কেন মানুষ ‍মিথ্যে বলে?

হুট করে আপনাকে কেউ মিথ্যুক বলে বসলে আপনি মেনে নিতে পারবেন? পারবেন না, পারার কথাও নয়। মিথ্যাবাদী পরিচয়টি আমরা কেউই ধারণ করতে চাই না। আমরা সত্যবাদী আর মহৎ হতে চাই। কিন্তু তারপরেও প্রতিদিন কিছু মিথ্যা আমাদেরকে বলতেই হয়।

আমরা যে ইচ্ছে করেই সবসময় মিথ্যা বলি, তা নয়। কখনো ভুলে মিথ্যা বলি, কখনো অনিচ্ছা সত্ত্বে মিথ্যা বলি। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে, পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে মিথ্যা বলতে হয়। এক কথায়, আমাদের জীবনের যাবতীয় ঝামেলা থেকে তাৎক্ষণিক ও সহজে মুক্তি পাওয়ার জন্যে আমরা মিথ্যা বলে ফেলি।

মিথ্যার কারণ

কখন, কার সঙ্গে, কেন এবং কিভাবে মিথ্যা কথা বলেছি, তা ভাবলেই আমরা আমাদের মিথ্যা বলার কারণ জানতে পারবো। অনেকে মিথ্যা বলে নিজেকে খুব চালাক ভাবেন। মিথ্যা বলে অন্যকে ঠকাতে পারলে এক ধরনের আনন্দ ও তৃপ্তি পান। এক্ষেত্রে বলা যায় মিথ্যা বলা এক ধরনের মানসিক সমস্যা। অবচেতন মনেই মিথ্যাটা বার বার চলে আসে।

পারিবারিক বা সামাজিক কারণে ছোটবেলা থেকেই মনের অজান্তে মিথ্যা বলার বদ অভ্যাস গড়ে ওঠে। প্রিয়জন বা আপনজনদের কাছে নিজেকে অনেক যোগ্য, দক্ষ, স্মার্ট, সৎ ও ভালো হিসাবে প্রকাশ করার জন্যে আমরা মিথ্যা বলি।

অন্যের সাথে তুলনা করার পর যদি নিজেকে ছোট মনে হয়, তখন নিজেকে বড় হিসাবে উপস্থাপন করার জন্যে আমরা মিথ্যা বলি। অর্থাৎ, নিজের হীনমন্যতাকে চাপা দেওয়ার জন্যে মিথ্যা কথা বলার প্রয়োজন হয়।

যেকোনো ধরনের দায়িত্ব বা ঝামেলাকে সহজে এড়িয়ে যাবার জন্যে আমরা মিথ্যা বলি। আবার কোনো কিছু সহজে পাওয়ার জন্যেও আমাদের মিথ্যা বলতে হয়।

কখনো কখনো কাউকে খুশি করতে মিথ্যা বলি যাতে সে আমাকে আরো পছন্দ করে , কখনো কোনো গোপন কথা জমা রাখতে মিথ্যা বলি , আবার কখনো কোনো সম্পর্ক সহজ করতে মিথ্যা বলি হয়তো বা অজান্তেই|

আবার নিজেরা কখনো ভ্রান্তি নিয়ে থাকি যে ছোট্ট মিথ্যা বলে অনেক কিছু থেকে পার পেয়ে যাবো, বিস্তারিত বলার চাপ থেকে মুক্তি পাবো, ভবিষ্যতে কি হবে দেখা যাবে| কখনো বা কোনো পরিণাম থেকে পালাতে শুকনো মুখে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ফেলি।

কেউ যদি সত্যিই মিথ্যা কথা বলা ছাড়তে চায়, তাহলে প্রথমে নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত, কেন তিনি মিথ্যা কথা বলেন? কেউ যদি তাঁর মিথ্যা কথা বলার সঠিক কারণটি খুঁজে বের করতে পারেন, তাহলে মিথ্যা বলার আসক্তি বা বদ অভ্যাস থেকে অর্ধেক মুক্তি পাওয়া যায়।

আমরা সকলেই প্রায়দিনই কিছু না কিছু মিথ্যা কথা বলে থাকি | এরকম করার কি কারণ থাকতে পারে বলে মনে হয় ? সব মিথ্যা কথা গুলোতেই যে অন্যের ক্ষতি হয় তা নয় তবুও যেন মিথ্যা বলার অভ্যাস ছাড়তে পারি না|

আসলে সব মিথ্যা বলার পিছনে আমাদের একটা জিনিসই তাড়া করে বেড়ায় আর সেটা হলো ভয় , তা সে নিজেকে হোক বা অন্য কাউকে বা অন্য কিছুকে| তবে নিজেকেই নিজের যথেষ্ট না ভেবে ,মিথ্যাকে বন্ধু করে জীবনে লড়ে যাওয়া একটা মস্ত ভুল ,তাই নয় কি ??

মিথ্যা মানেই নিজের ক্ষতি

মিথ্যা কথা বলা মানে, নিজের সঙ্গেই বৈপরীত্য সৃষ্টি করা। যখন আমাদের মুখে এক কথা থাকে, আর মনে অন্য কথা থাকে, তখন মন ও শরীরের মাঝে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। মিথ্যা কথা বলতে বলতে একসময় মন দ্বারা আমাদের শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। দেখা যায় তখন শরীর আমাদের মনের কথা শোনে না। ফলে, প্রতিদিন কাজকর্মে মানুষের ভুলের পরিমাণ বাড়তে থাকে, এবং মানুষ নিজের অজান্তেই নিজের উপর হতাশ হতে থাকে। এভাবে হতাশা একসময় মানুষকে অসহ্য যন্ত্রণা বা আত্মঘাতি মনোভাবের দিকেও নিয়ে যেতে পারে।

মিথ্যা থেকে বাঁচতে

আমরা সব মানুষের সঙ্গে সবখানে মিথ্যা বলি না। কিছু নির্দিষ্ট মানুষের সঙ্গে বা কিছু নির্দিষ্ট স্থানে, কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতির স্বীকার হলেই কেবল আমরা মিথ্যার আশ্রয় নিই।

মিথ্যা বলা থেকে মুক্তি পেতে চাইলে ঐ মানুষকে চিহ্নিত করুন যাদের সঙ্গে আমরা বেশি মিথ্যা বলি। এই যেমন অফিসের বস, অথবা সঙ্গী বা বন্ধুর সঙ্গে বেশি মিথ্যা কথা বলা হয়। তাদের যত মিথ্যা বলা হয়েছে তা স্মরণ করুন। সবচেয়ে ছোট মিথ্যাটি ছিলো খুঁজে বের করুন। এরপর তাদের কাছে সবচেয়ে ছোট মিথ্যা কথাটি স্বীকার করে দেখুন একবার। এভাবে আস্তে আস্তে ছোট থেকে বড় মিথ্যা কথাগুলো স্বীকার করতে থাকবেন, মিথ্যা এড়িয়ে যেতে থাকবেন। দেখবেন মিথ্যার অভ্যাস চলে গেছে।

তাছাড়া, কিছু মানুষ আমাদের এমনভাবে প্রশ্ন করে, বাধ্য হয়েই মিথ্যা বলতে হয়। সত্য বললে কষ্ট পেতে পারেন। তখন প্রশ্নকারীকে কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ থাকাই ভালো। অথবা প্রশ্নকারীর কাছ থেকে সময় নিয়ে পরবর্তীতে উত্তর দিন। নাহলে ভেবেচিন্তে এমন কথা বলা উচিত যা মিথ্যাও হবে না, আবার প্রশ্নকারী মনেও কষ্ট পাবেন না।

মজা করে হোক বা ঝামেলা থেকে মুক্তির জন্যে হলেও মিথ্যা বলাটা বদঅভ্যাস। মিথ্যা বলে মানুষ নিজেরই ক্ষতি করে। সত্য বলার অভ্যাস করতে হলে স্মার্ট হতে হয়। একজন মানুষ যত বেশি নিজের হীনমন্যতা দূর করতে পারেন, তিনি তত বেশি সত্য কথা বলতে পারেন। সত্য হলো সুখের মূলমন্ত্র, আর মিথ্যা হলো যন্ত্রণা ও হতাশার কারণ। তাই আর মিথ্যা নয়।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)