হেরেমের নির্মম খোজা প্রথা (পর্ব-১)

ইতিহাসের পর ইতিহাস মানুষের কাছে হারেম বিশেষ এক আকর্ষণের নাম। আক্ষরিকভাবে হারেম মানে হচ্ছে রাজা রানীদের আমলের নারীদের থাকার জায়গা, যেখানে প্রবেশের অধিকার ছিল সংরক্ষিত। রাজা বাদশাদের জন্য নারীদের দ্বারা মনোরঞ্জিত হওয়া ছিল এক রাজসিক রীতি। সেই রীতির আঁধার ছিল শত শত রমণী আর হারেম অবকাঠামো ছিল। হারেমের এই রূপ পাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের অটোমান সাম্রাজ্যের শাসকেরা। তাদের রাজকীয় হারেম আর বিলাসবহুল জীবনযাত্রা মানুষকে মোহিত করত। কেবল বিনোদন আর মনোরঞ্জনের জন্যই যে নারীদের ব্যবহার করা হত তা নয়, অটোমান প্রশাসনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল হারেমের নারীদের। অটোমান সংস্কৃতির এই রহস্যময় অন্দরমহল দূর প্রাচ্য থেকে সূদুর পশ্চিম পর্যন্ত সর্বত্রই তৈরি করেছে গোপন আগ্রহ। সব জায়গার মানুষের কাছে এক গোপন আগ্রহের বিষয়, কিন্তু গোপন আগ্রহ সব সময়ই ভয়ঙ্কর।

‘হারেম’ শব্দটিকে কখনো কখনো ‘হেরেম’ও বলা হয়। তবে মূল অর্থ সাধারণত একই। ‘হারেম’ (Harem) শব্দটি তুর্কি হলেও হিব্রু হেরেম এবং গ্রিক ‘হারেমিও’ শব্দটিও এর সমগোত্রীয়।  আবার তুর্কি শব্দটির উৎপত্তি আরবি শব্দ থেকে। আরবি ‘হারাম’ শব্দ থেকেই হেরেমের উদ্ভব। আরবি ‘হারাম’ শব্দের আভিধানিক অর্থ নিষিদ্ধ বা অলঙ্ঘনীয় সীমারেখা। তুর্কি ভাষায় হারেম বুঝানো হয়েছে মহিলাদের বসবাসের নিরাপদ স্থান যেখানে পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। হিব্রু ভাষায় হেরেম (Harem)-এর অর্থও একই। গ্রিক শব্দ হেরেমি এর অর্থ গোত্রচ্যুতকরণ। মূলত আরবি ‘হারাম’ শব্দটিকে তুর্কীরা খানিকটা সহনীয় করে হারেম এ পরিণত করে। এরপর যোগ করে ‘লিক’। ফলে তুর্কি শব্দটি দাঁড়ায় ‘হারেমলিক’। বাড়ির যে অংশে মহিলারা থাকে তুর্কীতে সেই স্থানকে ‘হারেমলিক’ বলা হয়।

এই উপমহাদেশে হারেম নামে পরিচিত হলেও ইউরোপীয়দের কাছে হারেম হচ্ছে ‘সেরালিয়ো’। এখানে ইতালিয়ান ও ফারসি ভাষার অদ্ভুত এক সম্মিলন ঘটেছে। ইতালিয়ান ভাষায় ‘সেররালিয়োন’ অর্থ হলো ‘বন্য প্রাণীর খাঁচা’। ‘সেররালিয়ো’ এসেছে ফারসি ‘সেরা’ থেকে। তবে ফারসি ‘সরা’ ও ‘সরাই’ অর্থ হলো ভবন বা প্রাসাদ বিশেষ। মূলত এই শব্দের সঙ্গে মিলিয়েই এমন অদ্ভুত নামকরণ। অবশ্য  ১৬৩৪ সালে হারেম শব্দটি ইংরেজি ভাষার অন্তর্ভুক্ত হয়। সব শব্দের অর্থ মোটামুটি একই ধরনের, যার অর্থ নিষিদ্ধ। অন্যভাবে বললে এর অর্থ হচ্ছে নিষিদ্ধ বা গোপনীয় স্থান। রাজপ্রাসাদের যে আলাদা অংশে  শাসকের মা, বোন, স্ত্রী, কন্যা, নারী কর্মচারী, উপপত্নী প্রমুখ বাস করতেন তা হারেম, হারিম বা হেরেম নামে অভিহিত হতো। বহিরাগতদের হারেমে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। যেহেতু এসব হারেমে প্রবেশাধিকার খুবই সংরক্ষিত ছিল সেহেতু এসব মহলে নারীদের রক্ষী ও বিভিন্ন কাজের জন্য বিশেষ এক অমানবিক প্রথা চালু করা হয়। যার নাম হচ্ছে খোজা প্রথা।

বাইবেলের ম্যাথু অধ্যায়ের বর্ণনা মতে “For there are some eunuchs, which were so born from their mother’s womb and there are some eunuchs, which were made eunuchs of men and there be eunuchs, which have made themselves eunuchs for the kingdom of heaven’s sake”৩ বাইবেলের এই উক্তি থেকেই প্রমানিত হয় নপুংশক বা খোজাকরণের ঘৃণ্য প্রথাটি অত্যন্ত সুপ্রাচীন। শেষের দিকে ধর্মীয় কুসংস্কার বশতঃ স্বেচ্ছায় নপুংসক হওয়ার নজির একাদশ শতকের খৃষ্টান স্কপ্টসি (Skoptsy) সম্প্রয়াদায়দের মাঝে। যারা জাগতিক কামনা বাসনাকে বিসর্জন দিয়ে স্বেচ্ছায় নিজেদের লিঙ্গচ্ছেদ করে খোজাতে পরিণত হতো। তৎকালীন সময়ে এদের সংখ্যাটিও উল্লেখ করার মতো। প্রায় লক্ষাধিক সদস্য এই দলভুক্ত ছিল। আর ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিজের বা নিজেদের হীন স্বার্থে কাউকে খোজা বানানোর প্রথম ঘটনা ঘটে প্রাচীন মেসিপ্টোমিয়ায়। আসিরিয়ান সাম্রাজ্যের রানী সেমিরামিস (খৃঃপূর্ব ৮১১-৮০৮)প্রথমবারের মতো একটি বালকের লিঙ্গ ছেদন করে এই ঘৃণ্য প্রথার সূত্রপাত করেন।

যেভাবে খোজা করা হত
স্বাভাবিক লিঙ্গ নিয়ে জন্ম নেয়া কিশোরদের সার্জারির মাধ্যমে খোজা বানানো হত। এ বিষয়ে বিস্তৃত বিবরণ আছে বিখ্যাত ঐতিহাসিক ঔপন্যাসিক Barbara Chase-Riboud এর লেখা ‘Valide; novel of Harem উপন্যাসে। বারবারার বর্ণনা মতে, প্রথমে বালক বা কিশোরকে হেলান দেয়া অবস্থায় বসিয়ে তলপেট ও উরুর উপরি অংশে ফিতা দিয়ে শক্তভাবে বেঁধে দেয়া হতো যাতে অধিক রক্তক্ষরণ না হয়। তারপর লিঙ্গ এবং অন্ডকোষকে তিনবার ঝাল মরিচ গোলা পানি দিয়ে ধুইয়ে নেয়া হত। মনে করা হয়,  এনেস্থেসিয়ার বিকল্প হিসেবে এটি করা হত। মরিচ গোলা পানিতে অঙ্গ ধৌতকরণের কারণে প্রচন্ড জ্বালাপোড়া হত এবং এই যন্ত্রণাদায়ক অবস্থাতেই একটি বাঁকানো চাকু দিয়ে লিঙ্গ এবং অন্ডকোষকে যথা সম্ভব চামড়ার সঙ্গে লাগিয়ে কেটে ফেলা হত।

মূত্র নালীতে একটি ধাতব কাঠি (যা আমাদের দেশে নিমের চিকন ডাল এর মত দেখতে) প্রবেশ করিয়ে কাটা অঙ্গকে ঠান্ডা পানিতে ভেজানো কাগজ দিয়ে ঢেকে সতর্কভাবে ব্যান্ডেজ করা হত। ব্যান্ডেজের পর দু’জন হাজামের সাহায্যে আক্রান্তকে হাঁটিয়ে তার কক্ষে নেয়া হত এবং বসিয়ে রাখা হত। এরপর দু’তিন ঘন্টা পর তাকে শুইয়ে দেয়া হত। তিনদিন পর্যন্ত তাকে কিছুই পান করতে দেয়া হতোনা। একদিকে কাটা ঘাঁয়ের যন্ত্রণা অপরদিকে বুক ফাঁটা তৃষ্ণা। এভাবেই তাকে তিল তিল করে তিনটি দিন অতিক্রম করতে হত। তিনদিন পর ব্যান্ডেজ খুলে কাঠিটি বের করে আনার পর যদি ঝর্ণার মতো মূত্রধারা প্রবাহিত হত তবেই অপারেশন সফল বলে গণ্য হবে আর মূত্র না বের হলে সেই হতভাগা শিশুটির অবধারিত পরিনাম ছিল মৃত্যু। কেননা মূত্র বের না হওয়ার অর্থ তার কিডনী নষ্ট হয়ে গিয়েছে। বেশীরভাগ সময়ই শিশু কিশোরগণ কিডনী নষ্টের কারণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)