প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মহীয়সী নারীদের কথা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নারীরা শুধুমাত্র ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যেই বন্দি ছিলেন না৷ পুরুষদের মতো অনেক নারীও রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা৷

পুরুষদের মতো নারীদের ভূমিকাও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম বৈশিষ্ট৷ ১৯১৪ সালে যুদ্ধ শুরু হবার সাথে সাথে তখনকার নারীদের অনেকেই পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পালন করেন অনন্য ভূমিকা৷

মাঠে-ঘাটে সমানতালে

কৃষি, প্রযুক্তি, বিজ্ঞানসহ অনেক ক্ষেত্রেই নারীদের সপ্রতিভ অংশগ্রহণ সমাজের চিত্রকে খুব দ্রুত বদলে দিচ্ছিলো, জানান ইতিহাসবিদ মাইকেল হাওয়ার্ড৷ আরেক ইতিহাসবিদ বেনজামিন জিমানের কথায়, জার্মানির বাভারিয়া অঞ্চলের ৪৪ শতাংশ খামার তখন নারীরাই চালাতেন এবং প্রয়োজনে ঘোড়ার বদলে নিজেরা হাল টানতেও পিছপা হতেন না৷ ১৯১৫ সাল থেকেই, সমগ্র ইউরোপের শিল্প ব্যবস্থা নারীদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে৷ ফ্রান্সে যুদ্ধে প্রয়োজনীয় জিনিসের কারখানাগুলিতে চার লক্ষেরও বেশি নারী নিযুক্ত ছিলেন৷ ১৯১৭ সালের শেষের দিকে যুদ্ধ যখন মধ্যগগনে, ইংল্যান্ডের কর্মীসংখ্যার অর্ধেক কর্মী ছিলেন নারী, যাঁদের মধ্যে অন্তত লক্ষাধিক ছিলেন কোনো-না-কোনোভাবে যু্দ্ধশিল্পে নিয়োজিত৷

১৯১৮ সালে যুদ্ধ শেষ হবার পর সৈনিকেদের ঘরে ফেরা শুরু হলে চাকরি-ক্ষেত্রে তাঁদের প্রবেশ বাড়তে থাকে৷আবার ঘরের কাজে মনোনিবেশ করেন এতদিন ঘরে-বাইরে দু’দিকে হাল ধরে থাকা নারীরা৷ কিন্তু এর আগেই বেশ কয়েকটি দেশে আসে একটি যুগান্তকারী বদল৷ ১৯১৮ সালের নভেম্বর মাস থেকে জার্মানি ও ইংল্যান্ডে নারীরা ভোটের অধিকার অর্জন করে৷ অল্প দেরিতে হলেও, ১৯২০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নারীরাও এই অধিকার পান৷ যুদ্ধের আগমুহূর্ত অবধি বিভিন্ন নারীবাদী সংগঠন আন্তর্জাতিক সংহতির কথা বললেও পরে নিজের দেশে ভোটাধিকারের লড়াইয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে সংহতির দাবি তুলনামূলকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে৷ এমনই মত নারী আন্দোলনের ইতিহাসের গবেষক জশুয়া গোল্ডস্টাইনের৷

উল্লেখযোগ্য নারীরা

নার্স, রাঁধুনি বা গাড়ি-চালকের পদে নারীদের অংশগ্রহণ বেশি থাকলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নারীরা সংখ্যার হিসাবে ঘরের কাজেই বেশি নিযুক্ত ছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়৷ তবুও এমন কয়েকজন ব্যক্তিত্বের কথা বলতেই হয়, যাঁদের সাহস ও ভিন্নধর্মী চিন্তার উল্লেখ ছাড়া সেই সময়ের ইতিহাস অসম্পূর্ণ৷

মাতা হারির নাম জানেন না এমন লোক খুব কমই আছেন৷ নেদারল্যান্ডসে জন্মগ্রহণ করা এই অসামান্য সুন্দরী নারী ছিলেন একাধারে নৃত্যশিল্পী ও গুপ্তচর, যিনি পরে ফরাসি পুলিশের গুলিতে মারা যান৷ এছাড়া বিখ্যাত ব্রিটিশ নার্স ইডিথ ক্যাভেল অবশ্যই উল্লেখযোগ্য, যিনি শত্রু-মিত্র সব পক্ষকে সমানভাবে সেবা করার ‘অপরাধে’ ফায়ারিং স্কোয়াডের গুলিতে নিহত হন৷

১৯১৪ সালে বেলজিয়ামে নার্স হিসাবে কর্মরত নারীদের সম্মান জানিয়ে সাংবাদিক সারা ম্যাকনোটন একটি প্রবন্ধ লেখেন৷সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘‘মোটা বুট-ভারী প্যান্ট পরা ছোট ছোট মেয়েরা যেভাবে তখন যুদ্ধে ঘায়েল হওয়া সৈনিকদের স্ট্রেচারে তুলে সুরক্ষিত অঞ্চলে নিয়ে আসতো, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না৷ এই মেয়েদের প্রতি আমার অন্তরের শ্রদ্ধা৷”

যুদ্ধে সৈনিকদের সাথে লড়াই করা নারীদের সংখ্যা খুব কম হলেও বলতে হয় বছর কুড়ির দুঃসাহসী সাংবাদিক ডরোথি লরেন্সের কথা৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সেনার একমাত্র নারী-সৈনিক ডরোথি নিজের লিঙ্গপরিচয় গোপন রেখে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন৷ কিন্তু দশদিন পরেই নিজের পরিচয় প্রকাশ করে পদত্যাগ করেন৷

রাশিয়ার কিছু মেয়েও প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন৷ গোড়ার দিকে অন্য ছেলেদের মতো পোশাক পরে নিজেদের পুরুষ সাজিয়ে লড়তে নামলেও পরে নারী-সৈনিক হয়েই স্বদেশের জন্যে যুদ্ধ করেন৷

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অবিস্মরণীয় নারী-সৈনিকদের ইতিহাস অসম্পূর্ণ ‘ব্যাটেলিয়ন অফ ডেথ’ ছাড়া৷ ২৫ বছর বয়েসি রুশ নারী-কৃষক মারিয়া বোশকারেভার নেতৃত্বে এই ব্যাটেলিয়নের সদস্য ছিলেন কয়েকশ’ মহিলা, যাঁদের কড়া অনুশাসনের ধারা ছিল খুব বিখ্যাত৷

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)