রেডিও মিস্ত্রি থেকে ক্যালকুলেটরের উদ্ভাবক

মাত্র ১১ বছর বয়সে শহরের নামজাদা রেডিও মেরামতের মিস্ত্রি হয়ে উঠেন তিনি। গাণিতিক চর্চা করেই অতিক্রান্ত হয়েছে তার জীবনের বৃহত্তর কাল। আঙ্কিক সমাধান ছিল তার আগ্রহের বিষয়। এমন একজন হিসাবী মানুষ হিসাবী যন্ত্র আবিষ্কার করবেন না তো আর কে করবেন! দৈনন্দিন জীবনে বহুল ব্যবহৃত একটি জিনিস হলো ক্যালকুলেটর। ছোট বড় সবারই হিসাব নিকাশে প্রয়োজন পড়ে এই যন্ত্রটি। তবে আমরা ক’জনই বা জানি এই ক্যালকুলেটরের আবিষ্কারক কে?

জেরি মেরিম‍্যান, আধুনিকতম গণকযন্ত্র আবিষ্কর্তাত্রয়ের একজন। তিনি পকেট ক্যালকুলেটরের উদ্ভাবক। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুন সেন্ট্রাল টেক্সাসের হার্নে শহরে জন্মগ্রহণ করেন জেরি মেরিম‍্যান। বহু প্রতিভাবান মানুষ চার দেওয়ালের প্রাতিষ্ঠানিক বিদ‍্যচর্চায় ভরসা রাখেন না। এই নিরিখে রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুলের অনুসারী ছিলেন জেরি মেরিম্যান। ডিগ্রিধারী এবং তথাকথিত ‘উচ্চশিক্ষিত’ গবেষকদের মজলিশে খানিকটা যেন অপাঙক্তেয় ছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেননি জেরি। ছেলেবেলা থেকে মগজাস্ত্র ছিল তীক্ষ্ণ। ‘টেক্সাস ইন্সট্রুমেন্টস’ নামক মার্কিন তথ‍্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত তিন সহকর্মী জ‍্যাক কিলবি, জেমস ভ‍্যান ট‍্যাসেল এবং জেরি মেরিম‍্যান গণকযন্ত্রের প্রাথমিক পেটেন্ট তৈরি করেন ১৯৬৭ সালে এবং চূড়ান্ত পেটেন্ট জমা করেন ১৯৭৪ সালে।

২০১৩ সালে জেরি মেরিম‍্যান ‘এনপিআর’কে দেয়া সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছিলেন, ১৯৬৫ সালের শেষের দিক। আমাদের বস জ‍্যাক কিলবি হাতে রাখা যায় এমন একটি ক্যালকুলেটর উদ্ভাবনের কথা ভাবলেন। আমাদের কয়েকজনকে তিনি তলব করে বললেন, আমরা একটি ক্যালকুলেটর তৈরি করব যা বইয়ের মতো ছোট্ট আকারের হবে এবং যা হাতে রাখতে অসুবিধা হবে না। এখন ভাবতে বোকা-বোকা মনে হয়, প্রথমে ভেবেছিলাম সামান্য একটি ক্যালকুলেটর উদ্ভাবন করছি আমরা, প্রকৃতপক্ষে যা ছিল বৈদ‍্যুতিন মাধ‍্যমের একটি উল্লেখযোগ্য বিপ্লব। এই ক্যালকুলেটর আবিষ্কারের নেতৃত্বে ছিলেন জ‍্যাক কিলবি (জন্ম: ৮ নভেম্বর ১৯২৩; মৃত্যু: ২০ জুন ২০০৫); তিনি ২০০০ খ্রিস্টাব্দে পদার্থবিদ‍্যা বিষয়ে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জ‍্যাক কিলবি তৈরি করেছিলেন ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট যা ভবিষ্যতে কম্পুটারের আধুনিকীকরণে সহায়ক হয়েছিল।

স্ত্রী ফিলিস মেরিম‍্যান স্মৃতিচারণা করছেন, দুপুরে এবং সন্ধ্যায় খানাপিনা করে আমরা দু’জন চলচ্চিত্র দেখতে সিনেমা হলে যেতাম। অধিকাংশ দিন হলে গিয়ে পুলিশ হন‍্যে হয়ে খুঁজে তাকে পাকড়াও করে নিয়ে আসত। কারণ তাদের রেডিও মেরামত করতে হবে জেরিকে! টেক্সাস এ অ্যন্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন জেরি, তবে পাঠ সম্পূর্ণ করেননি। পরে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ‘ওশেনোগ্রাফি’ এবং ‘মিটিয়রোলজি’ বিভাগে চাকরি করেছেন। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে ৩০ বছর বয়স থেকে তিনি যুক্ত হন ‘টেক্সাস ইন্সট্রুমেন্টস’ সংস্থায়।

আত্মীয়-পরিজন এবং বন্ধুবান্ধবগণ বলছেন, জেরি সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে। জেরির টিআই সহকর্মী এবং বন্ধু ভার্নন পোর্টের বলছেন, মেটিরিয়াল সায়েন্স বিষয়ে গবেষণাসূত্রে বহু বিজ্ঞানী, অধ‍্যাপক, নোবেল পুরস্কার প্রাপকের সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য হয়েছে। তাদের মধ‍্যে জেরি মেরিম‍্যান আমার দেখা অন‍্যতম বুদ্ধিমান। অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ছিল তার। জটিল তত্ত্ব, সূত্র এমনকি সম্পূর্ণ বিষয় অনায়াসে স্মরণ রাখতে সক্ষম ছিলেন তিনি। জেরির অন‍্য এক সহকর্মী এড মিলিস বলছেন, মাত্র তিন দিনে সার্কিটের নকশা তৈরি করেছিলেন জেরি। আজ যদি ও বেঁচে থাকত তবে নিশ্চয় বলত, ভুলিনি সেই রাতগুলো! সামুদ্রিক হারিকেনে হাওয়ার গতিবেগ পরিমাপ সংক্রান্ত গবেষণাও করেছিলেন জেরি।

স্ত্রী ফিলিস মেরিম‍্যান বলছেন, তিনি সর্বদা বলতেন বিখ‍্যাত হওয়ার কোনো লালসা তার নেই। যদি তার বন্ধুরা বলত, দারুণ কাজ করেছ, তাতেই তিনি খুশি হতেন। পরিবারের আর এক সদস্য মেলিশা মেরিম‍্যান বলছেন, নিজের সম্বন্ধে কখনো তাকে দম্ভ এব‌ং আস্ফালন করতে দেখিনি। সৃজনশীল মানুষের চিন্তাধারা অবারিত, মন উদার- তাতে আর আশ্চর্য কী!

এই বিখ্যাত ব্যক্তি প্রয়াত হয়েছেন গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। বিগত বেশ কিছু সময় ধরে হৃৎপিণ্ড এব‌ং বৃক্কে সমস‍্যা থাকায় ভর্তি ছিলেন ডালাস হসপিটালে, সেখানেই তিনি অন্তিম নিশ্বাস ত‍্যাগ করেন, জানান জেরি মেরিম‍্যানের সৎ কন‍্যা কিম ইকোভিক। পেসমেকার প্রতিস্থাপনের জন‍্য সার্জারি হয়েছিল গত ডিসেম্বর মাসে, তখন থেকেই তিনি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। আবিষ্কর্তা এই পৃথিবীতে বসবাস করলেন ৮৬ বছর।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)