র‌্যাবের জালে বহুরূপী রুপির ব্যবসায়ী আটক

দেশের বিভিন্ন জাতীয় উৎসবের সময় বা ধর্মীয় উৎসবে জাল টাকা-রুপির ব্যবসায়ীরা সুযোগ কাজে লাগায়। ঈদে বিশেষ করে ঈদুল আজহার সময় বা পূজা-পালনে দেশের অর্থনীতি ধ্বংসকারী এই জাল মুদ্রার ব্যবসায়ীরা বিভিন্নভাবে নেমে পড়েন। তবে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে র্যাবের কর্মতৎপরতায় তারা সুবিধা করে উঠতে পারে না। একের পর এক জাল রুপির কালোবাজারিরা র‌্যাবের জালে ধরা পড়েন।

গেল বুধবার গভীর রাতে রাজধানীর শ্যামলী রিং রোডের একটি ফ্ল্যাটে র‌্যাব-২ অভিযান পরিচালনা করে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে রাত পৌনে ৩টার দিকে রিং রোডের গার্ডন স্ট্রিজ ভবনের একটি ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করা হয় ১৫ লাখ ৭৪ হাজার ভারতীয় জাল রুপি। ওই সময় আটক করা হয় জাল রুপির তৈরির কারিগর শামসুল হক (৪৪) নামের এক ব্যক্তিকে। উদ্ধার করা হয় জাল রূপি তৈরির বিপুল সরঞ্জাম।

এদিক গেল শুক্রবার রাজশাহীর বোয়ালীয়া থানা থেকে আটক করা অপর এক জাল মুদ্রার কালোবাজারিকে। তিনি হলেন মো. দরুদুজ্জামান বিশ্বাস (৫৭)। গোয়েন্দা তথ্য ও আগে আটক হওয়া আসামির দেয়া তথ্যে তাকে আটক করা হয়। তার কাছ থেকে র‌্যাব উদ্ধার করে ১০ লাখ ৩৮ হাজার ভারতীয় জাল রুপি। এখান থেকেও জাল রুপি তৈরি করার সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। এ তথ্য নিশ্চিত করেন র‌্যাব-২ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. আনোয়ারুজ্জামান।

একান্ত আলাপে তিনি ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, জাল রুপির কারবারিরা দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে। তাদের প্রতারণার কারণে অনেকে চিকিৎসা বা ভ্রমণে ভারতে গিয়ে এসব জাল রুপি নিয়ে পড়েছেন বিড়ম্বনায়। এরা দেশের শত্রু। আমাদের গোয়েন্দারা সব সময় এ বিষয়ে কঠোর নজরদারি বজায় রাখে। এবার ঈদুল আজহায় র‌্যাবসহ আইন-শৃঙখলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির কারণে জাল টাকা বা রুপির কারবারিরা তেমন সুবিধা করতে পারেনি।

জানা গেছে, গোয়েন্দা তথ্য ও প্রযুক্তির সহায়তায় র‌্যাব রিং রোড থেকে জাল রুপির কারগির শামসুলকে আটক করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে শ্যামলী থেকে আটক শামসুল হক জানান, তার গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবপুরে। তিনি এক সময় সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় গরু এনে গাবতলীর হাটে বিক্রি করতেন। এ সময় ভারতীয় জাল রুপি চক্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়। সীমান্তে গ্রামের বাড়ি হওয়ায় তার জন্য সুবিধা হয়। এলাকায় সবাই জানে তিনি গুরুর ব্যবসাই করছেন। কিন্তু তিনি গত ৫ বছর ধরে গরুর ব্যবসা ছেড়ে জাল রুপির ব্যবসায় জড়িয়ে পরেছেন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় তার ডিলার রয়েছে। তিনি জাল রুপি তৈরি করার পর এসব ডিলারদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠান। তিনি ১ লাখ জাল রুপি ডিলারদের কাছে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করতেন। ভারতেও তার বিভিন্ন সহযোগী রয়েছে।

তাদের মাধ্যমে র‌্যাব-২ এর সিনিয়র এএসপি রবিউল ইসলাম জানান, শামসুল হককে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। তার দেয়া তথ্য ও গোয়েন্দা তৎপরতা চালিয়ে রাজশাহীর বোয়ালীয়া থেকে দরুদুজ্জামানকে আটক করা হয়। সেও জাল রূপি তৈরির দক্ষ কারিগর। জিজ্ঞাসাবাদে দরুদুজ্জামান এ বিষয়ে অনেক তথ্য দিয়েছেন।

জাল রূপি নিয়ে বিড়ম্বনার বিষয়ে গৃহবধূ শামীম আক্তার পুতুল ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, তার এক আত্মীয় ভারতে চিকিৎসার জন্য যান এ বছরের জানুয়ারির প্রথম দিকে। ভারতে গিয়ে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া রুপি দিয়ে বিল পরিশোধের সময় বিড়ম্বনায় পড়েন। রুপিগুলো ছিল জাল। পরে একই এলাকার চিকিৎসার জন্য যাওয়া অপর এক ব্যক্তির সাহায্যে উদ্ধার হন।

এর আগে এ বছরের ৮ এপ্রিল তেজগাঁওয়ে ভারতীয় জাল রুপির সন্ধান পাওয়া যায়। ওই দিন বিকেলে অভিযান চালানো হয়। সেখান থেকে জাল রূপি তৈরি করার সরঞ্জামসহ আটক করা হয় জাল রুপি ও কারিগরকে।

এছাড়া গেল আগস্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ অভিযান চালায় র‌্যাব-৫। সহড়াতলা এলাকার থেকে ভারতীয় জাল রুপিসহ ২ জাল মুদ্রা ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়। তারা হলেন-শিবগগঞ্জ উপজেলার পৌর এলাকার বাগানটুলির মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে মতিউর রহমান (৫৫) এবং তার ছেলে জয় রহমান (২৫)। এ সময় উদ্ধার হয় ৮ লাখ ৬ হাজার ভারতীয় জাল রুপি। রাণীহাটি-সোনামসজিদগামী মহাসড়কের পশ্চিমে সহড়াতলা গ্রামে সাজ্জাদ দারোগার আমবাগানের ভিতর থেকে জালরুপিসহ হাতেনাতে তাদেরকে আটক করা হয়। ওই সময় র‌্যাব সদর দফতরের আইন ও গণমাধ্যম শাখার সহকারী পরিচালক এএসপি মিজানুর রহমান ভুইয়া এ তথ্য জানিয়েছিলেন।

তিনি আরো জানান, তারা দীর্ঘদিন যাবৎ একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ভারতীয় জাল রুপি চোরাচালানের মাধ্যমে সংগ্রহ করে বিক্রয় করছে। এসব জাল রুপি অস্ত্র, মাদক ও অন্যান্য চোরাচালান সামগ্রী লেনদেনের জন্য ব্যবহার করা হতো। এছাড়া প্রধান টার্গেট গরু ব্যবসায়ীদের প্রতারিত করার জন্য ব্যবহার করছে। আটককৃত শিবগঞ্জ থানায় সোপর্দ করা হয়েছে।

এর আগে ২০১৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর র‌্যাব-৩ এর হাতে ধরা পরেন অপর এক নকল টাকার কারিগর। এই জাল টাকার কারিগর হলেন লিয়াকত আলী (৩৫)। ছোটবেলা থেকেই টাকা তৈরির স্বপ্ন দেখতেন বলে তিনি র‌্যাবকে জানিয়েছিলেন। তবে সে স্বপ্ন টাকা নকল টাকা তৈরির স্বপ্ন। তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ভারতীয় ১০ লাখ টাকার জাল রুপি। জাল রুপি তৈরির কাজে ব্যবহার করা ল্যাপটপ, মুদ্রা তৈরিতে ব্যবহৃত ছয়টি স্কিন ডাইস, দুটি ডাইস প্লেট, স্ক্যানার প্রিটার, জাল রুপির নিরাপত্তা সুতা সাত বান্ডেলসহ রুপি ছাপানোর কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্র।

ওই সময় র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এমরানুল হাসান জানান, জাল টাকা তৈরির স্বপ্ন পূরণ করতেই ১৯৯৬ সালে ছগির নামে এক জাল টাকা তৈরির ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয় হয়। ছগিরের সহযোগী হিসেবে লিয়াকত কাজ করতে থাকেন। একপর্যায়ে ছগিরের সঙ্গ ছেড়ে ২০০৭ সাল থেকে নিজেই কারিগর বনে যান। গড়ে তোলেন জাল টাকা তৈরির একটি বিশাল সিন্ডিকেট। লিয়াকত বাংলাদেশি টাকায় সুবিধা করতে না পেরে ভারতীয় টাকা ও মুদ্রা তৈরিতে ঝুঁকেন। এই জাল টাকা তৈরি করে লিয়াকত প্রতি মাসে আয় করতেন প্রায় তিন লাখ টাকা।

তিনি আরো জানান, ১১ ডিসেম্বর লিয়াকত কেরাণীগঞ্জের শুভাড্যা উত্তর পারা থেকে গ্রেফতার করে। ওই সময় জাহাঙ্গীর আলম (৪০) নামে তার এক সহযোগীকেও গ্রেফতর করা হয়। উদ্ধার করা হয় ১০ লাখ টাকা মূল্যের জাল রুপি। সে সময় উদ্ধার করা হয় নকল মুদ্রা তৈরির বিপুল সরঞ্জাম। কিন্তু জামিনে বের হয়ে এসেই আবারো নামে তার স্বপ্নের ব্যবসায়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে লিয়াকত জানিয়েছে, বাংলাদেশি জাল মুদ্রা বাজারজাত কারা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এ কারণে তিনি ভারতীয় মুদ্রা তৈরি করতেন। এই জাল টাকা তৈরির রঙিন কালি সরবরাহ করতেন গ্রেফতারকৃত তার সহযোগী জাহাঙ্গীর। পরে এসব জাল মুদ্রা স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে রাজধানীর বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জ এর মাধ্যমে বিক্রি করতেন। আর সীমান্তবর্তী এলাকায় সরবরাহ করতেন।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)