রক্তের গ্রুপ ভিন্ন হয় কেন?

কালো আর ধলো বাহিরে কেবল, ভেতরে সবাই সমান রাঙা- বিখ্যাত এই উক্তিটি মানুষের ভেদাভেদ ঘুচিয়ে দেয়! কিন্তু কালো, সাদা, গরিব, ধনী সব শ্রেণীর মানুষের ধমনীতে যে এই একই লাল রক্ত বইছে।

আণুবীক্ষণিক দিক থেকে কিন্তু এতে রয়েছ যথেষ্ট ভিন্নতা। মানুষের রক্তে রয়েছে আটটি ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ। এক গ্রুপের রক্তের সঙ্গে অন্য গ্রুপের রক্ত মেশানো খুবই বিপজ্জনক। ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বহু মানুষ মৃত্যুবরণ করেন শুধুমাত্র ভিন্ন গ্রুপের রক্ত শরীরে প্রবেশ করানোর জন্য। কারণ, রক্তের গ্রুপিং আবিষ্কৃতই যে হয়েছে ১১৬ বছর আগে। এর আগে চিকিৎসকদের কোনো ধারণা ছিলো না যে একই গ্রুপের ব্যক্তি একজন আরেকজনকে রক্ত দিতে পারে! রক্তের গ্রুপ সম্পর্কিত কিছু তথ্য জেনে নিন-

1.রক্তের গ্রুপ ভিন্ন হয় কেন?

মানুষের রক্তের গ্রুপ কোনটি হবে তা নির্ধারণ করে প্রত্যেকের রক্তের লোহিত রক্তকণিকা বা রেড ব্লাড সেলের প্রাচীরে থাকা এন্টিজেন নামক এক ধরণের প্রোটিন। উদাহরণস্বরূ, টাইপ ‘এ’ রক্তে থাকে টাইপ ‘এ’ এন্টিজেন, অন্যদিকে টাইপ ‘বি’ রক্তের লোহিত রক্ত কণিকা বহন করে টাইপ ‘বি’ এন্টিজেন। এখন এই দুই টাইপের রক্ত যদি একই ব্যক্তির দেহে মিশ্রিত হয়, একে অন্যের বিরুদ্ধে রীতিমত বিদ্রোহ ঘোষণা করে! রক্তের প্লাজমা বা রক্তরসে থাকে নানা ধরনের অ্যান্টিবডি, যাদের কাজ হলো দেহের সঙ্গে সামাঞ্জস্যপূর্ণ নয় এমন সব রাসায়নিক প্রবেশে বাঁধা দেয়া। এমনকি যেসব এন্টিজেন আমাদের দেহের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এন্টিবডিগুলোর কাজ হচ্ছে সেগুলোকে ধ্বংস করে দেয়া। বিপত্তিটা মূলত এখানেই। যখন ভুল এন্টিজেনবাহী রক্ত মানবদেহে প্রবেশ করানো হয়, রক্তের প্লাজমায় অবস্থানকারী এন্টিবডিগুলো সেই এন্টিজেনের সঙ্গে লেগে যায়, রক্তকে জমাট বাঁধিয়ে ফেলে। ফলে, রক্তনালী দিয়ে রক্ত প্রবাহ ব্যহত হয়, যেটি একটি ভয়াবহ ঝুঁকির ব্যাপার। ভুল গ্রুপের সামান্য কয়েক মিলিলিটার রক্তই সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। এ কারণে যার যার নিজের রক্তের গ্রুপ জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

2.রক্তের গ্রুপ ভিন্ন হয় কেন?

বিশ্বজুড়ে ব্লাড গ্রুপিংয়ের মোট ৩৫ টি পন্থা প্রচলিত আছে, তবে সাধারণত ‘এবিও’ এবং ‘আরএইচ’; এই দু’ধরণের গ্রুপিং এর মাধ্যমেই মোটামুটি সব মানুষের রক্তের প্রকৃতি নির্ণয় করা সম্ভব। সাধারণত পজিটিভ, নেগেটিভ মিলিয়ে এ, বি, ও, এবি- মোট আট ধরণের রক্তের গ্রুপ পাওয়া যায়। তবে আপনি যদি এ পজিটিভ বা ও পজিটিভ রক্তবাহী হয়ে থাকেন, আপনার জন্য সুসংবাদ। জরুরি প্রয়োজনে এই দুই গ্রুপের রক্তবাহীদের জন্য রক্ত জোগাড় করা সবচেয়ে সহজ। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মোটামুটি ৬৫ শতাংশের ব্লাড গ্রুপ হয় এ পজিটিভ নয়তো ও পজিটিভ!

জানেন কী? অঞ্চলভিত্তিক রক্তের গ্রুপের বেশ সাদৃশ্য দেখা যায়। যেমন, পৃথিবীর পশ্চিম গোলার্ধের বসবাসরত লোকজনের অধিকাংশই ‘ও’ গ্রুপযুক্ত রক্তের বাহক। অন্যদিকে, পূর্ব গোলার্ধে ‘এ’ ও ‘বি’ গ্রুপবাহী রক্তের মানুষ পাওয়া খুবই সাধারণ ব্যাপার। ভারতীয় উপমাহাদেশে ‘বি’ পজিটিভ গ্রুপের রক্ত বহনকারী মানুষের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় চার গুণ! আবার নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত বেশ দূর্লভ। উদাহরণস্বরূপ, এবি নেগেটিভ রক্তবাহী মানুষের মোট সংখ্যা সমগ্র পৃথিবীর জনসংখ্যার মাত্র দুই শতাংশ!

3.রক্তের গ্রুপ ভিন্ন হয় কেন?

রক্তের গ্রুপের এত বিভাজনের কারণ এবং কোথা থেকে এর উৎপত্তি; বিজ্ঞানীরা সে প্রশ্নের উত্তর এখনো খুঁজে যাচ্ছেন। শুধুমাত্র মানুষের ক্ষেত্রেই যে রক্তের গ্রুপের এই ভিন্নতা দেখা যায়, তা কিন্তু নয়। অন্যান্য প্রাণীর রক্তেও ভিন্ন ভিন্ন রক্তের গ্রুপ দেখা যেতে পারে। তবে মানুষের থেকে প্রাণীদের রক্তের গ্রুপের প্রকারভেদ বেশ ভিন্ন, তাই মানুষের দেহে অন্যান্য প্রাণীদের রক্ত প্রবেশের চিন্তা অমূলক।

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, বিভিন্ন রোগ ব্যাধির বিরুদ্ধে আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষা ক্ষমতার উপরে রক্তের গ্রুপ এর প্রভাব অনেক। যেমন, ‘এ’ গ্রুপবাহী মানুষদের অন্যান্য গ্রুপের তুলনায় অগ্ন্যাশয় ক্যান্সার ও লিউকেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আবার ‘ও’ গ্রুপবাহীদের আলসারের ঝুঁকি অনেক বেশি। তবে যাই হোক না কেন, রক্তের গ্রুপের প্রকৃত রহস্য উন্মোচনে আরো বিস্তর গবেষণা হচ্ছে, যা জানার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরো বেশ কিছুদিন।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)