সমান্তরাল মহাবিশ্ব কি আসলেই বিদ্যমান?

সুপ্রাচীন কাল থেকই আমরা জেনে এসেছি যে, আমাদের পৃথিবী ব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র স্থান যেখানে প্রাণের অস্তিত্ব আছে। কিন্তু ধাপে ধাপে বিজ্ঞানের কল্যাণে এই ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা মনে করেন অনন্ত অসীম এই ব্রহ্মাণ্ডে এমন অনেক গ্রহ থাকতে পারে যেখানে জীবন আছে। আর এই একমাত্র কারণে আমাদের পৃথিবীর মত গ্রহ খোঁজার প্রচেষ্টা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কেমন হবে যদি বলি আমাদের এই ব্রহ্মাণ্ডে শুধু পৃথিবীর মতো নয় হুবুহু পৃথিবীর প্রতিরূপ আছে। যেখানে এরকমই শহর, এরকমই সমুদ্র, এরকম সব পশু পাখি এমনকি আপনারও প্রতিরূপও আছে। হ্যাঁ! বিজ্ঞানীর এই থিওরির নাম দিয়েছেন প্যারালাল ইউনিভার্স। সমান্তরাল মহাবিশ্ব। ডেইলি বাংলাদেশের আজকের আয়োজনে আমরা এই বিষয় সম্পর্কে জানবো। প্যারালাল ইউনিভার্স আসলে কি এবং এটার পেছনে বিজ্ঞানীরা কি কি যুক্তি দিয়েছেন?

বিজ্ঞানীদের মতে আমাদের ব্রহ্মাণ্ড শুধুমাত্র ততটুকুই বড় যতটা দূর থেকে আসা আলোকে আজ পর্যন্ত আমরা ডিটেক্ট করতে পেরেছি। কিন্তু সত্যি কি তাই আমাদের ব্রহ্মাণ্ড ঠিক ততোটাই বড় যতোটা দূর থেকে আলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছাতে পেরেছে? এ প্রশ্নটি জন্ম দেয় মাল্টিভাস থিওরি। যার অনুযায়ী আমাদের শুধুমাত্র একটি ব্রহ্মাণ্ড নয় এরকম অনেক সমান্তরাল মহাবিশ্ব আছে কিন্তু সমান্তরাল মহাবিশ্ব কোথায় আছে? প্যারালাল ইউনিভার্স থিওরি অনুসারে আমাদের এই ব্রহ্মান্ডের সব বস্তু সব জীব এমন কি প্রতিটি স্থিতির প্রতিরূপ কোনো না কোনো সমান্তরাল মহাবিশ্বে অবশ্যই মজুদ আছে। আপনার জীবনের প্রতিটি সম্ভাবনা যেটি সত্যি হতে পারত কোনো না কোনো সমান্তরাল মহাবিশ্বে এটি ঘটে চলেছে। যেমন আপনি আমার এই লেখাটি বর্তমানে পড়ছেন সমান্তরালভাবে আপনি হয়তো লেখাটিকে দেখে নিয়েছেন। আবার অন্য কোনো সমান্তরাল মহাবিশ্ব আপনি হয়তো এই লেখাটি সম্পর্কে কিছুই জানেন না অথবা কোনো সমান্তর মহাবিশ্বে এমনটাও তো হতে পারে আপনি এখনও জন্মই নেননি। এর মানে হচ্ছে প্রতিটি সম্ভাবনা যেটা আপনার সাথে হওয়া সম্ভব সেটা কোন না কোন সমান্তরাল মহাবিশ্বে নিরন্তন ঘটে চলেছে।

আপনাকে নির্ণয় করছেন সেটা আপনার ভবিষ্যৎকে নির্ধারণ করে। এর মানে আপনি যেটা নির্ণয় করবেন আপনার জীবন সেই অনুসারে চলতে থাকবে। উদাহরন হিসেবে মনে করুন ওই সময়কার কথা যখন আপনি পড়াশোনার থেকে খেলাধুলাকেই বেশি ভালোবাসতেন। ওই সময় আপনার কাছে দুটি বিকল্প ছিল। হয়তো চাকরি করা আর না হয় খেলাধুলাতে ক্যারিয়ার করা। আপনি চাকরিকে বেছে নিয়েছেন। কিন্তু আপনি খেলাধুলা ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে পারতেন কিন্তু যেহেতু আপনি চাকরিকে ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছেন আর আপনার জন্য এটাই সত্যি। কিন্তু অপরদিকে অন্য এক সমান্তরাল মহাবিশ্ব আপনারই প্রতিরূপ খেলাধুলাকে ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে এবং তার জন্য সেটাই সত্য। এখন আমি জানি আপনাদের মনে বিভিন্ন রকমের প্রশ্ন আসছে এই থিওরিটিকে নিয়ে। এটা কি শুধুমাত্র বিজ্ঞানীদের একটি পরিকল্পনা নাকি তার মধ্যে বৈজ্ঞানিক কোনো যুক্তি প্রমাণ আছে। এটা হলিউডের মুভির কাহিনীর মতো মনে হলেও এটার একটি বৈজ্ঞানিক আধার অবশ্যই আছে। বিজ্ঞানিরা এটাকে বোঝার জন্য চারটি লেভেলে ভাগ করেছেন। যার সাহায্যে আজকে আমরা প্যারালাল ইউনিভার্স এর সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো।

লেভেল ওয়ান: আমরা এখনও এটা জানি না যে, স্পেস টাইমের আকার কেমন। একটি থিওরি অনুসারে এটা ফ্ল্যাট এবং অনন্ত হতে পারে। যদি এমনটা হয় তাহলে একের অধিক ব্রহ্মাণ্ড হওয়ার সম্ভাবনা অনেক গুন বেড়ে যায়। এটির একটি প্রবল সম্ভাবনা বেড়ে যায় প্রতিটি ব্রহ্মাণ্ডেরও সরুপ মজুত হবে। যেখানে আমাদের গ্যালাক্সি, আমাদের সূর্য, আমাদের পৃথিবী এমনকি আমাদের নিজেদেরও প্রতিরূপ হতে পারে। এমন হওয়ার কারণ প্রতিটি কনফিগারেশন কখনো না কখনো নিজেকে রিপিট অবশ্যই করবে। কনফিগারাশন যতই বড় হোক না কেন সেটা এক সময় নিজেকে অবশ্যই রিপিট করে। এর থেকে বোঝা যায় যদি এমনটা হয় তবে একের অধিক ব্রহ্মাণ্ড অবশ্যই হবে। কিন্তু প্রশ্ন এগুলো কোথায়?

বিজ্ঞানীদের দ্বারা করা ক্যাল্কুলেশন এটাই বলে এটা আমাদের থেকে অনেকটা দূরে। আর অনেকটা দূরে বলতে আমাদের কল্পনার থেকেও বিশাল দূরে। তাই লেভেল ওয়ানে প্রতিরুপ সমান্তরাল মহাবিশ্বকে হয়তো আমরা কোনদিনও দিতে পারবো না। কারণ হয়তো ওইখান থেকে আলো আমাদের কাছে কোনদিন এসে পৌঁছবে না।

লেভেল টু: এই থিওরি অনুসারে অনেকগুলো ব্রহ্মাণ্ড আছে এবং সেগুলো এক একটি বিশাল ভুল ভুলাইয়া। এই রকম অনেক ভুল ভুলাইয়া হতে পারে যেগুলো আলাদা আলাদা ব্রহ্মাণ্ড। আর এসব মিলে একটি বিশাল নদীতে ভাসছে যেটাকে বলা হয় হাইপার স্পেস। এসব ভুল ভুলাইয়া অনেক স্পেশাল, এরা একে অপরের সাথে জুড়ে যেতে পারে। আর না হয় বিভাজিত হতে পারে। আর যখন এমন কিছু হয় তখন একটি নতুন ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম হয়। যেহেতু প্রতিটি ব্রহ্মাণ্ড আলাদা আলাদা ভুল ভুলাইয়ার ভেতরে আছে তাই তাদের ব্রহ্মাণ্ডের ভেতরের ভৌতিকের নিয়মও আলাদা আলাদা হবে।

ভালো করে দেখলে এটা কে বিগ ব্যাঙের মত মনে হয়। বিজ্ঞানীদের মতে যদি দুটি ব্রহ্মাণ্ড ছুয়ে যায় তাহলে একটি বিশাল শক্তি উৎপন্ন হবে। যেটা সব কিছুকে দুরে ছুড়ে দেবে। এই জন্য বিজ্ঞানীরা মনে করেন ব্রহ্মাণ্ডের এই স্থানটি তারই একটি প্রমাণ হতে পারে। অন্য ব্রহ্মাণ্ড আমাদের ব্রহ্মাণ্ডকে ছুয়ে দিয়েছিল আর এর জন্যই এখানে কোন গ্যালাক্সি বা তারা নেই। ব্রহ্মাণ্ডের এই স্থানটি অন্যস্থানের থেকে বেশ ঠান্ডা। এটা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনও রিসার্চ করে যাচ্ছেন। আর এটাকে বিজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। কারণ যদি আমরা এটা প্রমাণ করতে পারি তাহলে এটি বিশাল একটি খোঁজ হবে।

লেভেল থ্রি: এর সমান্তরাল ব্রহ্মাণ্ডকে জন্ম দিয়েছে কোয়ান্টাম ফিজিকস। মনে করা হয় এই সমান্তরাল ব্রহ্মাণ্ড আমাদের দুনিয়াতেই মজুত আছে। কিন্তু আমরা এটাকে দেখতে পাই না, কারণ এটা অন্য ডাইমেনশনে আছে। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও কোয়ান্টাম ফিজিক্স এর বেশ কিছু এক্সপেরিমেন্ট এটাই প্রমাণ করেছে, যে একটি ইলেক্ট্রন এক সময় একের অধিক স্থানে মজুত হতে পারে। যদি এই ইলেক্ট্রন এ রকম ব্যবহার করতে পারে তাহলে আমরা তো এই ইলেকট্রন এর সাথে মিলিয়ে তৈরি হয়েছে। তাহলে আমরাও একই সময় একের অধিক ডাইমেনশনে মজুত হতে পারি। এর মানে এটাই আপনার প্রতিটি প্রতিরূপ এই দুনিয়াতেই আপনার প্রতিটি সম্ভাবনাকে করে সত্যি করে যাচ্ছে। আপনার অজান্তেই আপনার প্রতিটি নির্ণয় আপনাকে অন্য কোন ডাইমেনশনে পাঠিয়ে দিচ্ছে আর আপনি যেই ডাইমেনশনেই যাচ্ছেন সেটাই আপনার কাছে সত্যি হয়ে যাচ্ছে।

লেভেল ফোর: লেভেল ফোরে সমান্তরাল ব্রহ্মাণ্ড ম্যাথামেটিকাল ডেমোক্রেসি প্রিন্সিপালের ওপর ভিক্তি করে এবং প্রথম তিনটি লেভেলের মিশ্রিত ফরম। এর মধ্যে আলাদা আলাদা ব্রহ্মাণ্ডের গনিত আলাদা হতে পারে। গনিতের অস্তিত হওয়ার জন্য মানুষের অস্তিত্ব হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। বিজ্ঞানীদের কাছে প্যারালাল ইউনিভার্স এর সম্পর্কে এখনও কোন সঠিক তথ্য প্রমাণ নেই। এটা শুধুমাত্র একটি থিওরি ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এটা সত্য কিনা জানার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর এমন একটি প্রচেষ্টা নাম হচ্ছে লারজ হাইড্রোন কলাইডর।

এটার মধ্যে মাইক্রো পার্টিকালকে একে অপরের সাথে সংঘর্ষ করানো হয়। এমন একটি এক্সপেরিমেন্টের সময় এমন একটি পারটিকালের খোঁজ পাওয়া গেছে যেটা গ্রাভিটিকে বহন করতে পারে। আর এই পারটিকেলের নাম দেওয়া হয়েছে গ্রাভিটল। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন এই পারটিক্যাল আমাদেরকে অন্য কোন ডাইমেনশনের সম্পর্কে তথ্য দিতে পারে। কিন্তু এই পারটক্যালকে উৎপন্ন করা এবং এর ওপরে নজর রাখা ভিশন কঠিন একটি কাজ। বিজ্ঞানের অগ্রগতি দেখে এতাই মনে হচ্ছে যে সমান্তরাল মহাবিশ্বের রহস্য আমরা খুব দ্রুত উন্মোচন করতে পারবো।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)