ইন্দিরা হত্যা এবং পেছনের কথা

ভারত স্বাধীনতার অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন জওহরলাল নেহরু। তার মেয়ে ইন্দিরা গান্ধীও যে রাজনীতিতে আসবেন, এতে খুব বেশি অবাক হওয়ার ছিল না। বাবা বেঁচে থাকতেই তার সহকারি হিসেবে কাজ করেছেন মেয়ে। ১৯৬৪ সালে নেহরুর মৃত্যুর পর রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন, লাল বাহাদুর শাস্ত্রী সরকারের আমলে তথ্য ও প্রচার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৬৬ সালে ভারতের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত ১১ বছর টানা ৩ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৮০ সালে চতুর্থ মেয়াদেও ক্ষমতায় আসেন, কিন্তু এবার আর দায়িত্ব শেষ করে যেতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায়ই নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তাকে। দৈনিক সাতক্ষীরার পাঠকদের জন্য সেই হত্যাকান্ডের বিস্তারিত থাকছে আজ-

1.ইন্দিরা হত্যা এবং পেছনের কথা

৩১ অক্টোবর, ১৯৮৪। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সেদিন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ব্রিটিশ অভিনেতা পিটার উস্তিনভের সঙ্গে সাক্ষাতে যাওয়ার। একটি আইরিশ টেলিভিশনের জন্য প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করছিলেন উস্তিনভ, তার জন্যই ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছিলেন তিনি। ইন্দিরাও সম্মতি দেন। সকাল ৯টা ১০ এর দিকে নয়াদিল্লীর ১ নম্বর সফদারজং রোডে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনের বাগানে পায়চারি করছিলেন তিনি। তখনই তার বিশ্বস্ত দুই দেহরক্ষী সত্যবন্ত সিং ও বিন্ত সিং সরাসরি গুলি করেন ইন্দিরা গান্ধীর শরীরে। কিন্তু কেন প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বস্ত দুই দেহরক্ষী গুলি করলেন প্রধানমন্ত্রীকে? কারণ বুঝতে হলে ফিরে যেতে হবে কিছুটা পেছনে, জানতে হবে ‘অপারেশন ব্লু ’স্টার’ সম্পর্কে।

2.ইন্দিরা হত্যা এবং পেছনের কথা

অপারেশন ব্লু স্টার হলো ১৯৮৪ সালের ১ থেকে ৮ জুন পাঞ্জাবের অমৃতসরে পরিচালিত একটি সামরিক অভিযান। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশেই পরিচালিত হয় এই অভিযানটি। মূলত সহিংস ধর্মীয় নেতা জারনাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে ও তার অনুসারীদের হরমন্দির সাহিব কমপ্লেক্স থেকে উচ্ছেদ ও আটকের জন্যই এই অভিযান চালানো হয়। ভিন্দ্রানওয়ালেকে আটক করা হতে পারে, এমন গুঞ্জন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল অনেক দিন আগে থেকেই। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে শিখ রাজনৈতিক দল আকালি দালের সভাপতি হরচাঁদ সিং লংওয়াল তাই ভিন্দ্রানওয়ালেকে পরামর্শ দেন শিখদের বিখ্যাত মন্দির স্বর্ণমন্দিরের কমপ্লেক্সে আশ্রয় নিতে, যাতে করে সরকার তাকে গ্রেফতার করতে না পারে। হরচাঁদের পরামর্শক্রমেই মন্দিরের কমপ্লেক্সকে নিজের অস্ত্রাগার ও হেডকোয়ার্টার বানিয়ে তোলেন ভিন্দ্রানওয়ালে।

3.ইন্দিরা হত্যা এবং পেছনের কথা

অমৃতসরে এক প্রকার ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে বসেন এই ভিন্দ্রানওয়ালে। সহিংসতায় মোট ৪১০ জন মানুষ নিহত হন, এমনকি ভিন্দ্রানওয়ালের বিরোধিতা করায় ৩৯ জন শিখ নাগরিককেও হত্যা করে ভিন্দ্রানওয়ালের বাহিনী। হাজারেরও বেশি লোক আহত হয় এই সহিংসতায়। দিন দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া ভিন্দ্রানওয়ালেকে আটক করার জন্য তাই বিশেষ অভিযান পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেন ইন্দিরা গান্ধী। অভিযানে নিহত হন ভিন্দ্রানওয়ালে। কিন্তু তাকে আটক করতে গিয়ে শিখদের পুণ্যস্থান স্বর্ণমন্দিরের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। আর এতেই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর উপর ক্ষুব্ধ হন বিশ্বজুড়ে শিখ সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ। শিখদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছেন প্রধানমন্ত্রী, এমন দাবি তোলেন শিখ সম্প্রদায়ের অনেকে। প্রতিবাদ জানিয়ে অনেক শিখ সেনা ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে ইস্তফা দেন, অনেকে সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন, আবার কেউ কেউ প্রতিবাদ হিসেবে সরকার থেকে পাওয়া সম্মাননা ও পুরষ্কারও ফিরিয়ে দেন।

4.ইন্দিরা হত্যা এবং পেছনের কথা

ফিরে আসা যাক ৩১ অক্টোবর ১৯৮৪, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনের বাগানে। প্রধানমন্ত্রীর বের হওয়ার জন্য গেটের কাছে অপেক্ষা করছিলেন দুই শিখ দেহরক্ষী সত্যবন্ত ও বিন্ত। ঠিক যে মুহূর্তে ইন্দিরা গান্ধী গেট অতিক্রম করলেন, দু’জনে মিলে একযোগে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলিবর্ষণ করলেন ইন্দিরা গান্ধীর উপর। সাব ইন্সপেক্টর বিন্ত সিং প্রথমে নিজের .৩৮ রিভলভার থেকে তিন রাউন্ড গুলিবর্ষণ করেন প্রধানমন্ত্রীর তলপেট লক্ষ্য করে। এরপর সত্যবন্ত সিং স্টার্লিং সাব মেশিনগান থেকে একটানা ৩০ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করলে সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ইন্দিরা গান্ধী।

5.ইন্দিরা হত্যা এবং পেছনের কথা

সকাল সাড়ে নয়টার দিকে জরুরী ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীকে ভর্তি করা হয় অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ মেডিকেল সাইন্স (এআইআইএমএস) এ। একটি সাদা অ্যাম্বাসেডরে করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান তাঁর পুত্রবধূ। চিকিৎসকেরা অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেসময় ইন্দিরার ছেলে রাজীব গান্ধী দিল্লীতে ছিলেন না। পরবর্তী নির্বাচনের জন্য প্রচারণা চালাতে রাজীব তখন পশ্চিমবঙ্গে। দ্রুতই রাজীবকে তার মায়ের ব্যাপারে খবর দেয়া হয়। প্রচারণা কাজ ফেলে রেখে প্রণব মুখার্জীকে সঙ্গে নিয়ে তড়িঘড়ি করে দিল্লীর উদ্দেশ্যে রওনা হলেন রাজীব। ওদিকে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনেই প্রধানমন্ত্রীর উপর আকস্মিক গুলিবর্ষণের ছয় মিনিটের মধ্যে দুই আসামীকে আটক করে ইন্দো-তিব্বত বর্ডার পুলিশ। প্রধানমন্ত্রীর অন্য দেহরক্ষীদেরও আটক করা হয়।

হাসপাতালে তখন ইন্দিরা গান্ধীর অপারেশন চলছেন। তার অবস্থা তখন খুবই সংকটাপন্ন। তাকে উদ্দেশ্য করে ছোঁড়া ৩৩ টি বুলেটের ৩০ টিই আঘাত হানে তার শরীরে। এর মধ্যে ২৩ টি বুলেট শরীরে ঢুকে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে বের হয়ে যায়, আর ৭ টি বুলেট আটকে ছিল শরীরের ভেতরেই। ডা. তিরথ দাস ডোগরা বুলেটগুলোকে বের করে ব্যালিস্টিক পরীক্ষার জন্য পুলিশের হাতে তুলে দেন।

ইন্দো-তিব্বত বর্ডার পুলিশের হাতে আটক হওয়া বিন্ত সিংকে আটক করার কিছুক্ষণের মধ্যেই গুলি করে মেরে ফেলা হয়। মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, বিন্ত সিংই প্রথম গোলাগুলি শুরু করেন, তারপর তাকে বাধ্য হয়ে হত্যা করা হয়। অপর আসামী সত্যবন্ত সিংকে আটক করা হয় ও বিচারের আওতায় আনা হয়।

দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে প্রধানমন্ত্রীর সংকটাপন্ন অবস্থার খবর ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। বিবিসিও এই সময়ে ইন্দিরা গান্ধীর উপর গুলি চালানোর খবর প্রচার করতে থাকে। বিকাল তিনটার দিকে দিল্লীতে এসে নামেন রাজীব গান্ধী, নেমেই সরাসরি হাসপাতালে চলে যান। ফ্লাইটে তার সফরসঙ্গী অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ প্রণব মুখার্জী বোধ হয় তখনই বুঝতে পেরেছিলেন, ইন্দিরা গান্ধীর বাঁচার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। যাত্রাপথেই তাই তিনি রাজীবকে পরামর্শ দেন পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে।

6.ইন্দিরা হত্যা এবং পেছনের কথা

রাজীব গান্ধী যতক্ষণে হাসপাতালে পৌঁছেছেন, ততক্ষণে না ফেরার দেশে চলে গেছেন তার মা ইন্দিরা গান্ধী। দুপুর ২ টা ২০ মিনিটের দিকে মারা যান গুরুতর আহত ইন্দিরা, তবে তৎক্ষণাৎ সেই খবর প্রচার করা হয়নি। দূরদর্শনের সন্ধ্যার খবরে প্রধানমন্ত্রী মারা যাওয়ার খবর প্রচার করা হয়। সংবাদ উপস্থাপক সালমা সুলতান ইন্দিরা গান্ধীর মারা যাওয়ার খবর প্রচার করেন, আর এর পরপরই কোনপ্রকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন ছাড়াই সন্ধ্যা পৌণে সাতটায় দেশটির ষষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন রাজীব গান্ধী। এত বড় হত্যাকান্ডের প্রতিক্রিয়া হিসেবে মাঝরাত থেকেই গোটা দেশজুড়ে দাঙ্গা লেগে যাওয়ার খবর আসতে থাকে। আসামী সত্যবন্ত সিং ও এই হত্যাকান্ডের মূল ইন্ধনদাতা কেহার সিংকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। ১৯৮৯ সালের ৬ জানুয়ারি দু’জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

7.ইন্দিরা হত্যা এবং পেছনের কথা

আকস্মিকভাবে মারা গেলেও অনেকেরই ধারণা, আগে থেকেই এরকম কিছুর অনুমান করতে পেরেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। মারা যাওয়ার ঠিক কয়েকদিন আগেই উড়িষ্যাতে দেয়া তার এক ভাষণ সেরকমই ইঙ্গিত দেয়। ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আজ আমি জীবিত আছি, কাল নাও থাকতে পারি। আমি মরলাম না বাঁচলাম তাতে আমার কিছু যায় আসে না। দীর্ঘদিন জীবন ধারণ করেছি, এবং আমি গর্বিত যে আমি আমার সারা জীবন আমার দেশের মানুষের সেবার জন্য ব্যয় করে গেছি। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত আমি আমার দেশের মানুষের সেবার কাজে নিয়োজিত থাকব, আমার রক্তের প্রতিটি ফোঁটা ভারতকে আরো শক্তিশালী করবে। যতদিন বেঁচে থাকব, ভারতকে ঐক্যবদ্ধ রাখব।’

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)