দুই বাংলার বর্ষবরণ দু’দিনের ব্যখ্যা

বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। প্রতিবছর এ দিনটির জন্য মুখিয়ে থাকেন প্রায় সব বাঙালি। বিশে^র যে প্রান্তেই থাকেন না কেন এ দিনটিতে ষোলআনা বাঙালিয়ানায় উদ্ভাসিত হতে লাল-সাদায় রাঙিয়ে তোলেন নিজেকে। আর সঙ্গে পান্তা ও ইলিশ মাছের স্বাদ চেখে নেয়ার বিষয়টি তো রয়েছেই। তবে এপার বাংলা ও ওপার বাংলাতেই যেন নিহিত পহেলা বৈশাখের সব জাকজমকতা! বাংলাদেশে তো এ দিনটিকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে মঙ্গল শোভাযাত্রা ও বিভিন্ন মেলার কথা না বললেই নয়। অন্যদিকে, ওপার বাংলাতেও যেন হৈ হৈ রৈ রৈ কান্ড! সেখানেও পূজা-পার্বণসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলার মাধ্যমে বরণ করা হয় বাংলা মাসের প্রথম দিনটিকে। এছাড়া, দুই বাংলার ব্যবসায়ীরা ‘হালখাতা’র মাধ্যমে পুরনো হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে নতুন খাতা খোলেন। বর্ষবরণে দুই বাংলার এসব রীতিনীতিতে বেশ মিল থাকলেও দুটি ভিন্ন দিনে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয়। বাংলাদেশে ১৪ এপ্রিল এবং পশ্চিমবঙ্গে ১৫ এপ্রিল। কেন এই বিভাজন? জেনে নিন দুই বাংলার বর্ষবরণের দিনক্ষণ বিভাজনের আদ্যোপান্ত-

ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি জাতিসত্তার একমাত্র পার্বণ – বাংলা নববর্ষ। পহেলা বৈশাখকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার একমাত্র উৎসব হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলা নববর্ষ পালনে ধর্মের সম্পৃক্ততাকেও অস্বীকার করা যায় না। অতীতে ‘তিথি লোকনাথ পঞ্জিকা’ অনুসরণে পহেলা বৈশাখ নির্ধারিত হতো। পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয়ভাবে খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ নির্ধারণ হয়। ফলে পঞ্জিকার সঙ্গে একদিন আগপিছ প্রায়ই ঘটে। আবার চার বছর অতিক্রান্তে পঞ্জিকার সঙ্গে মিলে গিয়ে একইদিনে, অর্থাৎ – ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হয়। পশ্চিম বাংলায় বঙ্গাব্দের নববর্ষ ‘তিথি পঞ্জিকা’ অনুসরণে পালিত হয়। সে কারণে বাংলা নববর্ষ পালনের ক্ষেত্রে দুই বঙ্গে একদিন আগে-পরে হয়ে থাকে। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে পহেলা বৈশাখ ১৪ এপ্রিল উদযাপিত হলেও দেশের হিন্দু সম্প্রদায় ‘তিথি লোকনাথ পঞ্জিকা’ অনুসরণে ১৫ এপ্রিল নববর্ষ পালন করে থাকে।

এ বিষয়ে ডয়েচে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলা একাডেমির সাবেক পরিচালক ফরহাদ খান বলেন, অবিভক্ত বঙ্গদেশে নবদ্বীপের প-িত স্মার্ত রঘুনন্দন বাংলা পঞ্জিকা সংস্করণ করেন, এরপর ১৮৬৯ সালে আবারও এটি সংস্কার হয়। পরে সেটা মুদ্রিত আকারে প্রকাশ হয়। এরপর ১৮৯০ সালে বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত মতে পঞ্জিকার প্রকাশ চলতে থাকে। ১৯৫২ সালে মেঘনাদ সাহাকে ভারত সরকার পঞ্জিকা সংস্কারের দায়িত্ব দেন। তিনিই শকাব্দ (শকরাজ কর্তৃক প্রবর্তিত অব্দ বা বৎসর) সংস্কার করেন। সেই শকাব্দ অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ ১৪ এপ্রিল। মেঘনাদ সাহার এই সংস্কার বাংলাদেশেও ব্যাপক নাড়া দিয়েছিল। ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমি ড. শহীদুল্লাকে সভাপতি করে পঞ্জিকা সংস্কার শুরু করে। আগে বাংলা মাসগুলো ৩০, ৩১, ৩২ দিন ছিল। তারপর ঠিক হয়, প্রথম ৫ মাস ৩১ দিনের, বাকি ৭ মাস ৩০ দিনের হবে। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে আবারো পঞ্জিকা সংস্কার হয়।

বঙ্গাব্দ চালু হয়েছিল ফসলি সন হিসেবে। যে বছর (১৫৫৬ সাল) স¤্রাট আকবর সিংহাসনে বসেন ওই বছরই বঙ্গাব্দ চালু হয়েছিল। হিসাব করা হয়েছিল হিজরি সন ধরে। হিজরি সন ৯৬৩-কে ধরেই শুরু হয়েছিল বঙ্গাব্দের হিসাব। সেই পঞ্জিকাই রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। এতে বৈশাখ থেকে ভাদ্র হলো ৩১ দিনে, আশ্বিন থেকে চৈত্র হলো ৩০ দিনে এবং খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডারের লিপ ইয়ারে ফাল্গুন মাস ৩১ দিনের হবে। অর্থাৎ যে বছর খ্রিস্টীয় সনে লিপ ইয়ার, ওই বছর বাংলা সনেও লিপ ইয়ার। এ সংস্কারের সময় আমাদের গৌরবময় মাস, আমাদের শোকের মাস, আমাদের বিজয়ের মাস ও ১৯৭১ সালকে মাথায় রাখা হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর, ৫২’র ২১ ফেব্রুয়ারি-তে বঙ্গাব্দের যে তারিখগুলো ছিল সেগুলোকে প্রতি বছর এক রাখার জন্যই বাংলা একাডেমি এ সংস্কার করে। এর ফলে, সরকারি পঞ্জিকা অনুসারে ২১ ফেব্রুয়ারি হলো ৯ ফাল্গুন, ২৬ মার্চ হলো ১২ চৈত্র এবং ১৬ ডিসেম্বর হলো ২ পৌষ। কখনো এর হেরফের হয় না।

অন্যদিকে, কলকাতার বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাহিত্যিক শঙ্করলাল ভট্টাচার্যের মতে, মেঘনাদ সাহার সময়ই একবার পঞ্জিকা সংস্কার হয়েছিল। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পরিবার থেকেই পঞ্জিকা সংকলিত হয়েছে। ঘটনাচক্রে যুগের সঙ্গে পঞ্জিকা দর্শন বা পঞ্জিকা বিচার আস্তে আস্তে ফুরিয়ে এসেছিল। সেই সঙ্গে ৬৭ সালে বামপন্থা যুগ মিলেমিশে গিয়েছিল। এ বিবর্তনের ফলে বিয়ে-শাদি বা পূজার দিনক্ষণ নির্ধারণে শুধু পঞ্জিকা দেখা হতো। দু’দেশের বর্ষবরণ বিভাজন সম্পর্কে তিনি বলেন, বিভাজন শুধু কাঁটাতারের নয়। বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য বইটিতে আহমেদ শরীফ সাহেব বলেছেন, এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ অর্থে মধ্য ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লেখা হয়নি। কারণ মুসলিম রচিত বাংলা সাহিত্য নিয়ে যথেষ্ট জিজ্ঞাসু হননি কলকাতার লেখকরা। ফলে বিভাজনটা রয়ে গেছে চেতনাতেও।

সেই আকবরী জামানা থেকে বর্ষবিচার শুরু হওয়ায় আর্থিক যোগ ছিল প্রথম থেকেই। ধর্মের যোগ আসেনি। কলকাতায় হালখাতা উদযাপন করা হয়। দোকানিরা খেরোর খাতা নিয়ে গিয়ে কালীঘাটে পূজা দেয়। অর্থভাগ্য ভালো হওয়ার জন্য আবার মন্দিরে যাওয়া শুরু হলো। পহেলা বৈশাখে কোনো হিন্দুয়ানিও নেই, আবার ইসলামি সংস্পর্শও নেই। এটি বঙ্গীয় সংস্কৃতি। তবে কলকাতার বইপাড়ায় আগে পহেলা বৈশাখ উদযাপন হতো বই ও পত্রিকা প্রকাশ করে, এখন সেটা আয়েসি ও একঘেঁয়ে ভোগীচেহারা হয়ে গেছে। অনেকটা ক্যালেন্ডার উদযাপন বলা যেতে পারে। সে তুলনায় বাংলাদেশে বর্ষবরণের চেহারা অনেকটাই আলাদা তাতে সন্দেহ নেই। তবে বলতে হবে এই বিতর্ক থাকবেই। চলতে থাকবে ১৪ এপ্রিল ও ১৫ এপ্রিল নববর্ষ উদযাপন।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)