সবচেয়ে খাটো মানবজাতি!

নানা জাতি বর্ণ ও সংস্কৃতির মিশ্রণে গড়ে উঠা আফ্রিকা মহাদেশের এক বিশেষ মানব সম্প্রদায় পিগমি। শিকারের অভাব, বন নিধন এবং যুদ্ধভিত্তিক সহিংসতায় এখন পিগমি সম্প্রদায় অনেকটাই বিলুপ্ত।

তবে এখনও প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে কঙ্গোর গভীর বনাঞ্চলে কিছু পিগমি সম্প্রদায় বসবাস করে। সভ্য সমাজের কাছে পিগমিরা সাধারণত নিম্ন স্তরের মানুষ কিংবা বনমানুষ নামে পরিচিত। জঙ্গলে বসবাস করা পৃথিবীর সবচেয়ে খাটো সম্প্রদায় পিগমিদের সম্পর্কে আজ চলুন জেনে আসি-

পিগমি শিশুরাপিগমি শিশুরা

পিগমি শব্দটি এসেছে গ্রীক থেকে যার অর্থ কনুই পর্যন্ত। ক্ষুদ্র যেকোনো বস্তু বোঝাতে পিগমি শব্দটি ব্যবহৃত হয়। গড়ে সাড়ে চার ফুট উচ্চতার এই পিগমি গোত্র নিজেও জানে না যে বাইরের দুনিয়ার মানুষ তাদের এই  নামে ডাকে।  এমনকি তারা নিজেরাও পিগমি শব্দটির সঙ্গে পরিচিত নয়। তারা নিজেদেরকে ‘বা’ নামে সম্বোধন করে। তাদের ভাষায় এর অর্থ মানুষ। কঙ্গো, ক্যামেরুন এবং গ্যাবনের জঙ্গলে  পিগমিদের বেশ কয়েকটি উপজাতি বাস করে। এছাড়া ফিলিপাইন, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ এবং পাপুয়া নিউগিনিতে কিছু পিগমীর বসবাস রয়েছে।

বর্তমানে পুরো পৃথিবীতে জীবিত পিগমি মানবের সংখ্যা এক লাখেরও কম।  তাদের মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ হাজার মুগুতি প্রজাতির পিগমি শুধুমাত্র কঙ্গোর জঙ্গলেই বাস করে। পিগমিরা সাধারণত হিংস্র নয়। যুদ্ধ শব্দটি তাদের অভিধানেই নেই। এমনকি তারা নিজেদের মধ্যে কখনো ঝগড়া বিবাদেও লিপ্ত হয় না। প্রার্থনা, আনন্দ-বেদনা ও দুঃখ এসব কিছুর প্রকাশ তারা বিভিন্ন নাচের মাধ্যমে করে। জীবনে প্রত্যেকটি স্মরণীয় মুহুর্ত তারা ঢোল বাদ্য ও নাচের সঙ্গে বরণ করে নেয়।
পিগমি উপজাতিরাপিগমি উপজাতিরা

পিগমিরা যাযাবর জাতি, তারা বনভূমিতে দলবদ্ধ হয়ে ঘুরে বেড়ায়। স্বল্প সময়ের জন্য অস্থায়ী বাসস্থান তৈরি করে তারা। পিগমিরা সাধারণত বিভিন্ন ধরনের বুনো ফল এবং মধু সংগ্রহ করে জীবন ধারণ করে। এছাড়া চতুষ্পদ যেকোনো প্রাণী তারা খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে। প্রতিটি পিগমি দলের দলপতি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন।

তাদের জীবিকার অন্যতম এবং প্রধান উপায় হলো শিকার। প্রতিটি শিকারের আগে দলপ্রধান বিভিন্ন ধরনের মন্ত্র পড়ে দেবতাদের সন্তুষ্টি এবং অমঙ্গল থেকে মুক্তির আশায় প্রার্থনা করেন। পিগমি নারী পুরুষ উভয়েই বন্যপশু শিকারে অত্যন্ত দক্ষ। তারা অনেকদূর থেকে শিকারের গন্ধ পায় এবং পায়ের চিহ্ন দেখে শিকারের আকার ও বয়স ধরে ফেলতে পারে।
এই উপজাতিরা সবাই খাটোএই উপজাতিরা সবাই খাটো

বৈচিত্র্যময় গান ও নাচ পিগমি সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রায় প্রতিটি উৎসব এবং শিকারের আগে এবং পরে তারা গান ও নৃত্য করে। নানাবিধ ঢোলের বিচিত্র তাল এবং বিচিত্র সুরের সঙ্গীতে আয়োজিত এই নাচে শিশু-কিশোর থেকে বৃদ্ধ সবাই অংশগ্রহণ করে। পিগমিরা অতিমাত্রায় কুসংস্কারাচ্ছন্ন। প্রতিটি দলে একজন ওঝার নেতৃত্বে পিগমিরা তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করে। পিগমীরা এমন সব কাজ এড়িয়ে চলে যেসকল কাজে দেবতাদের অসন্তুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

নৃতাত্ত্বিক গবেষকদের মতে, মানবসভ্যতার প্রথমদিকের জীবন্ত নিদর্শন এই পিগমি সম্প্রদায়। সভ্য সমাজের আলো না দেখা এই সম্প্রদায়ের চলাফেরা এবং আচার অনুষ্ঠান যেন লাখো শতাব্দী আগের মানুষদের আচরণকেই প্রতিফলিত করে৷ দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থেকে এই সমাজ আজ বিলুপ্তির পথে। পৃথিবীজুড়ে শান্তির বাণী প্রচার করা কয়েকটি দেশই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে তাদের বিলুপ্তির কারণ।
শিকার করা তাদের প্রধান পেশাশিকার করা তাদের প্রধান পেশা

ইতালি, জাপান এবং পর্তুগিজ বিভিন্ন কাঠভিত্তিক কয়েকটি বড় বড় প্রতিষ্ঠান প্রতিনিয়ত কাঠ কেটে আফ্রিকার বনজ পরিবেশ ধ্বংস করছে। এতে প্রত্যক্ষভাবে ধ্বংস হচ্ছে পিগমিদের বসবাসপযোগী বনভূমি। জায়গা সংকুলান না হওয়ায় ক্রমশ কমে যাচ্ছে তাদের বিচরণক্ষেত্র, কমে যাচ্ছে শিকার এবং বাসস্থান সংকট।

কয়েকটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কঙ্গোর সৈন্যরা জঙ্গলে পিগমিদের শিকার করে তাদের মাংস ভক্ষণ করে। আর দশটি প্রাণির মতো পিগমীরাও মাথা নত করেছে এই মানব আগ্রাসনের কাছে। বাসস্থান ধ্বংস এবং পিগমি নারী এবং শিশুদের প্রতি এসব অত্যাচার যেন মানবাধিকার অনুমোদিত। তাই তাদের জন্য নেই কোনো আইন বা বিচার পাবার অধিকার।
Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)