সাতক্ষীরার ঘেরে মাছ ভেড়িতে সবজি : কৃষকের মুখে হাসি

জেলায় মাচায় সবজি চাষে বৈপ্লিবিক পরিবর্তন এসেছে। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হওয়ায় বর্তমানে বাজারে সবজির দাম অনেকটা কম। বিশেষ করে মাছের ঘেরে মাচা পদ্ধতিতে সবুজ সবজির চাষ কৃষিতে নবদিগন্তের দ্বার উন্মোচন করেছে। মাছা পদ্ধতিতে সবজি চাষে বদলে গেছে জেলার বহু কৃষকের ভাগ্য। প্রতি দিন হাজার হাজার মণ সবজি জেলার চাহিদা মিটিয়ে রাজধানিতে সরবরাহ করা হচ্ছে। মাছের ঘের যেন এখন সবুজের বিপ্লব। দ্বিগন্ত জুড়ে সবজির সমারোহ। গত কয়েক বছর ধরে মাছের ঘেরে মাছা পদ্ধতিতে সবজি চাষ কৃষকদের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। যে দিকে চোখ যায় ঘেরের মাছায় ঝুলতে দেখায় বরবটি, করলা, ঢেঁড়স, লাউ, পুঁইশাক, লাউ, কুমড়াসহ হরেক রকমের সবজি। জেলা কৃষি খামার বাড়ির পক্ষ থেকে চাষীদের সার্বিক পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ৫০ হাজার নারী ও পুরুষের সবজি চাষে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু উৎপাদিত সবজি ন্যার্য দামে বিক্রি করতে না পেরে হতাশ চাষীরা। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বাজার মনিটরিং এর দাবি সংশ্লিষ্টদের।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে জেলায় ৭ হাজার ১৯০ হেক্টর জমিতে সবজির চাষ হয়েছে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১১০ হেক্টর বেশি। সদরে আবাদ হয়েছে ২৫০ হেক্টর, কলারোয়ায় ৮৫০ হেক্টর, তালায় ১৬১০ হেক্টর, দেবহাটায় ২২৫ হেক্টর, কালিগঞ্জে ১৪২০ হেক্টর, আশাশুনিতে ৫১৫ হেক্টর ও শ্যামনগরে ৫২০ হেক্টর জমিতে সবজির আবাদ হয়েছে।
এরমধ্যে লাউ ২০৭ হেক্টর, লালশাক ২৩০ হেক্টর, পুইশাক ৬৪০ হেক্টর, ঢেড়শ ৫৯৫ হেক্টর, ডাটা ৩১০হেক্টর, বরবটি ২৪৯ হেক্টর, চালকুমড়া ১৬৫ হেক্টর, উ্েচ্ছ ৫০ হেক্টর, পটল ৪৯৫ হেক্টও জমিতে আবাদ হয়েছে। তবে চাষীরা বলছে বাস্তবে ঘেরে মাছা পদ্ধতিতে সবজির আবাদের সংখ্যা আরো বেশি।
তালার নগরঘাটা ইউনিয়নের কাপাসডাঙ্গা গ্রামের কার্তিক মন্ডল এ বছর ৮ বিঘা জমিতে মাচা পদ্ধতিতে সবজির চাষ করেছেন। তার স্ত্রী জোনাকি মন্ডল প্রতিদিন সবজি তুলে বিক্রি করেন। দু’জন মিলে প্রতিদিন সকালে তাদের উৎপাদিত সবজি সাতক্ষীরা খুলনা মহাসড়কে পাইকারী বেপারীদের কাছে বিক্রি করেন। এতে তাদের সংসার চলেও কিছু টাকা উদ্বৃত্ত থাকে। সেই টাকা দিয়ে ঘেরে মাছের খাবার কেনেন।
একই এলাকার শানতলা গ্রামের হাফিজুর রহমান নগরঘাটা দক্ষিণ বিলে ২২ বিঘা জমিতে মাচা পদ্ধতিতে সবজি চাষ করেছেন। তার ঘেরে উৎপাদিত সবজি বিভিন্ন বাজারে বিক্রয় করেন। কিন্তু এবছর সবজির দাম তুলনামুলক কম থাকায় লাভের পরিমান কম হবে বলে তিনি চিন্তিত।
মিঠাবাড়ির হাবিবুর ১০ বছর ধরে সবজি চাষ করেন। প্রতিদিন তার ঘেরে মাছায় প্রায় দেড় থেকে দুইশ’ চালকুমড়া ও লাউ বিক্রি করেন। তিনি জানান, প্রতিটা লাউ পাইকারী ৫ টাকা এবং কুমড়ার জালি ৪ টাকা হারে বিক্রি হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় জেলার বেশিরভাগ ঘেরের বেড়িতে ঝুলছে কুমড়া, লাউ, ঝিঙে, বরবটি, উচ্ছে, ঢেঁড়শ, খিরায়, পুইশাকসহ বিভিন্ন প্রকার সবজি।
মিঠাবাড়ীর সবজি ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান ও আমজাদ হোসেন পাইকারী ব্যবসায়ী। তারা জানান, পাটকেলঘাটার ভৈরবনগর মোড় থেকে প্রতিদন ৪০-৫০ জন চাষীর কাছ থেকে দেড়-দুইশ’ ক্যারেট সবজি ক্রয় করি। এসব সবজি পটুয়খালী, ময়মনসিংহ, বরিশাল ও চট্টগ্রামে বাজারজাত করা হয়।
পাটকেলঘাটা শাকদাহ গ্রামের মাছ চাষি মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, তিনি গত দু’বছর ধরে শাকদাহ বিলে ২৫ বিঘার একটি ঘেরে মাছের পাশাপাশি বেড়িতে নানা ধরনের সবজি চাষ করছেন। বছরে তিনি লক্ষাধিক টাকার সবজি বিক্রি করেন। তিনি আরো বলেন, তার দেখাদেখি এলাকার অনেকেই সবজি চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
মিঠবাড়ী গ্রামের ঘের চাষী আবুল হোসেন জানান, তিনি দীর্ঘদিন মাছ চাষ করেন, মাছে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় লাভবান হতে না পারলেও উপজেলা কৃষি কর্মকতার পরামর্শে ঘেরের বেড়িতে সবজি চাষ করে লাভের মুখ দেখছি। এক বিঘা জমির মৎস্য ঘেরের বেড়িতে সবজি চাষ করতে খরচ হয় প্রায় তিন হাজার টাকা। কিন্তু শ্রাবণ, ভাদ্র ও আশ্বিন এই তিন মাসে একটি এক বিঘা ঘেরের বেড়িবাঁধে সবজি চাষ করে ৫০-৬০ হাজার টাকা মুনাফা অর্জন করা যায়।
সবজির ক্ষেত সংলগ্ন সড়কে প্রতিদিন একাধিক অস্থায়ী কাঁচা মালের বাজার বসে। জেলাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তরের পাইকারী ব্যবসায়ীরা সেখানে সবজি ক্রয় করেন। পাইকারী ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে সবজির দাম নির্ধারণ করায় চাষীরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিন বলে অভিযোগ উঠেছে। পাইকারী ব্যবসায়ীরা পানির দামে সেই সবজি ক্রয় করে চড়া দামে জেলা শহরের বিভিন্ন বাজারের বিক্রয় করেন বলে ও অভিযোগ।
ভুক্ত ভোগীদের অভিযোগ বাজার মনিটরিং এর ব্যবস্থা না থাকায় চাষীর কাছ থেকে যে সবজি পাইকারী ৫ টাকা দরে ক্রয় করা হয় খুচরা বাজারে তা দাড়ায় ১৫ থেকে ২০ টাকায়।
তবে জমির আইল, বাড়ির উঠান, এমনকি টিনের চালাতেও সবজি চাষ করা হচ্ছে। এছাড়া নদী ও জলাশয়ে ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষ জনপ্রিয় হচ্ছে। টমেটো, লাউ, ফুলকপিসহ প্রায় ২০ থেকে ২৫ জাতের সবজি এখন সারাবছরই জেলাতে পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গবেষণার মাধ্যমে উন্নত বীজ উদ্ভাবন ও কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বর্তমানে উৎপাদিত সবজির অতিরিক্ত আরো ৩০ ভাগ সবজি উৎপাদন করা সম্ভব।
এ বিষয়ে তালা উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, আধুনিক পদ্ধতিতে মৎস্য ঘেরে সবজি চাষ করে চাষীরা লাভবান হওয়ার পাশাপাশি ঘেরের লিজের টাকাও পরিশোধ করতে পারছেন চাষীরা। তাছাড়া এই পদ্ধতিতে সবজি চাষ করতে তেমন বেশি খরচ হয় না।
জেলা কৃষি খামার বাড়ির উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আব্দুল মান্নান জানান, সাতক্ষীরা জেলাতে সবজি চাষে চাষীদের আগ্রহী করে তোলা হচ্ছে। সবজি চাষে বিভিন্ন করণীয় সম্পর্কে তাদের সচেতন করা হচ্ছে। এতে কৃষিতে সবজি চাষে সবুজ বিপ্লব সৃষ্টি হতে চলেছে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)