স্বাক্ষর জালিয়াতি করে অলৌকিকভাবে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা পেনশন উত্তোলন

অর্ধযুগ উধাও থেকে প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে স্বাক্ষর জালিয়াতি করে অলৌকিকভাবে ৩৭ লক্ষ ৭৭ হাজার ৫০৫ টাকা কল্যান ট্রাস্ট ও অবসর ভাতা উত্তোলন করলেন যুদ্ধাপরাধীসহ প্রায় অর্ধশত মামলার ফেরারি আসামী সাবেক মাদ্রাসা অধ্যক্ষ মাওঃ আকবর আলী।

সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার ইন্দ্রনগর হুসাইনাবাদ ফাজিল মাদ্রাসায় মাওঃ আকবর আলী ১৯৭৪ সালে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান। তারপর তার নামে ৭১ এর যুদ্ধাপরাধী মামলা (যার নাং-জি.আর-৯২/৯, কালিগঞ্জ) দায়ের হলে ২০০৯ সালে সারা দেশব্যাপী যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করলে তিনি নিজেকে বাঁচাতে আত্মগোপনে চলে যান।

এরপর ২০১৩ সালে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে দেশে নাশকতা শুরু হলে রাজাকার মাওঃ আকবর আলী সরকার পতনের লক্ষে জামায়াতের হাই কমান্ডের নির্দেশে আবারও এলাকায় ফিরে গাছ কাটা, যৌথবাহিনীর উপর হামলা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং বসতবাড়ি ভাংচুর ও পুড়িয়ে ব্যাপক নাশকতা সৃষ্টি করে এলাকায় ত্রাশ সৃষ্টি করে এবং দেবহাটা উপজেলার সখিপুর মোড়ে শেখ হাসিনার কাল্পনিক কবর তৈরি করে আনন্দ উল্যাস করে।

পরবর্তীতে সরকার যখন তাদের এই অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে চলে যায় তখন রাজাকার আকবর আলী আবারও আত্মগোপনে চলে যায়। সেখান থেকে অর্থাৎ ২০১৩ সাল থেকে তিনি আত্মগোপনে যাওয়ার পর এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীসহ একাধীক মামলা থাকার কারণে তৎকালিন মাদ্রাসার গভর্ণিং বডি তাকে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ পদ থেকে বহিষ্কার এবং সরকারি বেতনের অর্ধেক প্রদান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

পরবর্তীতে বহিষ্কার থাকাকালীন ২০১৭ সালে ৩০ এপ্রিল তার চাকরীর মেয়াদ শেষ হয়। এরপর তার সন্তানেরা পিতার অবসর ভাতার টাকা উত্তোলনের জন্য মাদ্রসা কমিটির নিকট মৌখিকভাবে আবেদন করলে কমিটি তাদের প্রস্তাব নাকচ করেন। অথচ ২০১৩ সাল থেকে মাদ্রাসায় অনুপুস্থিত থেকেও অবসর ভাতার টাকা উত্তোলনের জন্য ২০১৭ সালের ৩০ জুলাই অবসর কল্যান ট্রাস্টে ও অবসর ভাতা বোর্ডে মাদ্রাসায় নিয়মিত উপস্থিত দেখিয়ে এবং কমিটির সদস্যসহ সংশ্লিষ্ঠ ব্যক্তিদের সীল-স্বাক্ষর জাল করে একটি ফাইল জমা দেন।

সেই ফাইলের আবেদন অনুযায়ী তার ব্যাংক হিসাব নাম্বারে (যার সোনালী ব্যাংক হিসাব নং-২৯২৩০১১০০৫৪৫৬) ২০১৮ সালের ২৩ মে ৫ লক্ষ ৭৬ হাজার ৫৯৯ টাকা, ২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী ১৩ লক্ষ ৯০ হাজার ৩২৮ টাকা, ২০১৯ সালের ২৮ মে ৫ লক্ষ ৩৪ হাজার ৯৫০ টাকা এবং সর্বশেষ ২০১৯ সালের ১৬ জুলাই ১২ লক্ষ ৭৫ হাজার ৬২৮ টাকা, সর্বমোট ৩৭ লক্ষ ৭৭ হাজার ৫০৫ টাকা জমা হয়।

ব্যাপারটি এলাকায় জানাজানি হলে সচেতন মহলে সমালোচনার ঝড় ওঠে এবং এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তবে এ ব্যাপরে সঠিক তদন্তপূর্বক তাকে দ্রুত খুজে বের করে বিচারের আওতায় আনার জোর দাবি জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ও সচেতন মহল।

এদিকে একই দূুর্নীতির পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তা ও কমিটির সদস্যদের সিল-স্বাক্ষর জালিয়াতি করে ২০০৪ সালের আসল রেজুলেশন খাতা গায়েব করে নকল রেজুলেশন খাতা তৈরি করে উপধ্যক্ষ পদে তার দ্বিতীয় পুত্র ২০১২ সালে আরবি প্রভাষক পদে উক্ত মাদ্রাসায় যোগদানকৃত মারুফ বিল্লাহকে ২০০৪ সাল থেকে উপধ্যক্ষ পদে ভূয়া রেজুলেশন লিপিবদ্ধ করেছেন।

এবং একইভাবে ২০০১ সালের আসল রেজুলেশন খাতা গায়েব করে নকল রেজুলেশনে চতুর্থ শ্রেনী কর্মচারী পদে শহিদুল ইসলামের পরিবর্তে তার ছোট পুত্র মহসিন বিল্লাহকে লিপিবদ্ধ করে। ২০০১ জন্ম নিবন্ধন অনুযায়ী মহসিন বিল্লাহর বয়স ১০ বছর। তবে এ ব্যাপারে মাদ্রাসার চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী অসহায় শহিদুল ইসলাম স্থানীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপক ডাঃ আ ফ ম রুহুল হক এমপি কর্তৃক সুপারিশকৃত দ্রুত তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন পত্র কালিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার সরদার মোস্তফা শাহিন বরাবর জমা দিলে দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও ব্যবস্থা তো দূরের কথা এখনো তদন্তের কোন খোজও মেলেনি।

তবে এ ব্যাপারে কালিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার সরদার মোস্তফা শাহিনের সাথে তার ব্যবহৃত মুঠোফোনে জানতে চাইলে প্রতিবেদককে তার অফিসে গিয়ে কথা বলার জন্য পরামর্শ দেন।
মাদ্রাসার রেজ্যুলেশন জালিয়াতি ও অবৈধভাবে রাজাকার আকবর আলী পাকিসস্থানি মাস্টার প্লান ব্যবহার করে অর্ধকোটি টাকা উত্তোলনের বিষয়ে সাতক্ষীরা-৩ আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপক ডাঃ আ ফ ম রুহুল হক এমপি বলেন, আমি বহু আগে থেকে শুনেছি ইন্দ্রনগর হুসাইনাবাদ ফাজিল মাদ্রাসার সাবেক অধ্যক্ষ রাজাকার আকবর আলী সীমাহীন অনিয়ম আর জালিয়াতির মাধ্যমে নিজের স্বার্থ হাসিলসহ আর্থিক সুবিধা লুণ্ঠন করেছে এবং সেগুলো প্রমাণিতও হয়েছে।

এবং সম্প্রতি জানতে পারলাম যে, মাদ্রাসা কমিটির সাথে স্বমন্বয় স্বাক্ষর এবং আমার নিজেরও স্বাক্ষর নকল করে সে পেনশনের সম্পূর্ণ টাকা উত্তোলন করেছে। এবং রেজ্যুলেশন জালিয়াতি করে চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারী শহিদুল ইসলামকে বাদ দিয়ে তার ছোট পুত্রের নাম ভূয়া রেজ্যুলেশনে লিপিবদ্ধ করায় তার প্রতিকার চেয়ে শহিদুল ইসলাম কালিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর আবেদন করলে আবেদনপত্রে তদন্ত পূর্বক দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কালিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে নির্দেশ প্রদান করেছিলাম। তবে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত তদন্ত পূর্বক তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানিয়েছেন এই সংসদ সদস্য।

জানতে চাইলে মাদ্রাসার সভাপতি এস.এম আসাদুর রহমান সেলিম বলেন, সাবেক অধ্যক্ষ আকবর আলী যে পেনশন উত্তোলন করেছে সেখানে মাদ্রসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এবং কমিটির স্বমন্বয় স্বাক্ষর থাকার কথা থাকলেও সে আমাদের স্বাক্ষর ছাড়াই অবৈধভাবে সম্পূর্ণ টাকা উত্তোলন করেছে। এ ব্যাপারে আমি মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছি।

জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের স্বমন্বয় স্বাক্ষর ছাড়াই সাবেক অধ্যক্ষ পেনশনের টাকা উত্তোলন করাই সভাপতির নির্দেশে অবসর ভাতা ও কল্যান ট্রাস্টে বিষয়টি জানিয়েছেন।
তবে এসব বিষয়ে মাদ্রসার সাবেক অধ্যক্ষ অভিযুক্ত আকবর আলীর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তিনি ২০১৩ সাল থেকে পালাতাক থাকার কারণে কোনভাবেই তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

এ ছাড়াও তার পুত্ররা এলাকায় বিভিন্ন স্থানে আধিপত্য বিস্তার করতে যেয়ে জনগণের রোশনলে পড়লে মানুষকে হুমকি দিয়ে বলে যে, আওয়ামীলীগ সরকার আমাদের কিছুই করার ক্ষমতা রাখেনা কারণ সরকারি কর্মকর্তারা আমাদের হাতের লোক। এমন কথায় এলাকার সাধারণ মানুষ বিষ্মিত, কারণ আসলেই সরকার তাদের আইনের আওতায় আনতে পারেনা। এবং এমন অনিয়মের মধ্যে সরকারের অর্ধকোটি টাকা তুলে নিলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার মত সরকারের প্রশাসন বা এমন কোন কর্মকর্তা নেই!

মাওঃ আকবর আলী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রাজাকার বাহিনীর সদস্য হিসাবে পাকিস্থানী বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত থেকে হত্যার মতো মানবতাবিরোধী কার্যক্রমে সাহায্য করে। এবং তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)