গুগল-ফেসবুক জয় করলো বাংলাদেশি তরুণ

বাংলাদেশের কাইদুল ইসলাম পৌঁছে গিয়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান, গুগলে! খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শিক্ষার্থী হিসেবে গুগলে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন এই তরুণ।

কাইদুলের এই যাত্রা এতটা সহজ ছিলো না। ২০১০ সালে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শুরু হয় কাইদুলের জীবনের এক নতুন অধ্যায়। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় বাবাকে আর্থিক সহযোগিতা করার জন্য টিউশনি করানো শুরু করেন কাইদুল। খুব অল্প সময়েই মধ্যেই বেশ সুনাম অর্জন করেন তিনি। কিন্তু কয়েক মাস পর টিউশনি করানোতে এক ধরণের একঘেয়েমিতা অনুভব করেন তিনি। উপলব্ধি করেন টিউশনির মাধ্যমে মাস শেষে পকেটে হাতখরচ আসলেও, তাতে তার কোনো দক্ষতা বৃদ্ধি হচ্ছে না। এই বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে কাইদুলকে। পড়াশুনার পাশাপাশি তিনি উপার্জনের এমন একটি পথ খুঁজতে শুরু করেন, যেখানে টাকার পাশাপাশি বৃদ্ধি পাবে তার দক্ষতা, প্রতিনিয়ত তিনি শিখতে পারবেন অজানা অনেক বিষয়। অবশেষে কাইদুল খুঁজে পান তার কাঙ্ক্ষিত পথ। টিউশনি ছেড়ে শুরু করেন ফ্রিল্যান্সিং! ওয়েব ও এন্ড্রোয়েড ডেভেলপমেন্টের বিভিন্ন ছোট ও মাঝারি আকারের প্রজেক্ট করে অর্থের পাশাপাশি বাড়াতে থাকেন তার দক্ষতা।

দ্বিতীয় বর্ষে কাইদুল জানতে পারেন, গুগল থেকে একটি একটি দল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছে তাদের ক্যাম্পাসে পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাবী শিক্ষার্থীদের খুঁজে বের করতে। ঠিক তখন থেকেই গুগলের প্রতি এক ধরণের কৌতুহল অনুভব করেন কাইদুল। প্রশ্ন করেন নিজেকে- বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই প্রতিষ্ঠানটিতে কারা কারা চাকরি করেন? বাংলাদেশ থেকেই বা ক’জন চাকরি করছেন সেখানে? কী কী জানলে এই প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাওয়া সম্ভব? নিজের মধ্যে জন্ম নেয়া এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কাইদুল আশ্রয় নেন ইন্টারনেটের। জানতে পারেন অ্যালগরিদম, ডাটা স্ট্রাকচার ও প্রব্লেম সলভিং এ ভালো হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু ফ্রিল্যান্সিং এর পথটা ছিল এসবের থেকে একটু আলাদা। কাইদুল বুঝতে পারলেন, তিনি যে পথ ধরে হাঁটছেন তার শেষটা হয়তো মিলবে না তার স্বপ্নের পথে। তাই তিনি ফ্রিল্যান্সিং করার হার কমিয়ে হাঁটতে থাকেন নতুন এক স্বপ্নের পথে। শুরু করেন প্রব্লেম সলভিং এর চর্চা।

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৪ সালে সিজিপিএ ৩.২৫ নিয়ে অনার্স সম্পন্ন করেন কাইদুল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেনি কাইদুলের গণ্ডি। বরং নিজের চেষ্টা, পরিশ্রম ও মেধা দিয়ে তিনি বিস্তৃত করেছেন তার জানার পরিধি।

কাইদুলের চাকরি জীবন শুরু হয় কানাডা ভিত্তিক ভিওআইপি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান আইবল নেটওয়ার্কসে। সেখানে সহকর্মী হিসেবে পাশে পান এসিএম ইন্টারন্যাশনাল কলেজিয়েট প্রোগ্রামিং কন্টেস্টের (২০১২, ২০১৩) বিজয়ী মাকসুদ হোসাইনকে। মাকসুদের সঙ্গে কাইদুলের আড্ডার বড় একটা অংশ জুড়ে থাকতো বিগ ফোর (গুগল, ফেসবুক, মাইক্রোসফট ও অ্যামাজন)। তখন থেকেই কাইদুলের মনে বাসা বাঁধতে শুরু করে এক নতুন স্বপ্ন- যে করেই হোক, বিগ ফোরের একটিতে পদচিহ্ন রাখা চাই-ই চাই।

বিগ ফোরের জন্য কাইদুল টপকোডার, হ্যাকারর‍্যাঙ্ক, কোডশেফ, লিটকোডসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইটের প্রোগ্রামিং প্রব্লেম সলভ করতে শুরু করেন। বিভিন্ন অনলাইন প্রোগ্রামিং কন্টেস্টে অংশগ্রহণের পাশাপাশি বিশ্বের বড় বড় সফটওয়্যার প্লাটফর্মগুলো কীভাবে পরিচালিত হয়, সে সম্পর্কে পড়াশুনা করতে শুরু করেন তিনি।

২০১৫ সালে কাইদুলের লিংকড-ইন প্রোফাইল নজর কাড়ে গুগল, লন্ডন অফিসের একজন রিক্রুটারের। তিনি তাকে গুগলে আবেদন করার পরামর্শ দেন। গুগলে আবেদন করেন কাইদুল। প্রাথমিক পর্যায়ের ফোন ইন্টারভিউয়ে সফলভাবে উত্তীর্ণ হলে অন-সাইট ইন্টারভিউয়ের জন্য তাকে ডাকা হয় গুগলের লন্ডন অফিসে। কিন্তু ভিসাজনিত সমস্যার কারণে আর লন্ডন যাওয়া হয়ে ওঠে না কাইদুলের। যেনো স্বপ্নের অনেক কাছে এসেও তা হাতছাড়া হয়ে যায়।

এরপর ২০১৬ সালে ওরাকলে আবেদন করেন কাইদুল। সবগুলো ইন্টারভিউ বেশ ভালোভাবে সম্পন্ন করলেও শেষে গিয়ে চাকরির অভিজ্ঞতা কম থাকায় ওরাকল থেকে খালি হাতে ফিরতে হয় কাইদুলকে। কিন্তু হতাশ হয়ে থেমে থাকেননি কাইদুল। বরং আগের তুলনায় দ্বিগুণ জেদ নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন আগামীর জন্য। এরপর ২০১৭ সালের জুলাই মাসে আমাজন থেকে একজন রিক্রুটার খুঁজে পান কাইদুলকে। তিনি তাকে চাকরির আবেদন করার পরামর্শ দিলে সেখানেও আবেদন করেন কাইদুল। কিন্তু এবারেও একেবারে শেষ পর্যায়ে গিয়ে বাদ পড়তে হয় কাইদুলকে। একই বছরের নভেম্বর মাসে কাইদুল আবেদন করেন ফেসবুকের সিঙ্গাপুর অফিসে। কিন্তু এখানেও শেষ পর্যন্ত মিলেনি কোন ইতিবাচক উত্তর। ২০১৮ সালে ফেসবুকের লন্ডন অফিস থেকে একজন রিক্রুটারের বার্তা পান কাইদুল। রিক্রুটারের কথামতো আবেদন করেন ফেসবুকের লন্ডন অফিসে। কিন্তু বাছাই পর্যায়ের এক পর্যায়ে এসে হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায় তাদের রিক্রুটমেন্ট প্রসেস।

বারবার সম্মুখীন হওয়া ব্যর্থতা থেকে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকেন কাইদুল। সঙ্গে নিজের ভেতরে জন্ম নেয়া পরাজয়বোধ যেনো রুপ নিতে শুরু করে জেদে। ফলস্বরূপ পূর্বের তুলনায় পড়াশুনা আরো বাড়িয়ে দেন কাইদুল। সময় বাঁচানোর জন্য নিজে রান্না করা বন্ধ করে খেতে শুরু করেন রেস্টুরেন্টের খাবার। কাইদুল তখন কর্মরত উবারের প্রতিদ্বন্দ্বী বিখ্যাত রাইড হেইলিং জার্মান-মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘কারিম’ এ। চাকরির পাশাপাশি সমানতালে চলতে থাকে পড়াশুনা ও প্রোগ্রামিং প্রব্লেম সলভিং এর চর্চা।

এরপর ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে আবার গুগলে আবেদন করেন কাইদুল। তবে এবারের আবেদনটা ছিল আগেরগুলোর চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। এবারের প্রস্তুতি গ্রহণটা ছিল একেবারে তার মনের মতো। তাই তার আত্মবিশ্বাসও বেড়ে গিয়েছিল আগের তুলনায় অনেক বেশি। গুগলের স্যান ফ্রান্সিসকো ও ইসরাইল অফিসে পরপর দুইটি ফোন ইন্টারভিউ শেষে পাঁচটি অন-সাইট ইন্টারভিউ সম্পন্ন হয় সুইজারল্যান্ডে। ইন্টারভিউয়ের সবগুলো ধাপ সফলভাবে সম্পন্ন করার পর কাইদুল সম্মুখীন হলেন গুগলের ১০-১২ জন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে গঠিত হারায়িং কমিটির কাছে। সেখানেও সফলভাবে উত্তীর্ণ হলেন তিনি। এরপর গুগলের এক্সিকিউটিভ কমিটি কাইদুলের ফলাফল দেখে ইতিবাচক সাড়া প্রদান করলেন। অবশেষে কাইদুল পৌঁছে গেলেন তার পথচলার শেষ ঠিকানায়। ২০১৯ সালের ১৩ জানুয়ারি গুগল থেকে অফার লেটার গ্রহণ করলেন কাইদুল! দীর্ঘ একটি পথচলা শেষে কাইদুল ছুঁয়ে দেখলেন সফলতার শেষ চূঁড়া।

এদিকে ফেসবুকে আবারো চাকরির আবেদন করেছিলেন কাইদুল। জানুয়ারির ২৫ তারিখে মিললো তার ফলাফল। ফেসবুকের সিঙ্গাপুর অফিস থেকে তাকে নিশ্চিত করা হয় তার চাকরির ব্যাপারে। তবে পরবর্তী চাকরির প্রতিষ্ঠান হিসেবে গুগলকেই বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন কাইদুল। চলতি বছরের এপ্রিল গুগলের জুরিখ অফিসে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগদান করবেন কাইদুল।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)