ছুতোর থেকে খেলনা কোম্পানির মালিক

লেগো টয় নামক বিশেষ ধরণের এক খেলনা দিয়ে বাচ্চারা হরহামেশাই খেলে থাকে। লেগো টয় বর্তমান হালের খেলনাগুলোর মধ্যে অন্যতম। ছোট ছোট বিভিন্ন রঙ্গের প্লাস্টিকের ব্লক একটির সঙ্গে অন্যটি জুড়ে সুন্দর দালানকোঠা বা অবকাঠামো তৈরির এ খেলা হয়্তো অনেকেই খেলে থাকবেন। তো কীভাবে জনপ্রিয়তা পেলো এ লেগো টয়? লেগো এনিমেশনের যাত্রাই বা শুরু হলো কীভাবে? এসবের একটি ছোট্ট সুন্দর ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা থাকবে আজ-

লেগো টয়ের যাত্রা শুরু হয় ওলে কার্ক ক্রিশ্চিয়ানসেন নামের এক ড্যানিশ ভদ্রলোকের হাত ধরে। কার্ক পেশায় ছিলেন একজন ছুতোর। ডেনমার্কের বিলান্ড শহরে ছিলো তার বসবাস। বাচ্চাদের জন্য কাঠের খেলনা বানিয়ে বিক্রি করতেন তিনি। কার্কের কাজে সহায়তা করত তার ছেলে গটফ্রিড। গত শতাব্দীর তৃতীয় দশক শুরু হয়েছে কেবল তখন। ব্যবসা পত্র কিছু ভালো চলছে না কার্কের। বিশ্বজুড়ে তখন চলছে মহামন্দা। পুঁজিবাদের উত্থানের ফলে সারা পৃথিবীতে শুরু হয়ে গিয়েছে ব্যবসা সংকট। অর্থনীতির অবস্থা দিন দিন শোচনীয় আকার ধারণ করছে। এর মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্য ভালো হবেই বা কী করে!

এরই মধ্যে ১৯৩৪ সালে কার্ক তার কোম্পানি গড়ে তুললেন। দু’টি ড্যানিশ শব্দ “লেগ” (খেলো) এবং “গট” (ভালো) কে একসঙ্গে জুড়ে দিয়ে তিনি তার কোম্পানির নাম রাখলেন “লেগো”। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ডেনমার্কে প্লাস্টিক বেশ সহজলভ্য হয়ে গেলো। এই সুযোগে ১৯৪৭ সালে লেগো কোম্পানি একটি প্লাস্টিক ইনজেকশন মোল্ডিং মেশিন কিনে ফেলে। এ সময় হিলারি পেইড নামের একজন ব্যক্তি ইন্টারলকিং প্লাস্টিক ব্রিকের ছিমছাম ডিজাইন তৈরি করেন। কার্ক ও গটফ্রিড সেগুলোর কিছু স্যাম্পল সংগ্রহ করলেন। তারা হিলারির ডিজাইনের আরো উন্নতিসাধন করলেন যাতে প্লাস্টিকের ইটগুলো একটিকে অন্যটির সঙ্গে আরো শক্তভাবে জুড়ে দেয়া যায়। তারা এর নাম দেন অটোমেটিক বাইন্ডিং ব্রিক।

শুরুর দিকে প্লাস্টিকের খেলনা ইটের বেচা-বিক্রি তেমন ভালো চলছিলো না, কারণ ক্রেতারা আগের মতো কাঠের খেলনাতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত। কিন্তু কার্ক জানতেন এ অবস্থা খুব দ্রুত পরিবর্তন হতে চলছে। ১৯৫০ সালে বাবার কাছ থেকে লেগো কোম্পানির সমস্ত দায়িত্ব বুঝে পান গটফ্রিড ক্রিশ্চিয়ানসেন। ১৯৫৪ সালে এক ক্রেতার সঙ্গে বৈঠকের পর গটফ্রিড গড়ে তোলেন লেগো সিস্টেম নামক এক আইডিয়া। খেলার মাধ্যমে শেখা ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতেই এ সিস্টেম নিয়ে আসেন তিনি। ১৯৫৫ সালে লেগো কোম্পানি  নিয়ে আসে টাউন প্ল্যান সেট নামের একটি খেলনা, যার মাধ্যমে বাচ্চারে নিজেদের কল্পনার শহর বানাতে পারবে লেগো ব্রিক ব্যবহার করে।

লেগো সিস্টেমের এই উদ্ভাবনের কারণে সারা বিশ্বে দিন দিন লেগোর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। ১৯৫৮ সালে গটফ্রিড তৈরি করেন অনন্য সাধারণ ইন্টারলকিং লেগো ব্রিক, যা লেগো টয়ের যুগান্তকারী উন্নয়ন সাধন করে। এই মৌলিক ডিজাইন এখনো পর্যন্ত লেগো টয়ের সঙ্গে সামাঞ্জস্যপূর্ণ। সে বছরই ১১ মার্চ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান কার্ক। ১৯৬১ সালে লেগো তাদের টয় সেটগুলোতে চাকার সংযোগ ঘটায়, যার মাধ্যমে বাচ্চারা বিভিন্ন রকম গাড়ির ডিজাইন তৈরির সুযোগ পায়। ১৯৬৪ সাল থেকে লেগোর খেলনায় যুক্ত হয় ইন্সট্রাকশন ম্যানুয়েল। ১৯৬৮ সালের ৭ জুন ডেনমার্কের বিলান্ডে সর্বপ্রথম লেগোল্যান্ড পার্কের উদ্বোধন করা হয়। ১৯৬৯ সালে একেবারেই ছোট বাচ্চাদের জন্য “ডুপ্লো” নামের এক বিশেষ লেগো সিস্টেম অবমুক্ত করা হয়।

আজকের দিনে ব্যাটম্যান, স্টার ওয়্যার, হ্যারি পটারসহ বিভিন্ন সিনেমা, ভিডিও গেম ও বই সিরিজের চরিত্রগুলোর উপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা লেগো টয় বাজারে পাওয়া যায়। সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলনাগুলোর তালিকায় এখন লেগো অন্যতম। ২০১৪ সালে লেগো সিস্টেমের খেলনাগুলোর আদলে বিভিন্ন চলচ্চিত্র তৈরির উদ্দেশ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করে `দ্য লেগো মুভি’। এই ফিল্ম ফ্র্যাঞ্চাইজের তিনটি সিনেমা ইতোমধ্যেই মুক্তি পেয়েছে, আরো তিনটি আছে মুক্তির অপেক্ষায়। এ ছাড়াও তারা বানিয়েছে বেশ কিছু ভিডিও গেম। আমার মতো আপনারাও নিশ্চয় `দ্য লেগো ব্যাটম্যান’ মুভির ভক্ত !

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)