অর্গানাইজড সন্ত্রাসগোষ্ঠী ‘ইয়াকুজা’র ইতিকথা

সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ নানান অপরাধমূলক কর্মে যুক্ত হয়েছে এবং পৃথিবীর সকল জাতিরই অপরাধের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে। এসকল অপরাধীরা সুসংগঠিত হয়ে নিজেদের আলাদা গোষ্ঠী তৈরি করেছে। যাদেরকে বর্তমানে অর্গানাইজড ক্রিমিনাল বলা হয়ে থাকে। এসকল ক্রিমিনালরাই পুরো পৃথিবীব্যাপী অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। এমনই এক জাপানিজ অপরাধ সংঘ ‘ইয়াকুজা’। হলিউড সিনেমা বা পত্রপত্রিকায় হর হামেশাই  ইয়াকুজার নাম শুনে থাকবেন! ইয়াকুজা পৃথিবীর প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে বড় অর্গানাইজড ক্রিমিনাল গোষ্ঠী। একইসঙ্গে এদের অর্থ সম্পদের পরিমানও অন্যান্য সকল ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন থেকে বহুগুণে বেশি। জাপান তথা এশিয়ার বড় অপরাধ এবং মাদক ব্যবসার বেশিরভাগের নিয়ন্ত্রণই ইয়াকুজার হাতে। তাছাড়াও ইয়াকুজারা তাদের নৃশংস সকল কর্মকান্ডের জন্য ও কুখ্যাত। তাহলে জেনে নিন পৃথিবীর এই প্রাচীনতম অপরাধ সংঘ সম্পর্কে-

ইয়াকুজা শব্দটির অর্থ “গুড ফর নাথিং” বা “কোনো কাজেরই নয়”। এই অদ্ভুত নামের পিছনের রহস্য এখনো অজানা। এছাড়াও ইয়াকুজার উৎপত্তি সম্পর্কে সঠিক তথ্য এখনো জানা যায়নি। তবে জাপানিজ অপরাধবিদদের মতে, ইয়াকুজার জন্ম হয়েছিল ১৬০৩ সাল বা এর পূর্বে সম্রাট তকুগাওয়া শগুনাতে এর শাসন আমলে। প্রথম দিকের ইয়াকুজা কারা ছিলেন এ নিয়ে অনেক মতবাদই রয়েছে। এর মধ্যে জনপ্রিয় দু’টি মতবাদ  হল তৎকালনীন প্রভুহীন সামুরাই রোনিনরা বিভিন্ন অপরাধ কর্মে যুক্ত হতে থাকে। যারা পরবর্তীতে সুসংগঠিত হয়ে ইয়াকুজা গঠন করে। আরেকটি মতবাদ হল জাপানীজ নিচু জনগোষ্ঠী “বুরাকোমিন”রা এবং জাপানের উপনিবেশ কোরিয়ানরা জাপানিজ উঁচু জাতির অত্যাচার সহ্য না করতে পেরে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিষোধে লিপ্ত হয় যা পরবর্তীতে অপরাধীতে এবং অপরাধ সংঘে পরিণত হয়।

ধারনা করা হয়, ১৬০০ সাল থেকে ১৮৬৪ সালের মধ্যে ইয়াকুজারা বিকাশ লাভ করে এবং পরিপূর্ণ একটি অপরাধী সংঘে পরিণত হয়। তবে প্রথম দিকে ইয়াকুজার দু’টি ভাগ ছিল। “তাকিয়া” এবং “বাকিতো”। তাকিয়ারা মূলত চোরাচালান, অবৈধ অস্ত্র, হত্যা ,চাদাবাজী,মানব পাচার এসকল অপরাধ করে অর্থ উপার্জন করত। তাকিয়াদের ইয়াকুজা বস এবং আন্ডারবসরা নিয়ন্ত্রন করত। অপরদিকে বাকিতোরা জাপানে অবৈধ জুয়া ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত। যারা পরবর্তীতে লোন ব্যবসা এবং দেহব্যবসা নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। এভাবেই ইয়াকুজা এবং তাদের অপরাধ কর্ম বৃদ্ধি পেতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জাপানিজ ভাঙ্গা অর্থনীতির সুযোগ নিয়ে ইয়াকুজা বসরা তাদের সংঘ আরো বৃদ্ধি করে। যা বর্তমানে ২৫০০ ইয়াকুজা পরিবার তথা ১ লক্ষাধিক সদস্যে পরিণত হয় এবং এই সকল পরিবারের মিলিত বাৎসরিক আয় ১ দশমিক ৩ ত্রিলিয়ন জাপানিজ ইয়েন বা ১০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু প্রায় ৪০০ বছর ধরে জাপানিজ কঠিন আইনের বিরুদ্ধে কিভাবে টিকে ছিল ইয়াকুজা?

অন্যান্য অপরাধ সংঘের মত ইয়াকুজারাও কঠিন নিয়মতন্ত্রের মধ্য দিয়ে নিজেদের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এদের নিজেদের আলাদা আইন কানুন রয়েছে। তাছাড়াও কেউ যদি পরিবারের কথা বাইরের মানুষের কাছে তথা পুলিশের কাছে স্বীকার করে তবে তাদেরকে আংগুল তথা জিহ্বা কেটে শাস্তি দেয়ার বিধান রয়েছে। এছাড়াও ইয়াকুজা পরিবারগুলোর জাপানিজ অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এসকল অপরাধ পরিবারগুলো সম্মুক্ষে কন্সট্রাকশন, এক্সপোর্ট ইমপোর্ট তথা আরো অনেক বড় ব্যবসা করে থাকে। সরকারি বিভিন্ন বড় কন্ট্র্যাক্টও এরাই বলপূর্বক সম্পাদন করে থাকে। জাপানিজ সরকার তথা রাজনিতীবিদরা বিভিন্ন ঘৃণ্য কাজ ইয়াকুজা দিয়ে করিয়ে থাকে।

এমনই এক কাজ ছিল ফুকোশিমা পারমানবিক দূর্ঘটনার পরে বাস্তুহারা জনগোষ্ঠী দিয়ে পারমানবিক বর্জ্য সরানোর কাজ করানো। যা সরাসরি ইয়াকুজার নিয়ন্ত্রণে হয়েছিল এবং জাপানিজ সরকারকে আন্তর্জাতিক মহলে এর জন্য নিন্দিত হয়। এছাড়াও জাপানের সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকদেরকে ব্লাকমেইল করে এবং ঘুষ দিয়ে ইয়াকুজারা নিজেদেরকে আইনের ছোয়া থেকে দূরে রাখে। তবে ২০০৯ সাল থেকে জাপানিজ সরকার ইয়াকুজা নির্মুলের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এরপর থেকে নানান বড় ইয়াকুজা বসকে জেল খাটতে হয়েছে। তাছাড়াও জাপানিজ নতুন আইন অনুয়াযী জুয়া খেলা জাপানে ৫ বছরের মধ্যেই বৈধ করা হবে। যা ইয়াকুজাদের জন্য একটি বড় মাথা ব্যথার কারণ হবে। তবে ইয়াকুজা এতটাই বড় এবং জাপানিজ সংস্কৃতির সঙ্গে এতটাই যুক্ত যে একে পুরোপুরি নির্মূল সম্ভব নয়।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)