মধ্যযুগের অশ্বারোহী

রাউন্ড টেবিল থেকে শুরু করে গেম অব থ্রোনস, নাইটদের নিয়ে গল্প, কিংবদন্তী, বীরত্বগাঁথার যেন কোনো শেষ নেই! ঠিক কতটুকু জানি নাইটদের সম্পর্কে? বর্ম পরিহিত নাইটেরা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঘোড়ার পিঠে আসীন, যাচ্ছে যুদ্ধে। হয়ত আর ফিরে আসবে না, তবুও তারা মৃত্যুপানে যেতে পিছপা হতো না। ইতিহাসের নাইটদের নিয়ে আজকের এই আয়োজন-

নাইটদের প্রশিক্ষণ:

1.মধ্যযুগের অশ্বারোহী

একজন নাইটের প্রশিক্ষণ শুরু হতো সাত বছর বয়সে এবং এর ধারাবাহিকতা ছিল ১৪ বছর। নাইট হওয়া কিন্তু মোটেও সহজ বিষয় ছিল না। কারণ মধ্যযুগে শুধুমাত্র নাইটদের সন্তানরাই এই প্রশিক্ষণের সুযোগ পেতেন। প্রথমেই সাত বছরের শিশুদের পেইজ উপাধি দেয়া হতো। পেইজ হিসেবে নানা ধরনের কাজ করা এবং মালিকের হুকুম তামিল করতে বাধ্য থাকত। তবে এর মাঝেও তাকে কিছু ভয়ঙ্কর খেলায় অংশ নিতে হতো। এসবই ছিল প্রশিক্ষণের অংশ। খেলনাসামগ্রীর পরিবর্তে তার হাতে তুলে নিতে হতো বর্শা এবং শিখতে হতো অশ্বচালনা। পেইজ থেকে তার পদন্নতি হতো স্কোয়ারে। মূলত, এখানে তার কাজ ছিল একজন নাইটের বিভিন্ন কাজ করে দেয়া, পোষাক পরিধানে সাহায্য করা এবং অস্ত্রের দেখভাল করা। মাঝে মাঝে নাইটের সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে নানা কৌশল চাক্ষুষ করার সৌভাগ্য হতো তার। ক্রমশ প্রশিক্ষণ আরো কঠিন হতে শুরু করে। যুক্ত হয় জাউস্টিং এবং কোয়ার্টারস্টাফের মতো কাজ। ২১ বছর বয়সে স্কোয়ার উন্নীত হয় নাইটে। এই নাইট হবার কৌশলের নাম ডাবিং। একজন নোবলম্যান স্কোয়ারের পিঠে জোরে একটা চাপড় দিয়ে খুব দ্রুত কিছু শব্দ উচ্চারণ করেন। তবে পরবর্তীতে চার্চের বদৌলতে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে আরো অনেক কিছু যুক্ত হয়, যা বর্তমানে আমরা বিভিন্ন চলচ্চিত্র বা টেলিভিশন সিরিজে দেখতে পাই।

আরবালেস্ট:

2.মধ্যযুগের অশ্বারোহী

শতাব্দীজুড়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নাইটদের সাহস কিংবা বীরত্বের কোনো জুড়ি ছিল না। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, দোর্দন্ডপ্রতাপ এই নাইটদের ইতি ঘটে আরবালেস্ট নামক অতি সাধারণ একটি সমরাস্ত্রের কাছে। দ্বাদশ শতাব্দীতে তৈরি এই অস্ত্র সুপারক্রসবো গোছের। সম্পূর্ণ স্টিলের হওয়ায় সাধারণ ধনুকের চেয়ে এর শক্তি ছিল অনেক বেশি। আরবালেস্ট প্রায় ৩০০ মিটার পর্যন্ত উত্তোলন করা যেত, রিলোড করা সহজ ছিল এবং এটি চালাতে বেশি বেগও পোহাতে হতো না। এর সাহায্যে ছোঁড়া তীর বর্ম ভেদ করতে পারত সহজেই। যুগের পর যুগ ধরে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা একজন নাইট হঠাত করেই এই আরবালেস্টের কাছে পরাজিত হতে শুরু করল। মাত্র কয়েক মাসেই একজন ধনুর্বিদ আরবালেস্টের সাহায্যে নাইটদের কচুকাটা করতে শুরু করল। তাছাড়া ততোদিনে গান পাউডারও আবিষ্কারের ক্ষণ শুরু হয়। সবকিছু মিলিয়ে নাইটরা খুব বেশি সুবিধে করতে পারছিল না।

সর্পিল সিঁড়ি:

3.মধ্যযুগের অশ্বারোহী

মধ্যযুগের দুর্গগুলোর নকশায় খুব চাতুর্যের সঙ্গে দুটি ফ্লোরের মাঝে সর্পিলাকার সিঁড়ির নকশা করা হতো। দুর্গের দেয়ালের পাশেই ছিল এগুলোর অবস্থান। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে জায়গা বাঁচানোর জন্য এগুলো দেয়াল ঘেঁষে তৈরি করা হয়েছে। তবে সত্য বলতে এটি ছিল একধরনের যুদ্ধকৌশল। শত্রুরা দুর্গের ওপর আক্রমণ করলে নাইটদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় খুব সুবিধে হতো। ঘড়ির কাঁটার মতো উঠতে থাকা এই সিঁড়িগুলোর নকশা তৈরি হয়েছিল যাতে করে নাইটরা বাঁ দিক থেকে সামনে অগ্রসর হতে পারে। কারণ, বেশিরভাগ নাইট তাদের তলোয়ারটা ধরত ডান হাতে।

অর্থমনর্থম:

4.মধ্যযুগের অশ্বারোহী

একজন নাইট হবার খরচ কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। বর্ম, যুদ্ধাস্ত্র, ঘোড়া, ভালো ভালো খাবার ইত্যাদির জন্য প্রচুর অর্থ গুণতে হতো। সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করার উপায় তাদের ছিল না। অশ্বচালনায় নিপুণতার কারণে যেকোনো সেনাবাহিনীতেই নাইটদের কদর ছিল বেশ। নাইটদের খরচ জোটাবার জন্য শাসক তাদেরকে কয়েকখণ্ড জমি প্রদান করতেন। এই ব্যবস্থাকে বলা হতো একজন নাইটের ফি বা ফিয়েফ। নাইট তাদের বাছাইকৃত যোদ্ধাদের নিয়ে দল গঠন করে এসব জমিতে বসবাস করত। এর বদলে তারা শাসকের হয়ে যুদ্ধে যেত প্রয়োজনের সময়ে।

যেভাবে এলো নাইটহুড:

5.মধ্যযুগের অশ্বারোহী

নাইটদের চলাফেরা ছিল বর্মে সজ্জিত অশ্বের সাহায্যে। এই অশ্বগুলোকে বলা হতো ডেস্ট্রিয়ারস। এরা আকারে ছিল বিশাল এবং যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষিত। ধারণা করা হয়, প্রাচীন অশ্বারোহী বাহিনী থেকে নাইটহুডের ধারণা নেয়া হয়। রোমান সাম্রাজ্যের সূচনালগ্ন থেকে নাইট বাহিনী এসেছে বলে বিশ্বাস করেন কেউ কেউ। রোমানদের ইকুয়েস্ট্রিয়ান বা অশ্বারোহী বাহিনী ছিল। যদিও ইকুয়েস্ট্রিসদের সঙ্গে নাইটদের অনেক মিল থাকলেও তাদের মধ্যে জোরালো সংযোগ স্থাপিত ছিল কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। গবেষকেরা বলেন, মধ্যযুগে অশ্বারোহী বাহিনীদের বিপুল সম্মান করা হতো প্রতাপের কারণে। নবম শতাব্দীতে ফ্রান্সের রাজা শার্লামেইন (Charlamagne) সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে অশ্বারোহী বাহিনীর একটি ধারণা প্রবর্তন করেন। তখন থেকেই নাইটহুড ধারণাটির উদ্ভব।

জাউস্টিং:

6.মধ্যযুগের অশ্বারোহী

জাউস্টিং কেবলমাত্র যুদ্ধেই নাইটরা ব্যবহার করতেন না। পপুলার কালচারে যখন একে উন্নীতকরণ করা হয়, তখন খুব বেশি লড়াই হতো না। মধ্যযুগের সমর কৌশলের একটি উপায় হিসেবে জাউস্টিং ধারণার সূত্রপাত হয়। ক্রুসেড শেষের পর নাইটদের আর যুদ্ধ করার তেমন কোনো কারণ ছিল না। জাউস্টিং রুপান্তরিত হয়ে গেল হ্যাস্টিলুডে সমর সংক্রান্ত একটি খেলায়। পরবর্তীতে হ্যাস্টিলুডের ইভেন্টে পাস দে আর্মেস (প্যাসেজ অব আর্মস) যুক্ত করা হয়। এই খেলার নিয়মানুযায়ী একজন নাইটকে বেশ কিছু প্রতিযোগীর সামনে একে একে মুখোমুখি হতে হতো। এরপর যুক্ত হয় মেলি, যেখানে নাইটদের দুটো দল পদব্রজে একে অপরের মুখোমুখি হয়ে যুদ্ধ করত।

ক্রুসেড:

7.মধ্যযুগের অশ্বারোহী

ক্রুসেড শব্দটি দ্বারা মূলত ধর্মীয় যুদ্ধ বোঝানো হয়। তবে কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় উদ্দেশ্যের বিষয়ে জনগণ শক্ত ধারণা পোষণ করলে তাকেও ক্রুসেড নাম দেয়া হয়। বিশ্ব ইতিহাসে ক্রুসেড বলতে পবিত্র ভূমি অর্থাৎ জেরুজালেম এবং কন্সটান্টিনোপল এর অধিকার নেয়ার জন্য ইউরোপের খ্রিস্টানদের সম্মিলিত শক্তি মুসলমানদের বিরুদ্ধে ১০৯৫ থেকে ১২৯১ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকবার যে যুদ্ধ অভিযান পরিচালনা করে সেগুলোকে বোঝায়। ক্রুসেডেই মূলত নাইটরা তাদের প্রধান শক্তি প্রদর্শন করেছিল। অনেকেই মনে করেন ক্রুসেড খুব বেশি হয়নি। প্রায় দুইশত বছর ধরে চলা বড় ধরনের ক্রুসেডের সংখ্যা ছিল আটটি (নয়টি, যদি পিটার দ্য হার্মিট এবং ওয়াল্টার দ্য পেনিলেসের যুদ্ধটিকেও অন্তর্ভুক্ত করেন)। এছাড়াও ছোটখাট আরো অনেক ক্রুসেড সংঘটিত হয়েছে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)