জলবায়ু পরিবর্তনে সাতক্ষীরায় কৃষিখাতে বেকার বৃদ্ধি: খাদ্য সংকটে ২২ লক্ষ মানুষ

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জেলায় কৃষিতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে দিন দিন ফসলি জমি হ্রাস পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বদলে গেছে ঋতু চক্র। বৃষ্টির কারণে সময় মত চাহিদা মাফিক ফসলের চাষাবাদ করতে পারছেন না চাষিরা। চলতি আমন মৌসুমে পানি স্বল্পতার কারণে এক দিকে যেমন সব জমি চাষাবাদের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি, অন্যদিকে জলাবদ্ধতার কারণে অনাবাদী রাখতে হয়েছে বিপুল পরিমাণ ধানের জমি। এমন অবস্থায় জেলার আউশ, বোরো, পাটসহ বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সংশয় দেখা দিয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে জনজীবনে। জেলার নি¤œাঞ্চল থেকে প্রতি নিয়ত জন সাধারণ শহর মুখি হচ্ছে। ফলে সাতক্ষীরা শহর ও সদরের অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে। বিপুল জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে শহরবাসী। জেলার চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম থাকায় বাইরের জেলা থেকে খাদ্য ঘাটতি মেটাতে হচ্ছে। বেকারত্বের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে কৃষি খাতে। গত এক দর্শকে জেলাতে আমন, আখ, পাট, হলুদের আবাদ এক তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। এতে খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে জেলার ২২ লক্ষ জন সাধারণ। জেলার কৃষি বিভাগের বিভিন্ন তথ্য, বিভিন্ন সংস্থার জরিপ ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবি মোকাবিলা করার জন্য যেসব ফসলের জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হচ্ছে তা কৃষকের কাছে ভালোমতো পোঁছাচ্ছে না। অনেক প্রযুক্তি সঠিকভাবে কাজও করছে না বলে চাষিদের অভিযোগ।
আন্তজার্তিক বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে কয়টি দেশ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। আর বাংলাদেশের মধ্যে সাতক্ষীরা শীর্ষে। কাজেই জলবায়ু পরিবর্তনে জেলার খাদ্যনিরাপত্তা যে ভীষণ হুমকিতে পড়েছে তা বলা বাহুল্য।

সুতরাং পরিবর্তিত বাস্তবতায় কৃষি উৎপাদন ও সংশ্লিষ্ট খাতে প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে এ সংক্রান্ত আলোচনা বাড়ানো, নীতিনির্ধারণী মহলের নীতি হস্তক্ষেপ এবং সময়োপযোগী কৌশল গ্রহণ জরুরি। এক্ষেত্রে নুন্যতম শিথিলতাও জেলাটির জন্য মারাত্মক বিপর্যয় নিয়ে আসতে পারে।

আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা অক্সফামের সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেবল জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খাদ্যশস্যের দাম আগামী ২০ বছরে ৫০ শতাংশ বাড়বে। এতে দরিদ্র মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। গত পাঁচ বছরে জেলাতে খাদ্য শস্যের দাম দ্বিগুণ হয়েছে বলে অনেকের দাবি।

সংশ্লিষ্ট এক গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ঘূর্ণিঝড়সহ অনেক ধরনের প্রাাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। এতে একদিকে ফসলের ফলনচক্র ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে কৃষিজমি হারাচ্ছে চাষের স্বাভাবিক উপযুক্ততা, উর্বর শক্তি। সংশ্লিষ্ট এক গবেষণার ফল বলছে, ২১০০ সাল নাগাদ সাগরপৃষ্ট সর্বোচ্চ এক মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। ফলে বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ এলাকা নিমজ্জিত হতে পারে।

এ পূর্বাভাস সত্য হলে সাতক্ষীরাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের অনেক এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে এবং সেখানে লবণাক্ততা বাড়বে। ফলে সেখানে স্বাভাবিক ফসল ফলানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। কয়েক লাখ হেক্টর জমি ফসল চাষের উপযুক্ততা হারাবে। এটা দীর্ঘমেয়াদী খাদ্যনিরাপত্তায় ঝুঁকি তৈরি করবে। সেই হিসেবে জেলাটিতে দিন দিন চাষাবাদের জমি হ্রাস পাচ্ছে। এতে জেলাতে খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

কৃষিবিজ্ঞানীদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ব্যাহত হচ্ছে সঠিক সময়ে জমি চাষ, বীজ বপন, ফসল পরিচর্যা, ফসল সংগ্রহ, বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ। এতে উৎপাদন হ্রাসের পাশাপাশি সময়মত পরবর্তী ফসল ফলানো কঠিন হয়ে পড়ছে। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ুর ক্রমাগত পরিবর্তনের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে কৃষির উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
গত কয়েক বছরের আবহাওয়া পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দেশের আবহাওয়া ক্রমেই পরিবর্তনশীল। একটি নির্দিষ্ট ফসলের আশানুরূপ ফলন পেতে নির্দিষ্ট পরিমাণ বৃষ্টিপাত, পরিমিত তাপমাত্রা, বাতাসের আদ্রতা, সুনির্দিষ্ট বায়ুপ্রবাহ প্রয়োজন। পরিবর্তনশীল আবহাওয়ার কারণে প্রকৃতিতে এসব বিষয়ে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। প্রতিনিয়ত তাপমাত্রা ও আদ্রতা বৃদ্ধি, অসময়ে অধিক বৃষ্টিপাত, ঘন ঘন বন্যা, খরা, লবণাক্ততা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় ফসল ফলানোর বিভিন্ন প্রক্রিয়াকে চরম ভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম বড় নিদর্শন বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টে যাওয়া। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে তেমন বৃষ্টি হয় না। বৃষ্টির সময় পিছিয়ে যায়। আশ্বিন মাসে চার-পাঁচদিন এমন পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়, যাতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। খরাসহ বিভিন্ন কারণে জেলাতে ভ’গর্ভস্থ পানির স্তর দিনে দিনে নিম্নমুখী হয়ে সেচকাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে।

গড় তাপমাত্রা বাড়ার কারণে গম, ছোলা, মসুর, মুগ ডালসহ কিছু ধানের উৎপাদন কমে যাওয়ায় কৃষকরাও কৃষি থেকে অনেকাংশে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এক্ষেত্রে কৃষকরা বলছে, গমের বীজ গজানোর তাপমাত্রা হলো ১৫-২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর কম বা বেশি হলে বীজ গজাবে না। গম পাকার সময়ে আদ্রতা বেশি ও ঘন কুয়াশা থাকলে রোগ হবে, ফলনও কম হবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে পাট ও বোরো ফসলের ফলনও কমে যাচ্ছে মারাত্মকভাবে।

প্রতিকূল পরিবেশ সহনীয় ফসলের নতুন জাত উদ্ভাবন করতে না পারলে কৃষি উৎপাদন চরম হুমকির সম্মুখীন হবে।
কৃষি খাতে সংশ্লিষ্টদের দাবি পরিবেশ বিপর্যয় রোধে বৈরী জলবায়ুর সাথে খাপ খাওয়ানোর মত লবণাক্ততা, বন্যা, খরা, জলাবদ্ধতা ও অধিক তাপ সহিষ্ণু ফসলের আরো জাত উদ্ভাবন ও আবাদ বাড়াতে হবে। নতুন শস্যপর্যায় ও অভিযোজন কৌশলের ওপর ব্যাপক গবেষণা জোরদার করতে হবে। অভিযোজন কৌশল ও নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে সরকারের নীতি নির্ধারক থেকে শুরু করে কৃষিজীবী সহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সচেতনতা বাড়াতে হবে। পরিবেশ বান্ধব সমন্বিত ফার্মিং সিস্টেমের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বাড়াতে হবে নদীগুলোর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে ড্রেজিং কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চলে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলার কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পরিবেশের জন্য হুমকি হয় এমন কর্মকান্ড পরিহার করতে হবে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট আঞ্চলিক কার্যালয় সাতক্ষীরার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. হুমাযুন কবীর জানান, ধানের নতুন জাত ও বীজ উৎপাদনে সরকার নতুন নতুন কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। বেনের পোতায় ধানের নতুন জাত উৎপাদনসহ উপযুক্ত বীজ তৈরি করা হচ্ছে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)