পৃথিবীর সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর জেল ব্রেক

থ্রিলার উপন্যাস বা হলিউড বলেউডের সিনেমায় প্রায়শই জেল পালানো সম্পর্কে পড়ে থাকবেন! এসকল সিনেমা উপন্যাসের চরিত্রগুলো অসাধারণ সব উপায়ে শত শত গার্ডের চোখে ধুলা দিয়ে জেল ভেঙে পালিয়ে থাকে। এসকল সিনেমা এমন সব উপায়ে চিত্রিত করা হয় যাতে যেকোনো মানুষ রোমাঞ্চ অনুভব করতে বাধ্য। আবার অনেক ক্ষেত্রে এসকল সিনেমা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক কয়েদির মনেই জেল পালানোর বুদ্ধি ঘুরপাক খায়। কিন্তু সিনেমা উপন্যাস বাদেও বাস্তবে এমন সব জেল পালানোর গল্প রয়েছে যা সবাইকে তাক লাগাতে বাধ্য। এমনকি এসকল বাস্তব কাহিনির উপর ভিত্তি করেই তৈরি হয় জনপ্রিয় সব সিনেমা। ইতিহাসের এমনই এক প্রিজন ব্রেক হল গ্রেট স্কেপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সংগঠিত এই চাঞ্চল্যকর জেল ব্রেক নিকট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রিজন ব্রেক হিসেবে ধরা হয়। এমনকি ১৯৬৩ সালে এই জেল ব্রেক নিয়ে জনপ্রিয় সিনেমা দ্য গ্রেট স্কেপ ও নির্মিত হয়। তাহলে জেনে আসা যাক পৃথিবীর সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর এই জেল ব্রেক সম্পর্কে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকেই জার্মান প্রিজন ক্যাম্পগুলো কুখ্যাত। এসকল প্রিজন ক্যাম্পগুলোতে মিত্রশক্তির সৈন্যদের উপর করা হত অমানবিক অত্যাচার। খুব কম সংখ্যক কয়েদিই এসকল প্রিজন ক্যাম্প থেকে বেঁচে ফিরতে পেরেছিলেন। এমনই এক প্রিজন ক্যাম্প হল স্ট্যালাগ লুথফ ৩। এই ক্যাম্পের সকল কয়েদিই ছিলেন মিত্র শক্তির বিভিন্ন দেশের সৈন্য। যার মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন ব্রিটিশ সৈন্য। এমনই একজন ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ার ফোর্সের স্কোয়ার্ডন লিডার রজার বুশেল। যে কিনা ক্যাম্প লুথফ ৩ এর নর্থ কম্পাউন্ড থেকে প্রায় ২০০ কয়েদির পালানোর পরিকল্পনা করেন। যদিও ব্রিটিশ হায়ার অথোরিটির  মাত্র ২০ জন কয়েদির পালানোর জন্য পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু রজার তার পরিকল্পনায় অটল ছিলেন এবং ২০০ জনের জন্য সাধারণ পোষাক ও সামগ্রী দাবী করেন। ১৯৪৩ সালের মার্চ থেকে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। রজার ৩ টি ১০২ মিটারের টানেল খোদাইয়ের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অনেক বিশ্বস্ত লোকের প্রয়োজন ছিল। রজার তার বিশ্বস্ত সৈন্যদের উপরে এজন্য দায়িত্ব দিয়েছিলেন এবং ৩ টি টানেলের জন্য নাম ঠিক করে দিয়েছিলেন। টম, ডিক এবং হ্যারি ছিল টানেলগুলোর ডাক নাম। বিগ এক্স ছিল মাস্টারমাইন্ড রজারের নিক নেম।

রজার তার সৈন্যদেরকে নিকনেমের ব্যাপারে সতর্ক করে দেয় এবং যেকোনো ব্যাক্তি টানেল শব্দ ব্যবহার করলে তাকে কোর্টমার্শাল করার শাস্তি দেয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল। কিছু দিনের মধ্যেই রজারের সহযোগীরা প্রায় ৬০০ জন বিস্বস্ত কয়েদি জোগাড় করে ফেলে এবং টানেল খোদাই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করে। প্রথমে শুরু হয় টম নামক টানেলের কাজ। এই টানেলটি হাট ১২৩ নামক সেল থেকে শুরু হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী টানেলটি শেষ হয় প্রিজন ক্যাম্পের উত্তর পূর্ব পাশে। কিন্তু টানেলটিকে জার্মান প্রিজন গার্ডরা আবিস্কার করে ফেলে এবং ডায়নামাইট বিষ্ফোরণ করে টানেলটি ধ্বংস করে। পরবর্তীতে, ডিক নামক টানেলের কাজ শুরু হয় যার শুরু হয় ক্যাম্পের হাট ১২২ এর ওয়াশরুম থেকে। কিন্তু এই টানেলের শেষ মাথায় জার্মানরা নতুন একটি ক্যাম্প তৈরর কাজ শুরু করে। যে কারণে এই টানেলটির কাজ রজার বাতিল ঘোষণা করে। তবে এই টানেলটি অন্য টানেলের মাটি এবং টানেল খোদাই এর কাজ এ ব্যবহৃত যন্ত্রাদি রাখার জন্য ব্যবহার করা শুরু হয়। অবশেষে শুরু হয় হ্যারি নামক টানেল খোদাই এর কাজ। যা শুরু হয় ক্যাম্পের ১০২ নাম্বার হাট থেকে এবং শেষ হয় ক্যাম্পের উত্তর পাশের জঙ্গলে। এই টানেলটিই পালানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। ১৯৪৩ সালের মার্চে কাজ শুরু হলেও সব চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ১৯৪৪ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ ভাগে কাজ শেষ হয়।

টানেল এর কাজ শেষ হলেও রজারকে কয়েদিদের পালানোর জন্য পরিকল্পনা করতে বেশ হিমসিম খেতে হয়। ২০০ জন কয়েদিকে একত্রে করতে এবং জার্মান কড়া গার্ডদের চোখ ফাঁকি দেয়াই তখন সবচেয়ে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। অবশেষে ২৪ মার্চ রাতে এবং ২৫ মার্চ প্রথম প্রহরকে পালানোর জন্য উপযুক্ত সময় ঠিক করা হয়। সেদিন আমাবস্যা থাকার কারণে খুব সহজেই গার্ডদের চোখ ফাঁকি দিয়ে দেড়শ কয়েদি একত্রিত হতে পেরেছিল। ২৪ মার্চ রাতেই পালানোর কাজ শুরু হয় তবে অন্ধকার এবং টানেল এর গর্ত খুব ছোট হওয়ার কারণে পালানোর কাজ খুব ধীরগতিতে চলছিল। কিন্তু ২৫ মার্চ রাত ৩ টার দিকে গর্তটি জার্মান গার্ডরা আবিষ্কার করে ও বাকি কয়েদিদেরকে আটক করে। সর্বমোট ৭৫ জন কয়েদি পালাতে সক্ষম হয়েছিল। দূর্ভাগ্যবশত এই প্লানের মাস্টারমাইন্ড রজার বুশেল পালাতে সক্ষম হয়না। আটক কয়েদিদেরকে হিটলার মৃত্যুদন্ডের নির্দেশ দেয়। পরবর্তীতে পালানোর চেস্টায় ব্যর্থ সকলকেই গ্যাস চেম্বারে প্রেরণ করে হত্যা করা হয়। পুরোপুরি সফল না হলেও ইতিহাসে এর থেকে বেশি কয়েদি একত্রে পালাতে সক্ষম হয়নি এবং গ্রেট স্কেপকেই পৃথিবীর সবচেয়ে দূর্ধর্ষ জেল ব্রেক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)