটাতো। শহরের এক শ্রেণীর মানুষের কাছে মৌসুমি এ সবজির একটি প্রিয় খাদ্য। বর্তমান সভ্যতায় বাড়তি জনসংখ্যার চাপে আবাদী জমি ভরাট করে বাড়ি, পুকুর, রাস্তাঘাট, মাছের ঘের বানানোর ফলে বিলের পরিমাণ যেমন কমছে, তেমনি শাপলা জন্মানোর জায়গাও কমে আসছে।

এছাড়া প্রভাবশালী, জবর-দখলকারী শ্রেণীর লোক খাল-বিলের জায়গা দখল করে নিজেদের আয়ত্তে নেওয়ার কারণে অনেক বিলের জায়গাই সংকুচিত হয়ে পড়েছে। তাছাড়া জমিতে উচ্চ ফলনশীল জাতের চাষাবাদের কারণে অধিক মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন, খাল-বিল ও জলাশয় ভরাটের কারণে উপজেলার বিভিন্ন বিলাঞ্চল থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে নানা জাতের শাপলা। এখন খাল-বিল ও জলাশয় থেকে প্রায় হারিয়েই যাচ্ছে শাপলা।

এক সময় সৌখিন মানুষেরা সৌন্দর্যের জন্য নিজের পুকুরে শাপলা চাষ করতো। এখন ওই সকল পুকুরে কার্প জাতীয় মাছ যেমন- সিলভার কার্প, রোবোকার্প, গ্রাস কার্প মাছ চাষের ফলে শাপলার বংশ বিস্তার সমূলে বিনাশ হয়ে যাচ্ছে। সাদা ফুল বিশিষ্ট শাপলা সবজি হিসেবে ও লাল রংয়ের শাপলা ঔষধি কাজে ব্যবহৃত হয়। শাপলা খুব পুষ্টি সমৃদ্ধ সবজি। সাধারণ শাক-সবজির চেয়ে এর পুষ্টিগুন অনেক বেশি। শাপলায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম। শাপলায় ক্যালসিয়ামের পরিমাণ আলুর চেয়ে সাতগুন বেশি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, শাপলা চুলকানী ও রক্ত আমাশয়ের জন্য বেশ উপকারী। তাছাড়া ডায়াবেটিস, বুক জ্বালা, লিভার, ইউরিনের সমস্যার সমাধানসহ নারীদের মাসিক নিয়ন্ত্রনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঐতিহাসিক কাল থেকেই শাপলার ফল (ঢ্যাপ) দিয়ে চমৎকার সুস্বাদু খৈ ভাজা হতো। যেটি গ্রামগঞ্জে ঢ্যাপের খৈ হিসেবে পরিচিত। মাটির নিচের মূল অংশকে (রাইজোম) আঞ্চলিক ভাষায় শালুক বলে। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে বিল-ঝিল-হাওড়-বাঁওড়-পুকুরের পানি যখন কমে যায় তখন শালুক তুলে খাওয়া হত, তা খেতেও বেশ সুস্বাদু। তবে আমাশয়ের জন্য এটি খুবই উপকারী। কলারোয়া উপজেলার পিছলাপোল গ্রামের আঃ কাদের জানান, কয়েক বছর আগেও বর্ষা কাল থেকে শরৎকালের শেষ ভাগ পর্যন্ত বিল এলাকায় মাইলের পর মাইল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকত নয়নাভিরাম নানা প্রজাতির শাপলা।

এখন আর এমন দৃশ্য চোখে পড়ে না। অনেকের কাছে শাপলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা সৃষ্টিকর্তার অপার সৃষ্টি মনে করলেও বিল ঘেঁষা জমি মালিকদের কাছে এটা নিতান্তই বিরক্তিকর বিষয় বলে দাবী করেন কৃষক আলমগীর হোসেন আবু বকর ও বাবলুর রহমান। তারা বলেন, বোরো মৌসুমের আগে জমিতে চাষাবাদের জন্য এই শাপলার কারণে জমি পরিষ্কার করতে তাদের গুনতে হয় অতিরিক্ত অর্থ। ভাল চাষ না করতে পারলে জমিতে ফলনও কম পাওয়া যায়। কলারোয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা জানান, বর্ষা শেষ না হতেই খাল-বিল ও আবদ্ধ জলাশয়গুলো শুকিয়ে যাওয়ার ফলে শাপলা জন্মানোর ক্ষেত্র বিনষ্ট হয়ে পড়েছে। এর ফলে প্রাকৃতিক এ জাতীয় ফুলটি প্রায় বিলুপ্তির পথে। সরকারি উদ্যোগে এর অনুকূল পরিবেশ তৈরি প্রয়োজন।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)