‘নির্বাচন কারো উৎসব, আমাদের আতঙ্ক’

যে কোনো নির্বাচন এলেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন৷ নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের সময় এবং পরে নির্যাতিত হন তাঁরা৷ ১৯৯১ সাল থেকে এমনই হয়ে আসছে৷ এ অবস্থার অবসান চেয়ে মহাসমাবেশ করেছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ৷

এবার আগে থেকেই ধর্মীয় সংখ্যালঘু নেতারা নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে উদ্যোগ নিয়েছেন৷ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গত ৬ মাস ধরে দফায় দফায় বৈঠকের পর শুক্রবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশ করেছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ৷ সেখানে পরিষদের পক্ষ থেকে ৫ দফা দাবি তুলে ধরা হয়েছে৷ বলা হয়েছে, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে যাঁরা মনোনয়ন দেবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে ঐক্য পরিষদ৷ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে মনোনয়ন না দেয়ার আহবান জানিয়েছেন নেতারা৷

শুক্রবার সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান৷ বক্তব্য রেখেছেন মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, লেখক, সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, আদিবাসী পরিষদের সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, খ্রিষ্টান পরিষদের সভাপতি নির্মল রোজারিওসহ অনেকেই৷ ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক নিম চন্দ্র ভৌমিক৷ আর ঐক্য পরিষদের পক্ষে ৫ দফা দাবি তুলে ধরেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত৷ অনুষ্ঠানের সঞ্চালকের দায়িত্বে ছিলেন পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল চ্যাটার্জি৷

রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘নির্বাচন তো রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য উৎসবের, কিন্তু আমাদের জন্য আতঙ্কের৷ যখনই নির্বাচন হয়েছে তারপরই আমরা দেখেছি, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন নেমে এসেছে৷ আমরা আর নির্যাতিত হতে চাই না৷ তাই এবার নির্বাচনের আগেই সবগুলো রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে ৬ মাস ধরে বৈঠক করেছি৷ আজ সমাবেশ করলাম৷ আমরা সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহবান জানিয়েছি, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে যেন কোনোভাবেই নির্বাচনের সুযোগ দেয়া না হয়৷”

সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘‘আজ এখান থেকে যে দাবিগুলো উত্থাপিত হয়েছে, তার সঙ্গে আমি একমত পোষণ করছি৷ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কোনো বৈষম্যমূলক সমাজের জন্য হয়নি৷ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা রাষ্ট্রকেই নিশ্চিত করতে হবে৷” সুলতানা কামালও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানান৷ সমাবেশে অন্য অতিথিরা বলেন, এই প্রতিবাদ সমাবেশ মানবিকতা রক্ষা করার জন্য আয়োজন করা হয়েছে৷ সংখ্যালঘুরা এই দেশ থেকে দিন দিন কেন কমে যাচ্ছে, তার জবাব সরকারকে দিতে হবে৷ এই সরকারের আমলেই সাঁওতালদের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে এবং তিন সাঁওতালকে হত্যা করা হয়েছে৷ তার বিচার এখনো হয়নি৷ রামুতে এবং পাহাড়ের পাদদেশে রক্তের হোলি খেলা চলছে এগুলো বন্ধ করতে হবে৷ সবগুলো হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেন বক্তারা৷

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এই সমাবেশে ২২টি সংগঠনের কয়েক হাজার নেতাকর্মী যোগ দেন৷ দুপুর একটায় সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও দুটোর দিকে শুরু হয়েছে৷ সমাবেশ শেষে হিন্দু সাংবাদিকদের সংগঠন ‘স্বজন’-এর সভাপতি সন্তোষ শর্মা বলেন, ‘‘আমরা আর বসে থাকতে পারি না৷ বারবার নির্যাতিত হবো, এটা হতে পারে না৷ এবার আমরা বলেছি, নির্বাচনের আগে বা পরে যদি সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন নেমে আসে, তাহলে আমরা কঠোর আন্দোলনে যাবো৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আমরা অনুরোধ করেছি, সাম্প্রদায়িক কাউকে মনোনয়ন না দিতে৷ আমরা আশা করি, তিনি আমাদের কথা শুনবেন৷”

বক্তারা বলেন, ‘‘নির্বাচন আমাদের কাছে উৎসব না৷ বিপর্যয়ের শঙ্কা নিয়ে আসে৷ তখন আমরা প্রশাসন, রাজনৈতিক দল এবং রাষ্ট্রের নির্বিকার ভূমিকা সব সময় লক্ষ্য করি৷” সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হবার আহবান জানানো হয় সমাবেশ থেকে৷ সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহবানও জানান তাঁরা৷

ঐক্য পরিষদের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজল দেবনাথ বলেন, ‘‘সারাদেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ এই সমাবেশে এসেছেন৷ তাঁরা বলেছেন, আমরা দ্বিজাতি তত্বের জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি৷ সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম থাকবে সেটার জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি৷ এমনকি বঙ্গবন্ধুও এই জন্য মুক্তিমুদ্ধ করেননি৷ এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকেই বঙ্গবন্ধু সাম্যের কথা বলেছিলেন৷ এমন বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু চাননি, শেখ হাসিনার কাছ থেকেও আমরা প্রত্যাশা করি না৷ এখানে সব মানুষের সমান অধিকার থাকবে, সেটাই প্রত্যাশা৷”

২০০১ সালের নির্বাচনের পর বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ব্যাপক সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে৷ ২০১২ সালের অক্টোবরে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর বড় ধরনের হামলা হয়৷ ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসির নগরে হিন্দুদের শতাধিক বাড়ি-ঘরে হামলা-ভাঙচুর এবং লুটপাট করা হয়৷ অন্তত ১০টি মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়৷ হিন্দু পল্লিতে নারী-পুরুষকে বেধড়ক পেটানো হয়৷ ২০১৭ সালের নভেম্বরে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয় রংপুরের গঙ্গাচড়ার ঠাকুরপড়া এলাকায়৷ ওই ঘটনার পর সারাদেশে আরো অন্তত পাঁচটি মন্দিরে হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে৷

গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশন (ইউএসসিআইআরএফ) তাদের প্রতিবেদনে জানায়, ‘‘বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা বেড়েছে৷” সংস্থাটি বলেছে, ‘‘‘ভূমি দখলের ক্ষেত্রে হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা আক্রমনের শিকার হন৷ ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বার বার আক্রমনের শিকার হয়েছেন৷ সামনে নির্বাচন নিয়ে তাই আতঙ্কে আছেন তাঁরা৷”

বাংলাদেশ পূজা উৎযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল চ্যাটার্জি বলেন, ‘‘আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন৷ এই দিনে আমরা সমাবেশ করে প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেবেন না৷ নির্বাচনে মনোনয়ন দেবেন না৷ এদের বিরুদ্ধে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ আছি, থাকতে চাই৷”

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)