আইনস্টাইনের সাড়া জাগানো বছর

ছাব্বিশ বছরের তরুণ আলবার্ট আইনস্টাইন ১৯০৫ সালের শুরুর দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ব্যর্থ ছাত্র হিসেবে চরম বাস্তবতার সম্মুখীন হন। তখনকার দুনিয়ার তাবৎ পদার্থবিদরা হয়তো কল্পনাও করতে পারেননি যে একজন নগণ্য কেরানি বিজ্ঞানের উন্নতিতে এতটা অবদান রাখতে পারবেন। ঐ বছরই আইনস্টাইন একটি দু’টি নয়, চারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রকাশ করেন-

(১) ব্রাউনীয় গতি সম্বন্ধীয় গবেষণা

(২) ভর-শক্তি সম্পর্ক

(৩) আলোক তড়িৎ ক্রিয়া বা ফটো ইলেকট্রিক ক্রিয়া

(৪) আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব

এতো অল্প বয়সে তাও আবার এক বছরের মধ্যে চার-চারটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রকাশ করা সাধারণ ব্যাপার নয়, যার প্রতিটিই ছিল যুগান্তকারী। চারপাশের রহস্যময় প্রকৃতির সঙ্গে মিশে রয়েছে আইনস্টাইনের এই তত্ত্বগুলো। তার এই গবেষণাগুলো প্রকাশিত হয় পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সেরা পদার্থবিজ্ঞান সাময়িকী ‘অ্যানালিয়ান ডার ফিজিক’ এ।

1.আইনস্টাইনের সাড়া জাগানো বছর

আইনস্টাইনকে নিয়ে গণিতে ফেল বিষয়ক মিথ প্রচলিত আছে। কিন্তু আইনস্টাইন স্ব-উদ্যোগে ১৫ বছর বয়সেই ক্যালকুলাসে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তাছাড়া মিউনিখ উচ্চ বিদ্যালয় এবং সুইস পলিটেকনিকে তার ফলাফল ভালো ছিল। সুইস পলিটেকনিকে আবার তিনি গণিত এবং পদার্থবিদ্যা শিক্ষণের ওপর ডিপ্লোমা করেন। কিন্তু পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের পড়ালেখা তার পছন্দ হয়নি। শুধু পান্ডিত্য কেন ভায়োলিন বাদক হিসেবেও বেশ পক্ত ছিলেন তিনি। তাই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে তিনি হয় গবেষণাগারে বসে গবেষণা করতেন নয়তো ভায়োলিন বাজিয়ে সময় কাটাতেন।

পলিটেকনিক ইনস্টিটিউশনে স্নাতক শেষে আইনস্টাইনকে তার শিক্ষকেরা আর পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার সুপারিশ করেননি এই কারণে যে তিনি ভাল ছাত্র ছিলেন না! ১৯০২ সালে তিনি সুইস ফেডারাল পেটেন্ট অফিসে তার এক বন্ধুর বাবার সহযোগিতায় পরীক্ষকের পদে চাকরি পান। সপ্তাহে ছয়দিন কাজ করেও আইনস্টাইন পদার্থবিদ্যার পড়াশোনার জন্য ঠিকই সময় বের করে নিতেন। কাছের গুটিকয়েক বন্ধুদের সঙ্গে তার সাম্প্রতিক গবেষণাপত্র নিয়ে আলাপ আলোচনা করতেন অবসর সময়ে।

১৯০৫ সালের মার্চ মাসে প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশ করে একটি চমক দিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। বহু দশক ধরে সবাই জানতো যে আলো হচ্ছে এক প্রকার তরঙ্গ, কিন্তু বিজ্ঞানী আইনস্টাইন প্রস্তাব করলেন, আলোর কণা বৈশিষ্ট্যও থাকতে পারে। তাছাড়া পরবর্তীতে দেখা গেল বিখ্যাত আলোক তড়িৎ ক্রিয়া তার এই তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। তৎকালীন সময়ে আইনস্টাইনের এ তত্ত্ব নিয়ে হাসাহাসি হলেও, মূলত তিনি ছিলেন তার সময়ের বিশ বছর অগ্রবর্তী। দেখা গেল এই তরঙ্গ-কণা দ্বৈততাই কোয়ান্টাম বিপ্লবের ভিত্তি রচনা করে দিল।

এর দুই মাস পরে মে মাসে আইনস্টাইন তার দ্বিতীয় গবেষণাপত্র জমা দিলেন; ব্রাউনীয় গতির গাণিতিক ব্যাখ্যা। এতো দিন পরমাণু ছিল বিজ্ঞানীদের কল্পনায়, যুক্তিতে, তত্ত্বে; আইনস্টাইন তাকে বের করে নিয়ে এলেন বাস্তব জগতে, ল্যাবরেটরিতে। পরবর্তীকালে আইস্টাইনের গাণিতিক সমীকরণ ব্যবহার করেই পরমাণুকে শণাক্ত করা সম্ভব হলো। ডেমেক্রিটাসের হাত ধরে যে অ্যাটম বা পরমাণু ধারণার জন্ম হয়েছিল, সেই পরমাণু তত্ত্ব পূর্ণতা পেল আড়াই হাজার পরে আলবার্ট আইনস্টাইনের হাতে।

আইনস্টাইনের তৃতীয় গবেষণাপত্র প্রকাশের পর সমকালীন অধিকাংশ মানুষই বুঝতে পারেনি। এই তত্ত্বে আইনস্টাইন দেখান যে আলোর গতি কখনো, কোনো অবস্থাতেই পর্যবেক্ষকের গতির উপর নির্ভর করে না। ধরুন, একটি আলোর উৎসের দিকে দৌড়াচ্ছেন, এতে ভাববেন না যে আলো উৎস থেকে কম সময়ে পৌঁছাবে। আলোর উৎসের দিকে যদি হেটে যান আবার কোনো দ্রুতগামী জেট বিমানে চড়েও যান, আলো একই সময়ে পৌঁছাবে। আরো বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে যদি উৎসের বিপরীত দিকেও রওনা দেন, তবুও আলো সেই একই সময়ে আপনাকে ধরবে! হ্যাঁ, যেদিকেই যান, যত দ্রুতই ভ্রমণ করেন, আলোর গতি সবসময় একই দেখবেন।

এই বিষয়টি থেকে আরো বিস্ময়কর এক তথ্য উদঘাটিত হয়। আইনস্টাইন এর আগে পর্যন্ত যা মানুষ কল্পনাও করতে পারেনি, তাই প্রমাণ করে এই তত্ত্ব। স্থান, কাল এবং ভর ধ্রুব নয়, বরং গতির সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়! হ্যাঁ, যদি কোনো বস্তু আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে চলে তাহলে ঐ বস্তুর জন্য ঘড়ির কাঁটা চলবে ধীর গতিতে, বস্তুর ভর সম্প্রসারণ ঘটবে এবং একই সঙ্গে দৈর্ঘ্য হবে সংকুচিত!

এর মধ্যে চতূর্থ গবেষণাটিই ছিল সবচেয় বিস্ময়কর এবং বৈপ্লবিক। তিনি E=mc2 সূত্রের মাধ্যমে প্রমাণ করেন ভরকে শক্তিতে রূপান্তরিত করা যায়। এখানে, E= নির্গত শক্তির পরিমাণ, m = বস্তুর ভর এবং c= আলোর গতি। এই সূত্র থেকে জানা যায় যে খুব সামান্য পরিমাণ বস্তু থেকেও বিপুল পরিমাণ শক্তি পাওয়া সম্ভব।

2.আইনস্টাইনের সাড়া জাগানো বছর

আইনস্টাইন এর জন্য ম্যাজিকাল এই বছরের প্রায় পনেরো বছর পরেও হয়তো তিনি একজন বড় বিজ্ঞানী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারতেন না, যদি না তিনি ১৯১৯ সালে আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব প্রকাশ না করতেন। এই তত্ত্বে তিনি মহাকর্ষ কিভাবে স্থান ও সময়কে বিকৃত করে তা আলোচনা করেন। শক্তিশালী মহাকর্ষের প্রভাবে এমনকি আলোও বেঁকে যায়! এটাও সম্ভব? আলোর তো ভর নেই তাহলে মহাকর্ষ কি করে আলো বাঁকায়? আসলে আলোর গতিপথ মহাকর্ষ বাঁকায় না। মহাকর্ষ স্থানকে বাঁকায়,যার মধ্য দিয়ে আলো চলাচল করে। ফলে আলোও বক্রপথে চলাচল করতে বাধ্য হয়!

তার এই আশ্চর্য আবিষ্কারের সত্যতা নির্ণয় করতে একদল ব্রিটিশ বিজ্ঞানী পশ্চিম আফ্রিকার এক দ্বীপে গিয়েছিলেন সূর্যাস্ত দেখবেন বলে। সূর্যাস্তের সময় তারা দূরবর্তী তারকাসমূহ হতে আগত আলোক রশ্মির গতিপথ পর্যবেক্ষণ করে দেখেন যে আলো আসলেই বক্রপথে ভ্রমণ করছে! অর্থাৎ মহাকর্ষ স্থানকে বিকৃত করে!ভাবা যায় সেই ‘চমৎকার বছর’ ১৯০৫ সালে যদি আইনস্টাইনের ঐ পেটেন্ট অফিসেই একঘেয়ে জীবন কাটতো কিংবা ওই চারটি গবেষণাপত্র যদি না প্রকাশ পেত তাহলে বর্তমান পদার্থবিদ্যা কতটুকু সাফল্যমন্ডিত হতো?

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)