খালেদের টর্চার সেলে নির্যাতনের সরঞ্জাম

গ্রেফতার যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার টর্চার সেলে মিলেছে নির্যাতন করার আলামত। কাউকে ধরে নিয়ে ইলেকট্রিক শক, পেটানোর সরঞ্জামও পাওয়া গেছে সেখানে। এদিকে, গুলশানের বাসা থেকে অস্ত্র, ইয়াবা, বিদেশি মদ উদ্ধারের ঘটনায় খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে তিনটি এবং টর্চার সেলের ঘটনায় মতিঝিল থানায় আরেকটি মামলা হয়েছে। এছাড়া ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ক্যাসিনো সামগ্রী উদ্ধারের ঘটনায় আরেকটি মামলা হয়েছে। অন্যদিকে, ঢাকা মহানগর যুবলীগের (দক্ষিণ) সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটকে নজরদারিতে রেখেছেন গোয়েন্দারা।

খালেদের টর্চার সেলে নির্যাতনের সরঞ্জাম

জমজমাট ক্লাবপাড়ায় এখন সুনশান নিরবতা বিরাজ করছে। প্রতিদিন যেখানে ক্লাবগুলো ঘিরে দুই হাজারের বেশি মানুষের আনাগোনা ছিল, গতকাল সেখানে কাউকেই পাওয়া যায়নি। ক্লাবগুলোতে তালা ঝুলিয়ে পালিয়েছেন পরিচালকরা। অনেকেই এসব ক্লাবে গিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। কেউ কেউ ১৫/২০ দিন পর্যন্ত ক্লাবেই অবস্থান করতেন। তাদের খুঁজে না পেয়ে স্ত্রীর পক্ষ থেকে থানায় জিডিও হয়েছে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একজন ব্যাংক কর্মকর্তাকে পাওয়া যায় মতিঝিলের সিটি সেন্টারের নিচে শুয়ে থাকতে। সব খুইয়ে নিঃস্ব এই কর্মকর্তা বাড়ি ফিরতে চান না। এই কর্মকর্তার মতো শত শত মানুষ ক্যাসিনোতে গিয়ে সবকিছু শেষ করে ফেলেছেন।

খালেদের বিরুদ্ধে চার মামলা

গতকাল দুপুরে র‌্যাব যুবলীগ নেতা খালেদকে গুলশান থানায় হস্তান্তর করে। থানার পরিদর্শক (অপারেশনস) আমিনুল ইসলাম জানান, মাদক আইন, অস্ত্র আইন এবং মুদ্রা পাচার আইনে তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ১৪ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে তাকে আদালতে পাঠানো হলে আদালত সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। গ্রেফতারের সময় খালেদের বাসা থেকে ৫৮৫ পিস ইয়াবা, লকার থেকে ১০ লাখ ৩৪ হাজার টাকা, ডলারেরও বান্ডিল পাওয়া যায়। এছাড়া তার কাছ দু’টি পিস্তল ও দু’টি শর্টগান পাওয়া গেছে। এর দু’টি লাইসেন্সবিহীন, অপর দুটি লাইসেন্সের শর্তভঙ্গ করে রাখা হয়েছিল। গুলি পাওয়া গেছে ১১৬ রাউন্ড।

কোন ক্লাব চালায় কে?

রাজধানীর মতিঝিল, ফকিরাপুল এলাকায় কমপক্ষে ১৭টি ক্লাব নিয়ন্ত্রণ করেন যুবলীগ নেতা খালেদ। এর মধ্যে ১৬টি ক্লাব নিজের লোকজন দিয়ে আর ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাবটি সরাসরি তিনি পরিচালনা করেন। এই ক্লাবের সভাপতিও তিনি। এছাড়া ক্লাবের গভর্নিং বডির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি। এই এলাকায় একজন এমপির চারটি ক্যাসিনো রয়েছে বলেও জানা গেছে। এছাড়া ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে অভিযানের ঘটনায় মতিঝিল থানায় একটি মামলা হয়েছে। এই ক্লাবের সভাপতি স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি মোল্লা মোহাম্মদ আবু কায়সার। ক্লাবটি পরিচালনা করেন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর এ কে এম মোমিনুল হক সাইদ।

তবে মামলায় তাদের কাউকে আসামি করা হয়নি। শুধুমাত্র তুহিন মুন্সী (৩৮), নবী হোসেন সিকদার (৫২), সাইফুল ইসলাম (৩৪) এবং অজ্ঞাত ২০/২৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রে অভিযানের ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। এই ক্লাবটি পরিচালনা করেন যুবলীগের ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের (দক্ষিণ) সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ। সেখান থেকে জুয়ার সরঞ্জাম, তিন লাখ টাকা, একটি কষ্টি পাথরের মূর্তি উদ্ধার করা হয়। তবে আগেই সবাই পালিয়ে যাওয়ায় কাউকে পাওয়া যায়নি।

যেসব ক্লাবে ক্যাসিনো ও জুয়া চলে

ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, ক্লাব প্যাভিলিয়ন ফকিরাপুল, আরামবাগ ক্লাব, দিলকুশা ক্লাব, ডিটিএস ক্লাব, আজাদ বয়েজ ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব, বিজি প্রেস স্পোর্টস অ্যান্ড রিক্রিয়েশন ক্লাব, ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সোসাইটি ক্রীড়াচক্র বিমানবন্দর কমান্ড, কারওয়ান বাজার প্রগতি সংঘ, ইস্কাটনে সবুজ সংঘে ক্যাসিনো চলে। সবুজ সংঘের পরিচালনা পরিষদে নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন এমপি এবং প্রগতি সংঘের পরিচালনায় তেজগাঁও থানা আওয়ামী লীগের একজন নেতা রয়েছেন। এছাড়া উত্তরা, মিরপুর, বনশ্রী, মগবাজার, মোহাম্মদপুর, গুলশান ও বনানীতে একাধিক ক্লাব আছে। যেখানে গভীর রাত পর্যন্ত ক্যাসিনো, ড্যান্সবার ও জুয়ার আসর বসে।

রাজধানীর বাইরের ক্লাবগুলোর মধ্যে বগুড়ার রহমান নগর ক্রিকেট ক্লাব, চাঁদপুরের মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ভাই ভাই স্পোর্টিং ক্লাব, ফ্রিডম ফাইটার (৫ নম্বর গুপ্তি ইউনিয়ন পরিষদ), নোয়াখালীর শহীদ শাহ আলম স্মৃতি সংসদ হলরুম, সোনাইমুড়ী, নারায়ণগঞ্জের সানারপাড় বর্ণালী সংসদ, বরিশালের সেতুবন্ধন ক্লাব ও লাইব্রেরি, চট্টগ্রামের মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নামও জানা গেছে সংশ্লিষ্টদের কাছে। এসব ক্লাবে বছরের পর বছর ধরে নিপুণ, চড়চড়ি, ডায়েস, ওয়ান-টেন, ওয়ান-এইট, তিন তাস, নয় তাস, রামি, ফ্ল্যাসসহ বিভিন্ন ধরনের তাস খেলা বা কথিত ইনডোর গেমসের নামে জুয়া খেলা চলছে।

সম্রাটের অফিসে গোয়েন্দারা

অভিযানের আগেই বুধবার সন্ধ্যায় ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট সিঙ্গাপুরে যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরে যান। সেখানে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে- এমন তথ্যে তিনি ফিরে আসেন। এরপরই হাজারো নেতা-কর্মী নিয়ে কাকরাইলে শামসুল আলামিন রিয়েল স্টেটের ১৪ তলা এপার্টমেন্টে দক্ষিণ যুবলীগের অফিসে অবস্থান নেন। গতকাল সেখানে র‌্যাব সদস্যদের উপস্থিতি দেখা গেছে। সম্রাটও অফিসের ভেতরে অবস্থান করছেন বলে জানিয়েছেন যুবলীগের নেতাকর্মীরা।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ক্লাবপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ক্যাসিনো চালুর মূল হোতা হলেন সম্রাট। স্থানীয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ম্যানেজ করেই তিনি প্রকাশ্যে ক্যাসিনো চালাতেন। তবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আসলে তারা আগেই অভিযানের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এই নেতারা এতটাই প্রভাবশালী যে তাদের বিরুদ্ধে তখন ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। গত বছর আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের ভবন নির্মানে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করার পর বিষয়টি নিয়ে হৈ চৈ হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রী তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কিন্তু তাতেও থেমে থাকেননি সম্রাট। বহাল তবিয়তেই চলেছে তার কার্যক্রম। সিঙ্গাপুরে মোস্তাফা মার্টে তার একাধিক দোকান রয়েছে। হোটেল মেরিনা বে’তে রয়েছে তার ভিআইপি স্যুট। সেখানে প্রতি মাসে একাধিকবার মদ-মেয়ে নিয়ে জুয়ার আসর বসে।

শামসুল আলামিন রিয়েল স্টেটে তার অফিসের চেম্বারে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য অন্তত ৬টি সিকিউরিটি গেট পার হতে হয়। যে কেউ চাইলেই সেখানে যেতে পারেন না। রাস্তায় তিনি যখন চলাফেরা করেন তখন সামনে পেছনে অন্তত ৬টি গাড়ি নিয়ে নিরাপত্তারক্ষীরা থাকেন। তাদের সঙ্গে বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্রও থাকে। এগুলো বৈধ না, অবৈধ তা নিয়ে তদন্তে নেমেছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)