বাঙালি বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস
আজ পালনকৃত প্রাচীন ধর্মগুলোর মধ্যে বৌদ্ধ ধর্ম একটি। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে শুরু হয়ে মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বৌদ্ধ ধর্ম ছড়িয়ে পরে। এক সময় এই ধর্ম পুরো এশিয়া মহাদেশের বেশির ভাগ অংশ জুড়ে প্রভাব বিস্তার করে। এছাড়াও বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে তিন ধরনের (থেরবাদ, মহাযান ও বজ্রযান) আন্দোলনের উন্নয়ন অব্যহত আছে।
বৌদ্ধ ধর্মের ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠাতা সিদ্ধার্থ গৌতম। তিনি শাক্য রাজবংশের এক ক্ষত্রিয়-ব্রাহ্মণ পরিবারে রাজপুত্র হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম ও মৃত্যুর সময়কাল নিয়ে এখনও অনেক ইতিহাসবেত্তাদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ইতিহাসবেত্তা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, খৃষ্টপূর্ব চারশোরও কিছু দশক আগে বুদ্ধ মারা গিয়েছিলেন। তাঁর শাক্য-ক্ষত্রিয় বংশের পরিবারগণ ব্রাহ্মণ গোত্রের ছিল, যা তাঁর পরিবার কর্তৃক প্রদানকৃত নাম “গৌতম” দ্বারা নির্দেশিত। উনবিংশ শতাব্দির পন্ডিত এইতেল-এর মতে, সিদ্ধার্থ গৌতমের নাম গৌতম শব্দটি এক ব্রহ্মর্ষি গৌতম থেকে অনুপ্রাণীত। অনেক বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলোতে বর্ণিত আছে, বৌদ্ধ ছিলেন ব্রহ্মর্ষি অঙ্গিরসের বংশধর।
বৌদ্ধ পরম্পরাগত মতবাদানুযায়ী, সন্ন্যাসী জীবনযাপন ও ধ্যানের মধ্য দিয়ে সিদ্ধার্থ গৌতম ভোগ পরায়ণতা এবং স্ব-রিপুদমনের একটি সংযমী পথ আবিষ্কার করেছিলেন একটি অশ্বত্থ বৃক্ষের নিচে বসে। যেটি বর্তমানে ভারতের বুদ্ধ গয়ায় বোধি বৃক্ষ হিসেবে পরিচিত। সিদ্ধিলাভের পর থেকে গৌতম বুদ্ধ “সম্যকসমবুদ্ধ” বা “আলোকিত ব্যক্তিত্ব” হিসেবে পরিচয় লাভ করে। তৎকালীন মগধ রাজ্যের সম্রাট বিম্বিসারের শাসনামলে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে পৃষ্ঠপোষকতা পায়। সম্রাট বিম্বিসার তাঁর ব্যক্তিগত ধর্মীয়-বিশ্বাস হিসেবে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন এবং তাঁর রাজ্যে অনেকগুলো বৌদ্ধ বিহার নির্মাণের আদেশ প্রদান করেন। আর এই বিহারগুলোই বর্তমান ভারতের বিহার অঙ্গ-রাজ্যের নামকরণে ভূমিকা রাখে।
উত্তর ভারতের বারাণসীর বর্তমান হরিণ-পার্ক নামক জায়গাটিতে বৌদ্ধ তাঁর পাঁচ-সঙ্গীকে প্রথম ধর্মদেশনা প্রদান করে। বুদ্ধসহ তাঁর এই পাঁচ সন্ন্যাস সহচর মিলে প্রথম সংঘ (ভিক্ষু বা সন্ন্যাসীদের দ্বারা গঠিত সম্প্রদায়) গঠন করেন। বিভিন্ন বৌদ্ধ-গ্রন্থ অনুযায়ী, প্রাথমিক অনিচ্ছা থাকার সত্ত্বেও গৌতম বুদ্ধ পরে সন্ন্যাসীনিদেরও সংঘের আওতাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীনিদের “ভিক্ষুণী” হিসেবে অভিহিত করা হয়। বুদ্ধের মাসী এবং তাঁর সৎ-মা মহাপজাপতি গোতমী ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের প্রথম ভিক্ষুণী। খৃষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দিতে তিনি ভিক্ষুণী হিসেবে সন্ন্যাস পদ গ্রহণ করেন।
জানা যায়, বুদ্ধ তাঁর অবশিষ্ট জীবনের বছরগুলোতে ভারতের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলগুলোতে পরিভ্রমণ করেন। অবশেষে বুদ্ধ কুশীনগরের দেহত্যাগ বা মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি ক্ষুদ্র দেশ হলেও কিন্তু জনবহুল রাষ্ট্র। জনসংখ্যার অধিকাংশ বাঙালি হলেও অনেকগুলো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছে যাদের উপজাতি বলে উল্লেখ করা হয়। ধারনা করা হয় বাংলাদেশের উপজাতি জনগোষ্ঠির সংখ্যা প্রায় নয় লাখ হলেও সমগ্র জনগোষ্ঠির এক শতাংশের চেয়েও কম (০.৫৫%)। বাংলাদেশের উপজাতি জনগোষ্ঠির সিংহভাগ পাবর্ত্য চট্টগ্রাম এবং ময়মনসিংহ, সিলেট ও রাজশাহী অঞ্চলে বসবাস করে। দেশের সর্ববৃহৎ উপজাতিক গোষ্ঠী হল চাকমা।
চাকমা
বর্তমানে বাংলাদেশে বসবাসকারী উপজাতির সংখ্যা ৩৪, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের মতে ৪৫টি। তার মধ্যে বৃহত্তম উপজাতি চাকমা, দ্বিতীয় বৃহত্তম উপজাতি সাঁওতাল। উপজাতিদের ৪৩% বৌদ্ধ ধর্মালম্বী। চাকমা তথা চাংমা বাংলাদেশের একটি প্রধান আাদিবাসী জাতি । উপজাতি; ক্ষুদ্র জাতিসত্তা; নৃগোষ্ঠী নামে অভিহিত করা হয়েছে। তবে, এই অবাঙালি জনগোষ্ঠী চাকমারা মঙ্গোলীয় জাতির একটি শাখা। বর্তমান মিয়ানমারের আরাকানে বসবাসকারী ডাইংনেট জাতিগোষ্ঠীকে চাকমাদের একটি শাখা হিসেবে গণ্য করা হয়।
সংস্কৃতি: চাকমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, লোক সাহিত্য, সাহিত্য ও ঐতিহ্য আছে। চাকমারা কোমর জড়ানো গোড়ালি পর্যন্ত পোশাক পরে যাকে পিনোন বলা হয়। কোমরের উপর অংশকে বলা হয় হাদি। হাদি আর পিনোন সাধারণত রঙবেরঙের বিভিন্ন নকশার হয়। পুরুষরা “সিলুম” নামক গায়ের জামা এবং “টেন্নে হানি” নামক জামা পরিধান করে। এই নকশা প্রথমে আলাম নামে পরিচিত এক টুকরা কাপড়ের উপর সেলাই করা হয়।
ভাষা: চাকমা মূল কথ্য ভাষা আর্য ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। কিছু চাকমার কথার মধ্যে প্রতিবেশী চাঁটগাঁইয়া ভাষার সঙ্গে সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায়, যেটি মূলত পূর্ব ইন্দো আরিয়ান ভাষা বংশের একটি ভাষা এবং এটি আসামী ভাষার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। অনেক ভাষাবিদ মনে করেন, আধুনিক চাকমা ভাষা পূর্ব ইন্দো-আরিয়ান ভাষার অংশ। চাকমা ভাষার লিখিত হয় এর নিজস্ব লিপি চাকমা লিপিতে। চাকমা লিপি আগরতারা নামেও পরিচিত।
উৎসব: চাকমাদের সবচেয়ে বড় জাতিগত উৎসব বিজু। বাংলা বছরের শেষ দিনের আগের দিনকে বলা হয় ফুল বিজু। ফুল বিজুর দিন সকাল বেলা চাকমারা ঘর-বাড়ি পরিষ্কার করে ফুল দিয়ে সাজায়, বয়োজেষ্ঠদের গোসল করায়, নতুন কাপড় দেয়। রাতে বসে পরের দিনের পাচন তরকারি রান্নার জন্য সব্জি কাটতে বসে যা কমপক্ষে ৫টি এবং বেশি হলে ৩২ রকম সব্জির মিশেলে রান্না করা হয়। এবং শেষ দিনকে বলা হয় চৈত্র সংক্রান্তি বা মূল বিজু। পরের এদিন চাকমা তরুণ-তরুণীরা খুব ভোরে উঠে কলা পাতায় করে কিছু ফুল পানিতে ভাসিয়ে দেন। তারপর সবাই বিশেষ করে ছোটোরা নতুন জামা-কাপড় পরে বাড়ি বাড়ি ঘুরতে থাকে। তবে গ্রাম গুলোতে প্রাচীনকালের মতোন করে “ঘিলে হারা”(খেলা) হয়। পরের দিন নতুন বছর বা গয্যে পয্যে,নতুন বছরের দিন সবাই বৌদ্ধ মন্দিরে যায়, খাবার দান করে, ভালো কাজ করে, বৃদ্ধদের কাছ থেকে আশীর্বাদ নেয়।
খাদ্য: বাঁশের অঙ্কুর হল চাকমাদের ঐতিহ্যগত খাদ্য। তারা এটাকে “বাচ্ছুরি” নামে ডাকে এবং শ্রিম্প পাস্তে তাদের রান্নার ঐতিহ্যবাহী উপাদান। তারা এটাকে “সিদোল” বলে ডাকে। চাকমাদের প্রধান খাদ্য ভাত, ভুট্টা দ্বারা তৈরী খাদ্য, শাক-সবজি ও সরিষা। সবজির মধ্য রয়েছে রাঙা আলু, কুমড়া, তরমুজ, মাম্মারা(শশা)। চাকমারা শুকরের মাংস খেতে পছন্দ করে।
ধর্ম: বেশীর ভাগ চাকমা শত শত বছরের পুরাতন থেরবাদী বৌদ্ধ ধর্ম অনুসরণ করে। দেশি-বিদেশি অনেক মিশনারী তাঁদের খ্রিস্টান বানানোর চেষ্টা করে চাকমাদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করেছে। প্রায় প্রত্যেক চাকমা গ্রামের বৌদ্ধ মন্দির বা কিওং আছে। বৌদ্ধ সন্যাসীদের ভিক্ষু বলা হয়। তারা ধর্মীয় উৎসব ও অনুষ্ঠান তত্ত্বাবধায়ন করে। চাকমারা ভিক্ষুদের খাবার, উপহার, ইত্যাদি দিয়ে তারা তাদের পুণ্য সঞ্চয় করে থাকে । চাকমার বিশ্বাস করে কিছু আত্মা পৃথিবীতে জ্বর ও রোগব্যাধি নিয়ে আসে এবং এসব আত্মাদের সন্তুষ্ট রাখার জন্য এরা ছাগল, মুরগী, হাঁস, ইত্যাদি বলি দেয়। যদিও বৌদ্ধ বিশ্বাসমতে পশুবলি নিষিদ্ধ, সাধারণত বৌদ্ধ ভিক্ষুকরা এসব মানেন না। বুদ্ধ পূর্ণিমা উল্লেখ্য চাকমা লোকসাহিত্য বেশ সমৃদ্ধশালী। তাদের লোক কাহিনীকে বলা হয়উবগীদ। চাকমাদের তাল্লিক শাস্ত্র বা চিকিৎসা শাস্ত্র অনেক সমৃদ্ধ। আর বয়ন শিল্পে চাকমা রমণীদের সুখ্যাতি জগৎ জুড়ে।
জনসংখ্যা: বর্তমান জনসংখ্যা দিক থেকে চাকমারা ৭ লাখেরও অধিক।