সম্রাট বাবর এর ইতিহাস

মুঘল শাসনামল ভারতের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। মুঘল সম্রাটদের ইতিহাস সিরিজের প্রথম পর্বে সম্রাট বাবর। সুবিশাল শৌর্যবান মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বাবর। প্রখ্যাত ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী ও প্রাচ্যবিদ এডওয়ার্ড লেন পুল বলেছেন, ‘বাবর সম্ভবত প্রাচ্যের ইতিহাসের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক চরিত্র’। বাবরের আসল নাম জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ। তিনি মহান বীর সম্রাট তৈমুর লং-এর বংশধর। বাবর জাতিতে ছিলেন উজবেক। অার সে কারণে এখনো বাবরকে উজবেকিস্তান ও কিরগিজস্তানে একজন জাতীয় বীর হিসেবে স্মরণ করা হয়। আধুনিক উজবেকিস্তানের ফারগানা উপত্যকার আন্দিজানে ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্ম।

উত্তরাধিকারসূত্রে বাবর ছিলেন ফারগানা উপত্যকার ওশ রাজ্যের অধিপতি। এটি বর্তমানে আধুনিক কিরগিজস্তানের একটি অংশ। ওশ এর সুলাইমান পর্বতের চূড়ায় তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। সুউচ্চ সুলাইমান পর্বত যেন বাবরের মহত্ত্ব ঘোষণা করত সর্বদা। বাবরের পিতা ওমর শেখ মির্জা ছিলেন ফারগানা রাজ্যের গভর্নর। দ্বিগবিজয়ী মহাবীর তৈমুর দ্য গ্রেট ছিলেন তাঁর প্রপিতামহ। পিতার মৃত্যুর কারণে মাত্র ১২ বছর বয়সে বাবর ফারগানার সিংহাসনে আসীন হন। কিশোর বাবর সিংহাসনে বসার পরপরই বিদ্রোহের সম্মুখীন হন।

মাত্র ১৪ বছর বয়সে বাবর সমরকন্দ বিজয় করতে সক্ষম হন। বাবর নিজেকে তার প্রপিতামহের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে প্রমাণ করেন। কিন্তু নিয়তির পরিহাস তাঁর পিছু কখনো ছাড়েনি। সমরকন্দ জয় করতে গিয়ে তিনি ফারগানার কর্তৃত্ব হারিয়ে বসেন। আবার যখন ফারগানা পুনরাধিকার করতে রওনা দেন শত্রুপক্ষ এসে তার অনুপস্থিতিতে সমরকন্দ দখল করে নেয়। ১৫০১ সালে মুহাম্মদ শায়বানী খানের দখল থেকে সমরকন্দ ও ফারগানা মুক্ত করতে অভিযান চালিয়ে পরাজিত হন বাবর।

১৫০৪ সনে বাবর কাবুল দখল করে নেন। কাবুলের শাসনভার তখন ছিলো উলুঘ বেগের শিশু উত্তরাধিকারীর হাতে। তাই বাবরের জন্য কাজটা ছিলো তুলনামূলকভাবে সহজ। অতঃপর বাবর পারস্যের সাফাবিদ সাম্রাজ্যের সঙ্গে মৈত্রী গড়ে তোলেন ও তাদের সহযোগিতায় সমরকন্দসহ তুরকিস্তানের বেশ কিছু অংশ দখল করতে সমর্থ হন। কিন্তু শায়বানিরা আবারো তাকে আক্রমণ করে রাজ্যচ্যুত করে। তিন বার পরাজিত হয়ে বাবর সমরকন্দের আশা ছেড়ে দেন। দক্ষিণের ওপর নজর পড়ে তার।

উত্তর ভারতের ইন্দো গঙ্গা সমভূমি তখন ইব্রাহিম লোদির দখলে। ইব্রাহিম ছিলেন আফগানিস্তানের লোদি বংশের শাসক। পাঞ্জাবের শাসক ছিলেন দৌলত খান লোদি। অন্যদিকে রাজপুতনার রাজা ছিলেন মেবারের রাজপুত বংশের রানা সাঙ্গা। অনেক ঐতিহাসিকদের অভিমত এবং বাবরের স্বরচিত আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, দৌলত খান লোদি ও রানা সাঙ্গার প্ররোচণায় বাবর ইব্রাহিম লোদির দিল্লীর সিংহাসন দখলে উদ্বুদ্ধ হন। উল্লেখ্য, দৌলত খান লোদি ছিলেন নিজ বংশ থেকে বিতাড়িত, বিদ্রোহী এক যোদ্ধা। তিনি দিল্লীর মসনদে কিছুতেই ইব্রাহিম লোদিকে মেনে নিতে পারছিলেন না।

1.সম্রাট বাবর

১৫১৯ সালে বাবর চন্দ্রভাগা (পাকিস্তানে অবস্থিত) নদীর তীরে পৌঁছান। রাজ্য হারিয়ে তিনি তখন দিশেহারা। তৈমুরের সময়কালে পাঞ্জাব ছিলো তার বিশাল রাজত্বের একটি অংশ। তাই, বাবরও চাইছিলেন অন্তত পাঞ্জাবের কর্তৃত্ব নিয়ে তার প্রপিতামহের সাম্রাজ্য কিছু অংশ হলেও টিকিয়ে রাখা। তাই ১৫২৪ সাল পর্যন্ত তিনি কেবল পঞ্জাব দখলের পরিকল্পনা আঁটতেই ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু পাঞ্জাবের তৎকালীন শাসনকর্তা ও ইব্রাহীম লোদির চাচা দৌলত খান লোদির পরামর্শে বাবর দিল্লীর সিংহাসনের বিষয়ে উচ্চাভিলাষী হয়ে পড়েন। বাবর দৌলত খানের সঙ্গে মিলিত হতে পাঞ্জাব অভিমুখে অগ্রসর হন। কিন্তু গিয়ে দেখেন ইব্রাহিমের সৈন্যরা ইতোমধ্যে দৌলত খানকে বিতাড়িত করে দিয়েছে। প্রতিশোধ নিতে গিয়ে বাবর ইব্রাহিমের সৈন্যদের ছত্রভঙ্গ করে টানা দুই দিন লাহোরে অগ্নিকাণ্ড চালান, তারপর দিনালপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।

তার আগে ইব্রাহিম লোদির আরেক বিদ্রোহী চাচা আলম খানকে লাহোরের দায়িত্ব দিয়ে যান। এখানেও বাবরের জন্য অপেক্ষা করছিলো দূর্ভাগ্য। আলম খান দ্রুতই লাহোরের দখল খুঁইয়ে বসেন, পালিয়ে কাবুল চলে যান। এর জবাবে ববর আলম খানকে কাবুলে সৈন্য সরবরাহ করেন। আলম খান সেই বাহিনী নিয়ে দৌলত খানের সঙ্গে মিলিত হন। দুই বাহিনীর সম্মিলিত সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০ হাজার। বিশাল সৈন্যবহর নিয়ে তারা সহজেই ইব্রাহীম লোদিকে দিল্লীতে পরাজিত করতে সক্ষম হন। কিন্তু জয়ের পর দৌলত খান আলম খানের সেনাদের নিজ দলে ভাগিয়ে নিয়ে পাঞ্জাব ফিরে যান।

বাবর বুঝতে পারলেন তাকে পাঞ্জাব ছেড়ে দেয়ার কোনো পরিকল্পনা দৌলত খানের নেই। ১৫২৫ সালে বাবর দৌলত খানকে শায়েস্তা করার জন্য পেশোয়ার থেকে লাহোরে যুদ্ধযাত্রা করেন। বাবরের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সামনে দৌলত খান অসহায় আত্মসমর্পণ করেন ও বাবরের কাছে প্রাণভিক্ষা চান। বাবর দৌলত খানকে মাফ করে দেন। বাবর ভাবলেন, এবার ইব্রাহিম লোদির সঙ্গে সব হিসেব চুকানোর সময় এসেছে। তিনি সিরহিন্দ হয়ে দিল্লীর পথে যুদ্ধযাত্রা আরম্ভ করলেন।

২০ এপ্রিল, ১৫২৬ পানিপথে বাবরের বাহিনী ইব্রাহিম লোদির বিশাল সৈন্যদলের মুখোমুখি হলো। ঐতিহাসিকভাবে এই যুদ্ধই পানিপথের প্রথম যুদ্ধ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে। ইব্রাহিমের সৈন্যসংখ্যা ছিলো প্রায় লাখ খানেক। তার সেনাবাহিনীতে ছিলো যুদ্ধের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১০০টি হাতি। তবুও এই বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে বাবরের রণকৌশলের সামনে পরাজিত হতে হয় তাকে। বাবরের সৈন্যরা ইব্রাহিম বাহিনীকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরে। তাদের কামানের গোলায় অসহায়ভাবে প্রাণ হারায় ইব্রাহিমের সৈন্যদল, হাতিগুলো প্রচণ্ড ভয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। ইব্রাহিম লোদি যুদ্ধের ময়দানেই নিহত হন। পানিপথের প্রথম যুদ্ধ জয় করে বাবর দিল্লী ও আগ্রার সিংহাসন দখল করে নেন এবং মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

2.সম্রাট বাবর

সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর রাজপুত রাজ রানা সাঙ্গার মতো অনেক হিন্দু রাজা বাবরকে বাদশাহ হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। একজন বিদেশি হবেন হিন্দুস্তানের সম্রাট! এ ধারণার বিরোধী ছিলেন তারা। যে কারণে রানা সাঙ্গা ইব্রাহিম লোদির ঘোর বিরোধী ছিলেন, ঠিক সে কারণেই তিনি বাবরের বিরোধিতা শুরু করলেন। এর ফলে বাবর ও রানা খানওয়ার যুদ্ধে লিপ্ত হন। বাবর তার রণকৌশল বলে এ যুদ্ধেও জয় লাভ করেন। বাবর একজন কৌশলী যোদ্ধাই ছিলেন না তিনি ছিলেন একজন শক্তিশালী কবি। তার রচিত অনেক কবিতা লোকগীতিতে রূপায়ন করা হয়েছে। তুর্কি ভাষায় রচিত তার নিজের লেখা আত্মজীবনী ‘বাবরনামা’, যা পরবর্তীতে সম্রাট আকবরের সময়কালে ফারসি ভাষায় অনুবাদ করা হয়।

১৫৩০ সালে বাবর মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে মুঘল সাম্রাজ্যের অধিপতি হন বাদশাহ হুমায়ূন। তার ইচ্ছা অনুযায়ী মৃত্যুর পর তাকে কাবুল এর ‘বাগ-ই-বাবর’-এ সমাহিত করা হয়।

বাবর বেশ কয়েকজন নারীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার প্রথম স্ত্রী ছিলেন আয়শা সুলতান বেগম। সম্পর্কে তারা ছিলেন চাচাতো ভাইবোন। তার পুত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন হুমায়ূন, কামরান মির্জা ও হিন্দাল মির্জা। হুমায়ূন ছিলেন সম্রাট বাবর ও মাহাম বেগমের চার সন্তানের একমাত্র জীবিত সন্তান। পুত্র হুমায়ূনের প্রতি বাবরের ছিলো অশেষ স্নেহ। হুমায়ূনের প্রতি বাবরের ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ একটি গল্প প্রচলিত আছে। সেই গল্পটি দিয়ে লেখা শেষ করছি।

হুমায়ূন একবার কঠিন রোগে শয্যাশায়ী হলেন। কোনো ওষুধ পথ্যই কাজে আসছে না। আস্তে আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন মুঘল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার হুমায়ূন। তারপর এক ঋষি এসে হাজির হলেন সম্রাট বাবরের দরবারে। বললেন, যদি সবথেকে মূল্যবান জিনিসটি বিসর্জন দিতে পারেন, কেবল তখনই হুমায়ূনকে সুস্থ করতে পারবেন। বাবর জিজ্ঞেস করলেন, কি ধরণের মূল্যবান জিনিস বিসর্জন দিতে হবে? ঋষি জবাব দিলেন, কোহিনূর দিয়ে দিন। ওটিই সবচেয়ে মূল্যবান। বাবর বললেন, “কোহিনূর হীরার উত্তরাধিকার তো আমার পুত্র। ওই হীরা যে আমার নয়! আর যদি হয়েও থাকে আমার সম্পত্তি, সামান্য একটি হীরা কিভাবে আমার ছেলের জীবনের বিনিময় হতে পারে? আমার নিশ্চয় এমন কিছু বিসর্জন দেয়া উচিৎ, যার মালিক শুধু আমি। এ বিশাল সাম্রাজ্য, ধন দৌলত- কিছুই আমার পুত্রের জীবনের বিনিময় হতে পারে না।” বাবর মৃত্যু পথযাত্রী হুমায়ূনের শয্যা তিন বার প্রদক্ষিণ করে আল্লাহর কাছে প্রার্থণা করলেন- ‘হে খোদা, নিজ জীবনের চেয়ে অার কিছু মূল্যবান নয়। আমার জীবন নিয়ে পুত্রের জীবন ভিক্ষা দিন।’ ধীরে ধীরে হুমায়ূন সুস্থ হয়ে উঠথে লাগলেন এবং বাবর রোগাক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হলেন। কিছুদিন পর মারা যান তিনি।

প্রচলিত এ গল্পের সত্যতা উদ্ঘাটন করা গবেষণার বিষয়। তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে সম্রাট বাবর ছিলেন কোমলতা ও কাঠিন্যের মিশ্রণে গড়া অনমনীয় এক চরিত্র।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)