গৃহবিবাদে মহাজোট, হেভিওয়েট প্রার্থী বিএনপি চায়

আগামী ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা কাজ করলেও এরই মাঝে ‘দৌড়ঝাঁপ’ শুরু করেছেন প্রায় সব রাজনৈতিক দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। এক্ষেত্রে নির্বাচনের আগে শেষ ঈদে ‘এক ঢিলে দুই পাখি’ মেরেছেন চট্টগ্রাম অঞ্চলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা৷

ঈদুল আজহায় চট্টগ্রামের শহর-গ্রাম সব স্থানেই চোখে পড়েছে সম্ভাব্য প্রার্থীদের জনসংযোগ। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি- বড় এই তিন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা গেছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। প্রায় প্রতিটি আসনেই বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থিতার ছড়াছড়ি। মন্ত্রী-এমপিরা ঘন ঘন যাচ্ছেন নিজ এলাকায়। ভোটাররাও চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন তাদের কর্মকাণ্ডের।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রামের ১৬টি আসনে রাজনৈতিক দলগুলোর আসনভিত্তিক প্রস্তুতি, দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, সর্বশেষ অবস্থান এবং ভবিষ্যত সম্ভাবনা, মাঠের অবস্থাইবা কী- এসব নিয়ে জাগো নিউজ’র ধারাবাহিক প্রতিবেদন ‘ভোটের বাদ্য’। দ্বিতীয় কিস্তিতে আজ থাকছে ‘চট্টগ্রাম-২’ এর সার্বিক চিত্র।চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় উপজেলা ফটিকছড়ি। ৭৭৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দুটি পৌরসভা ও ১৮টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ফটিকছড়ি (চট্টগ্রাম-২) আসন। জেলার সবচেয়ে উত্তরের এই জনপদে জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে চার লাখ।

রবাসী অধ্যুষিত এই জনপদ আশপাশের উপজেলাগুলো থেকে শিক্ষায় বেশ পিছিয়ে। একসময় আওয়ামী লীগ-জামায়াত দ্বন্দ্বে সন্ত্রাসের জনপদ বলে স্বীকৃতি পাওয়া ফটিকছড়িতে বিদ্যালয়ের চেয়ে মাদরাসার সংখ্যা বেশি। তাই এখানে ভোটের হিসাবও ভিন্ন।

২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোট থেকে বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারি ফটিকছড়ি আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে এবার তাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন আওয়ামী লীগের নুরুল আলম চৌধুরী, এম তৌহিদুল আলম বাবু, এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম, খাদিজাতুল আনোয়ার সনি ও ফখরুল আনোয়ার।

তরিকত ফেডারেশনকে আসন ছেড়ে না দেয়ার কথা বললেও আওয়ামী লীগের নিজের ঘরের কোন্দল আরও তীব্র। নির্বাচনের বাতাস বওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দলীয় কোন্দল-গ্রুপিং এখন প্রকাশ্যে। চলছে সংঘাত, ঘটছে রক্তপাতের ঘটনাও। সব মিলিয়ে ফটিকছড়ি আওয়ামী লীগের রাজনীতি এখন বহু ধারায় বিভক্ত।

স্থানীয় প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম ও খাদিজাতুল আনোয়ার সনির মধ্যে লড়াই হতে পারে বলে মনে করছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা।

এছাড়া খবর আছে, চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) আসনের বর্তমান এমপি গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন তার ছেলে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান রুহেলকে মিরসরাই আসন ছেড়ে দিতে চাইছেন। ফটিকছড়ি থেকে তিনি নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করারও আশা প্রকাশ করেছেন।

২০০৮ সালের নির্বাচনে সারাদেশে বিএনপি যখন গো-হারা হেরেছিল, সেই নির্বাচনে ফটিকছড়ি থেকে বিজয় ছিনিয়ে আনেন যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি হওয়া বিএনপির প্রার্থী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। এবারও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবার থেকে কেউ মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে।এদিকে বিএনপির শীর্ষ নেতারাও আসন পুনরুদ্ধারে চাইছেন হেভিওয়েট প্রার্থী। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ইমেজ কাজে লাগাতে বিএনপির নতুন প্রার্থী হিসেবে এখানে দেখা যেতে পারে তার স্ত্রী ফরহাত কাদের চৌধুরী কিংবা ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে। আলোচনায় আছেন সাবেক বিচারপতি ফয়সাল মাহমুদ ফয়েজীও। তবে স্থানীয়দের মধ্য থেকে কাউকে প্রার্থী করার চাপ রয়েছে দলের ভেতরে।
স্থানীয়দের মধ্যে প্রার্থী হতে চাইছেন দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা কেন্দ্রীয় সহ-তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সাংবাদিক কাদের গণি চৌধুরী ও চট্টগ্রামের সাবেক সিভিল সার্জন ডা. খুরশীদ জামিল চৌধুরী ও কর্নেল (অব.) আজিম উল্লাহ্ বাহার চৌধুরী। জাতীয় প্রেস ক্লাবের দুই দফায় নির্বাচিত যুগ্ম সম্পাদক ও অলি হযরত শাহ সুফি সৈয়দ আবদুল গণি চৌধুরীর দৌহিত্র কাদের গণি চৌধুরী নির্বাচনকে টার্গেট করে অনেক আগে থেকেই এলাকায় সক্রিয় আছেন।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমান সংসদ সদস্য নজিবুল বশর মাইজভান্ডারি ১৪ দলের টিকিটে নির্বাচিত হয়ে এলাকায় খুব বেশি উন্নয়ন করতে পারেননি। অধিকাংশ সময় ঢাকায় অবস্থানের কারণে এলাকার মানুষ প্রয়োজনে তাকে কাছে পাননি। এমনকি সর্বশেষ ফটিকছড়ির বিভিন্ন এলাকা বন্যাকবলিত হলেও এলাকায় আসেননি এমপি। এ কারণে এবার আর নৌকার ওপর ভর করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই তরিকত ফেডারেশনের।

তবে নজিবুল বশর মাইজভান্ডারি জাগো নিউজকে বলেন, ‘নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার উন্নয়নকাজ করেছি। অনেক বড় বড় প্রকল্পের কাজ এখনও চলমান। মানুষ শান্তিতে আছে। নিশ্চয়ই এসবের মূল্যায়ন করবেন ভোটাররা।’

তিনি জানান, আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকবে তরিকত ফেডারেশন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরুর সময় থেকে সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন।

উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রাম-২ আসনকে সবসময় আওয়ামী লীগের ঘাঁটি বলে মনে করা হতো। ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে এখান থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হন। এর আগে ১৯৭৩ ও ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে ফটিকছড়ির মানুষ আমাকে এমপি নির্বাচিত করেছিলেন। তাই আগামী নির্বাচনেও দলের মনোনয়ন প্রত্যাশা করছি। ’

২০০৮ সালের নির্বাচনে ফটিকছড়ি আসনে নৌকার প্রার্থী ছিলেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম। পরবর্তী সময় তার সঙ্গে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি, বর্তমান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। সেই দ্বন্দ্বে বিশাল জয় ছিনিয়ে নেয় বিএনপি।

এ টি এম পিয়ারুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০০৮ সালে দলের একটি অংশ বিএনপির সঙ্গে আঁতাত করে আসনটি যুদ্ধাপরাধীর হাতে তুলে দিয়েছিল। এখনও সেই মাশুল গুনতে হচ্ছে ফটিকছড়িবাসীকে। তাই আশা করছি, এবার আমাকে ফের মূল্যায়ন করবে দল।’

সাবেক এমপি রফিকুল আনোয়ারের পরিবারের সদস্যরাও মরিয়া এ আসনে আওয়ামী লীগের টিকিট পেতে। রফিকুল আনোয়ারের মেয়ে খাদিজাতুল আনোয়ার সনি জানান, তিনি গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেও দলের সিদ্ধান্তে আবার সরে দাঁড়িয়েছিলেন। নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি মূল্যায়ন করবেন।

বিএনপির সম্ভাব্যপ্রার্থী সাংবাদিক কাদের গণি চৌধুরী বলেন, ‘অনেক দিন ধরে ফটিকছড়িতে যোগ্য নেতার সংকট। তাই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েও এখানকার মানুষ শিক্ষা, চিকিৎসা ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে। এলাকার উন্নয়ন এবং নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখতে স্থানীয় প্রার্থীর বিকল্প নেই। তাই এবার আর উড়ে আসা কাউকে দলের প্রার্থী করা হবে না বলে আশা করি।’

বিচারপতি ফয়সাল মাহমুদ ফয়েজি বলেন, ‘বিএনপি থেকে আমাকে মনোনয়ন দেয়া আছে। গতবার সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুরোধে ছেড়ে দিয়েছিলাম। তখন চেয়ারপারসন বলেছিলেন, আগামীবার আপনি করবেন। এবারও যদি আমাকে পছন্দ না হয়, তবে আপত্তি নেই। কিন্তু ফটিকছড়ি আসনে ফটিকছড়ির লোককেই মনোনয়ন দিতে হবে। রাউজান, রাঙ্গুনিয়া কিংবা নোয়াখালী থেকে লোক এনে মনোনয়ন দেয়া যাবে না।’

বিএনপির উত্তর জেলার আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ডা. খুরশিদ জামিল চৌধুরী বলেন, ‘মহাজোট ও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে বিএনপি ফটিকছড়িতে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। যোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন পেলে এখানে ধানের শীষ বিজয়ী হবে।’

বিগত নির্বাচনের ফলাফল

১৯৯১ সালে ফটিকছড়ি থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারি। ১৯৯৬ সালে তার পরিবর্তে আওয়ামী লীগের তৎকালীন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের অর্থ বিষয়ক সম্পাদক রফিকুল আনোয়ারকে মনোনয়ন দেয়া হলে তিনি জয়ী হন। এরপর সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারি বিএনপিতে যোগ দেন।

২০০১ সালে রফিকুল আনোয়ার ও নজিবুল বশরের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। জয়ী হন আওয়ামী লীগপ্রার্থী রফিকুল আনোয়ার। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে নৌকার প্রার্থী চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এ টি এম পেয়ারুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিশাল জয় পায় বিএনপি। এরপর নজিবুল বশর তরিকত ফেডারেশন গঠন করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বাঁধেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে বিএনপিবিহীন নির্বাচনে তরিকত ফেডারেশন এ আসন থেকে মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হয়।

[‘ভোটের বাদ্য’র তৃতীয় কিস্তিতে থাকছে ‘চট্টগ্রাম-২’ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম এবং তাদের নিয়ে স্থানীয়দের চুলচেরা বিশ্লেষণ।” বিস্তারিত জানতে চোখ রাখুন দৈনিক সাতক্ষীরাতে;

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)