বাংলার মহারানী ভবানী

ভারতীয় উপমহাদেশের বিশাল সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব রক্ষা ও সুশাসনের জন্য বিভিন্ন শাসকগণ বিভিন্ন সময়ে সমগ্র ভারতকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে বিভক্ত করেছিলেন। ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এসব ক্ষুদ্র অঞ্চলসমূহ স্থানীয় জমিদার ও বিভিন্ন রাজবংশ দ্বারা পরিচালিত হতো যা কেন্দ্রীয়ভাবে সম্রাট বা সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ যার দখলে ছিলো তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন। তখন সমগ্র বাংলা বিভিন্ন অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন রাজপরিবার, জমিদার অথবা দেওয়ান দ্বারা পরিচালিত হতো, যারা সম্রাটের বা কেন্দ্রীয় শাসনকর্তার নিকট আজ্ঞাবহ থাকতেন।

সেই সুবাদেই ১৮০০ শতকের শুরুতে নাটোরে রাজবংশ উৎপত্তি লাভ করে। ১৭০৬ সালে তৎকালীন বাংলার বানগাছির জমিদার গণেশ রায় এবং ভবানীচরণ চৌধুরী রাজস্ব দিতে সামর্থ না হতে পেরে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। তখন দেওয়ান রঘুনন্দন তার ভাই রামজীবনকে বৃহত্তর রাজশাহী, নাটোর, পাবনা এবং এর আশেপাশের অঞ্চলসমূহের জমিদারীর দায়িত্ব অর্পণ করেন। ১৭৩৪ সালে রামজীবন মারা গেলে তার ছেলে রামাকান্ত রাজা হন। রামাকান্তের মৃত্যুর পর নওয়াব আলিবর্দী খান রামাকান্তের স্ত্রী রানী ভবানীকে অত্র অঞ্চলের জমিদারীর দায়িত্ব অর্পণ করেন।

সে সময়ে নারী শাসন অত্যন্ত বিরল হলেও রানী ভবানী তার দক্ষ শাসনকার্য দ্বারা তার প্রজাদের মাঝে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। তিনি তার শাসনকালের পুরো সময় জুড়ে তার প্রজাদের কল্যাণে কাজ করেছেন। তিনি তার অঞ্চলে বেশ কিছু খাল খনন, যোগাযোগ ব্যাবস্থার উন্নয়নের জন্য সড়ক নির্মান, চিকিৎসা ব্যাবস্থার উন্নতি এবং বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয় নির্মান করেছিলেন। তিনি হাওড়া শহর থেকে কাশী পর্যন্ত ‘বেনারস রোড’ নামক একটি সড়ক নির্মান করেছিলেন যা বর্তমানে মুম্বাই (প্রাচীন বোম্বে) সড়কে যেয়ে উঠেছে। এছাড়াও তিনি ‘ভবানী জাঙ্গাল’ নামক বিশেষ সড়ক এবং রাস্তা নির্মান করেছিলেন। তিনি বেশ ধর্মপরায়ণ ছিলেন।

রানী ভবানী কাশী অর্থাৎ বেনারসে ভবানীশ্বর শিব, দুর্গাবাড়ী, দূর্গাকুণ্ড এবং কুরুক্ষেত্রতলা নামক জলাশয় স্থাপন করেছিলেন। তিনি মুর্শিদাবাদের বড়নগরে একশতটি শিবমন্দির সহ প্রায় তিনশত ষাটটি ধর্মীয় উপাসনালয় নির্মাণ করেছিলেন। রানী ভবানীর সুদক্ষ ও বিচক্ষণ শাসনের ফলে তার শাসন অঞ্চল নাটোর, রাজশাহী, পাবনা ছাড়াও বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, রংপুর এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, মালদাহ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তৎকালীন ভারতের বঙ্গীয় অংশ এবং বাংলার বিশাল অংশের শাসনকর্তা হওয়ার জন্য রানী ভবানীকে ‘অর্ধবঙ্গেশ্বরী’ বলা হতো।

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ইংরেজ দ্বারা বাংলা দখল হওয়ার পরেও রানী ভবানী তার অঞ্চলের শাসনক্ষমতায় ছিলেন। তৎকালীন সময়ে ইংরেজদের বিপুল পরিমানে খাজনা প্রদানের মাধ্যমে জমিদারী টিকিয়ে রাখতে হত। এই বিপুল খাজনা সংগ্রহের জন্য অন্যান্য জমিদারগণ তাদের প্রজাদের উপর অনেক অত্যাচার করতো। যেখানে রানী ভবানী ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যাতিক্রম, তার প্রজাদের প্রতি তার ভালোবাসা ছিলো অসীম। তিনি প্রয়োজনে কোষাগার থেকে খাজনা পরিশোধ করতে দ্বীধা করতেননা। সৎ, ন্যায়পরায়ণ, প্রজাবৎসল ছিলেন বিধায় তার প্রজারা তাকে ভালোবাসতো এবং নিয়মিত খাজনা পরিশোধ করতো। প্রজারা ভালোবেসে এবং শাসন দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে ‘মহারানী’ নামে আখ্যায়িত করতো।

দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর শাসনের পর তৎকালীন ইংরেজ লর্ড; লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের সঙ্গে বিরোধের জেড়ে রানী ভবানী তার শাসনক্ষমতা তার ছেলে রামকৃষ্ণের কাছে প্রদান করে স্বেচ্ছায় গঙ্গাবাসে চলে গিয়েছিলেন। ১৭১৬ সালে বগুড়া জেলার আদমদিঘী থানার অধীন ছাতিয়ান গাঁও নামক স্থানে রানী ভবানী জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতার নাম আত্মারাম চৌধুরী এবং মাতার নাম জয়দূর্গা। রানী ভবানী ১৭৯৫ সালে বর্তমান ভারতের মুর্শিদাবাদের বড়নগরে মৃত্যুবরণ করেন। তার স্মৃতি বিজড়িত বাসস্থান ‘নাটোরের রাজবাড়ী’ যা নাটোর জেলার অবস্থিত তা বর্তমানে বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)