বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে যত কুসংস্কার

বিজ্ঞানের উন্নতির চরম শিখরে বাস করলেও মানুষ অনেক দিন ধরে চলে আসা কিছু বিশ্বাসকে সম্পূর্নভাবে উপেক্ষা করতে পারে না। উন্নত দেশ হোক বা অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে থাকা গরীব কোন জনপ্রান্তর, কুসংস্কারের খোঁজ একটুও মিলবে না, এমন জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই একবিংশ শতাব্দীতেও ডিম খেয়ে পরীক্ষা দিতে গেলে পরীক্ষা খারাপ হতে পারে, আবার দই মুখে দিয়ে বের হলে কাজে সফলতা আসবে এ ধরনের বিশ্বাস বা কুসংস্কার মেনে চলা হয়। বিশ্ব যতই বাস্তববাদী ও আধুনিক হোক না কেন মানুষ তার অনেক ধরণের বিশ্বাস ও বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা নিয়মকানুন বাদ দিতে পারবে না।

চারদিকে চলছে বিশ্বকাপ ২০১৮ নিয়ে নানা ধরনের উন্মাদনা। ছোট বড় কারও মাঝেই এই উন্মাদনার কোন কমতি নেই। কেউ সম্পূর্ন বাড়ি তার পছন্দের দলের পতাকার রঙে রঙ করে ফেলছে তো কেউ আবার তার আয়ের আয়ের একমাত্র সম্বল রিক্সাকে প্রিয় দলের পতাকা দিয়ে সাজিয়ে তুলছে। এই বিশ্বকাপকে নিয়েও মানুষ এর মাঝে কম কুসংস্কার কাজ করে না। চলুন জেনে নেয়া যাক বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে বিভিন্ন কুসংস্কার।

অক্টোপাস পলঃ
পল ওবারহাইসেনের একটি সি লাইফ সেন্টারে থাকত, তার পরিচালক ডেনিয়েল ফে’ই এর কাছ থেকে জানা যায়, ছোটবেলা থেকেই ও অন্য অক্টোপাসদের থেকে আলাদা আচরণ করতো। কোনো দর্শক ওকে দেখতে আসলে ও দর্শকের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকতো, যা কোনোভাবেই সাধারণ কোনো অক্টোপাসের দৃষ্টির সঙ্গে মেলানো যেতো না। তাই তখন থেকেই তারা চেষ্টা শুরু করলো পলের কোনো বিশেষ প্রতিভা আছে কিনা তা খুঁজে বের করতে। পলের প্রতিভা খুঁজে বের করতে তাদের খুব বেশি সময় লাগলো না। শিগগিরিই তারা আবিষ্কার করলো, জার্মানির কোনো ফুটবল খেলা থাকলে পল তার নিখুঁত ভবিষ্যতবাণী করছে। ২০০৮ সালের ইউরো চ্যাম্পিয়নস লীগের জার্মানির ৬টি খেলার ৪টিরই সঠিক ভবিষ্যতবাণী করেছিলো পল। আর এর সঙ্গে সঙ্গেই পল কেড়ে নিলো সবার দৃষ্টি।

জার্মানির খেলা থাকলে তার আগেরদিন পলকে দুটো প্লাস্টিকের বাক্সে খাবার দেয়া হত। একটিতে  থাকত জার্মানির পতাকা আঁকা, আর অন্যটিতে আঁকা থাকত বিপক্ষ দেশের পতাকা। পল যে বাক্সটি খুলে তার খাবার খায় ধরা হয় সেই বাক্সে আঁকা পতাকার দলটিই জিতবে এবং সে দলটি জিতেও যেত। এ পর্যন্ত সবাই ধারনা করে নেয় এটি কাকতালীয় কোন ঘটনাও হতে পারে। অবাক করার মত ঘটনা তখন ঘটে যখন ২০১০ সালের বিশ্বকাপ নিয়ে পল যা যা ভবিষ্যৎবাণী করেছিল তার সবকটি মিলে গিয়েছিল।

পল প্রথম সবাইকে অবাক করলো সার্বিয়ার সাথে ম্যাচের আগের দিন। জার্মানির পতাকা আঁকা বাক্স থেকে না খেয়ে সে খেলো সার্বিয়ার পতাকা আঁকা বাক্সের খাবার। সবাই তাচ্ছিল্যের হাসিই হেসেছিল। জার্মানির মতো হারবে সার্বিয়ার সাথে! কিন্তু আগের ম্যাচে দুর্দান্ত খেলা জার্মানি এদিন সার্বিয়ার কাছে হেরে গেলো ০-১ গোলে। তাচ্ছিল্যের হাসি ভুলে চোখ বড়ো বড়ো করে এবার সবাই নতুন করে পলের দিকে মনোযোগ দিলো। জার্মানির পরের ম্যাচ ২৩ জুন, ঘানার সঙ্গে। জার্মানিকে জিততেই হবে। নয়তো প্রথম রাউন্ড থেকেই বাদ পড়ে যেতে হতে পারে তাদের। এবারে পল জার্মানির পতাকা লাগানো বাক্স থেকে খাবার খেয়ে বলে দিলো, ভয় নেই। জার্মানি ঘানাকে হারিয়েই দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠবে। আর জার্মানিও ঘানাকে ১-০ গোলে হারিয়ে উঠে গেলো দ্বিতীয় রাউন্ডে। তখনো অবশ্য অনেকেরই সন্দেহ যায়নি। তাদের সন্দেহ দূর করার জন্যই হয়তো জার্মানির খেলা পড়লো গিয়ে ইংল্যান্ডের সঙ্গে। আর এবারে পল কোনোদিকে না তাকিয়ে বাক্সদুটো দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সাঁতরে জার্মানির পতাকা আঁকা বাক্স খুলে খাবার খাওয়া শুরু করলো। আর জার্মানিও ইংল্যান্ডকে ৪-১ গোলে বিধ্বস্ত করে উঠে গেলো কোয়ার্টার ফাইনালে।

সেমিফাইনালে হেরে গেলেও জার্মানি ৩য় স্থান নির্বাচনী ম্যাচ খেলে উরুগুয়ের সঙ্গে। সে ম্যাচে কি হবে জানার জন্য আবারও বাক্স পাঠানো হলো পলের কাছে। এবার পল বেছে নিলো জার্মানির পতাকা আঁকা বাক্সটিই। দ্বিতীয়ার্ধে ২-১ গোলে পিছিয়ে পড়েও শেষ পর্যন্ত ৩-২ গোলে জিতে বিশ্বকাপে আবারও তৃতীয় হলো জার্মানি। আবারও পল দেখিয়ে দিলো তার অনুমান টসের মতো ফিফটি-ফিফটি সম্ভাবনা নয়, সে জার্মানির খেলার সঠিক ভবিষ্যতবাণীই করে। শেষ পর্যন্ত ফাইনালে স্পেন এর বাটি থেকে খাবার খাওয়ার পর প্রথম বারের মত বিশ্বকাপ পেয়ে যায় স্পেন।

বিজ্ঞানমনস্ক ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রতিটি মানুষকেই নাড়া দিয়ে গিয়েছিল পল কিন্তু তাকে নিয়ে যত বৈজ্ঞানিক যত পরীক্ষা করা হয়েছে তার কোনটিই প্রমাণ করতে পারেনি যে পলের এমন কোন ক্ষমতা ছিল। তারপরেও পলকে অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা প্রাপ্ত অক্টোপাস হিসেবে মেনে নিয়েছিল হাজার হাজার মানুষ।

গ্যারি লিনেকারঃ
১৯৭৬ সালে লেস্টার সিটির ইয়ুথ টিমে যোগ দেয় লিনেকার, সে এত বেশিই ট্যালেন্টেড ছিল যে মাত্র দুই বছরে সে লেস্টারের মূল টিমের হয়ে খেলার সুযোগ পায় আর সে সুযোগ কাজে লাগাতে বিন্দুমাত্রও ভুল করেনি এই ব্রিটিশ ফুটবল লিজেন্ড। সেকেন্ড ডিভিশনে টপস্কোরার হয়ে লেস্টারকে ফাস্ট ডিভিশনে খেলার টিকেট এনে দেয় লিনেকার। ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপ ফুটবলে সর্ব্বোচ্চ গোলদাতা লিনেকার (১০ গোল)। ৬০০ ম্যাচে তাকে কখনো রেফারির হলুদ কার্ড বা সতর্কবার্তা ও শুনতে হয়নি।

আর এই সর্বোচ্চ গোলদাতাই কিনা বিশ্বাস করতেন যে তার ভাগ্যে গোল নির্দিষ্ট করা রয়েছে। সে যদি কোন গোল নষ্ট করে তবে তার ভাগ্য থেকে একটি গোল কমে যাবে। তাই তিনি ওয়ার্ম-আপ বা যেখানে গোল না নিলেও চলে এমন কোথাও গোল নিতেন না। তা না হলে তার সীমিত গোলের ভাগ্যে ঘাটতি পড়ে যেতে পারে বিশ্বকাপের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোতে।

পেলেঃ
ব্রাজিলিয়ান এই খেলোয়াড় একবার তার এক ভক্তকে জার্সি উপহার দিয়েছিলেন। তার পর থেকেই তার মনে হতে থাকে সে আর খেলতে পারছেনা। এ থেকে তার মনে হতে থাকে জার্সিটি তার লাকি চার্ম বা সৌভাগ্যের প্রতীক। সে যদি তার হারানো জার্সি খুঁজে পায় তবেই সে আবার আগের মত খেলতে পারবে। পেলে তার এক বন্ধুকে দায়িত্ব দেয় যেভাবেই হোক এ জার্সিটি খুঁজে বের করার জন্য। সপ্তাহ খানেক খোঁজার পর অবশেষে বন্ধুটি তার জার্সি ফিরিয়ে দেন এবং পেলেও আগের মতই কিংবদন্তী হয়ে ওঠে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে পেলের বন্ধুটি ঐ জার্সিটি খুঁজে পায়নি। তার বদলে সে ঠিক তেমনই একটি জার্সি যোগাড় করে দিয়েছিলেন। আর সেটিকে সত্যি ভেবে নিয়েই পেলে তার হারানো আত্মবিশ্বাস খুঁজে পেয়েছিল আবার বিশ্বকাপ খেলার জন্য।

ববি মুরঃ
তার বিশ্বাসের জায়গাটি ছিল খুব অদ্ভুত। ড্রেসিং রুমে সবার শেষে শর্টস পড়তেন তিনি। তিনি মনে করতেন এতে খেলার সময় তাদের দলের উপর সৌভাগ্য বজায় থাকে। তার সাথেরই আরেক খেলোয়াড় মার্টিন পিটারস অবশ্য বাগে পেলে ছাড়তেন না মুরকে। যখনই মুর সবার শেষে তার শর্টসটা পরে নিতেন, পিটার তখন খুলে ফেলতেন তার নিজেরটা। যাতে করে মুর সর্বশেষ হতে না পারেন। বলা বাহুল্য, মুরকেও সর্বশেষ হওয়ার জন্য বাধ্য হয়ে নিজের শর্টস আবার খুলতে হত।

জন টেরিঃ
২০০৬ সালের ফিফা বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের প্রতিনিধিত্ব করছেন। সাবেক এই ইংল্যান্ড অধিনায়ক এবং চেলসির সেন্টার-ব্যাক জন টেরি মাঠের সৌভাগ্যের প্রত্যাশায় সব সময় টিম বাসের একই সিটে বসেন, প্যাডের চারিদিকে তিনবার করে টেপ আঁটেন, অনুশীলনে যাওয়ার সময় গাড়িতে একই গান শুনে থাকেন এবং গাড়িটি পার্কিংয়ের একই জায়গাতেই পার্ক করে থাকেন। এমনকি বার্সেলোনার সঙ্গে চ্যাম্পিয়নস লিগের একটি ফিরতি ম্যাচে হারিয়ে ফেলার আগ পর্যন্ত একই শিন প্যাড ১০ বছর ধরে ব্যবহার করেছেন! এই ২৯ বছর বয়সী বর্তমানে তার চেলসি সতীর্থ ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের কাছ থেকে ধার করা এক জোড়া ‘লাকি’ প্যাড ব্যবহার করছেন।

সার্জিও গয়কোচিয়াঃ
আইরিশের আন্তর্জাতিক গোলরক্ষক শে গিভেন খেলা চলাকালীন সময়ে এক বোতল ‘হলি ওয়াটার’ গোল পোস্টের পাশে রেখে দিতেন। আরেক গোলরক্ষক প্যাকি বোনারও জন্মস্থানের মাটি রেখে দিতেন তাঁর গ্লাভস ব্যাগে। এতে নাকি তারা বেশি গোল আটকাতে পারতেন। বিখ্যাত আর্জেন্টাইন গোলকিপার সার্জিও গয়কোচিয়া বিভিন্ন ম্যাচে পেনাল্টি শট ঠেকানোর জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। আর এ পেনাল্টি ঠেকানোর জন্য তিনি যে কুসংস্কারটি বিশ্বাস করতেন তা পাগলামি ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।

পেনাল্টি শুটআউটের পূর্বেই গয়কোচিয়া মাঠে মূত্র ত্যাগ করতেন এবং ঠেকিয়ে দিতেন পেনাল্টি। তার বক্তব্য অনুযায়ী সে প্রথমে এটি বাধ্য হয়ে করলেও, সে আস্তে আস্তে প্রমাণ পেয়েছে যে এর সত্যতা রয়েছে। ‘আপনারা জানেন খেলাটির নিয়ম অনুসারে ম্যাচ শেষ হবার আগে আপনি মাঠ ত্যাগ করতে পারেন না। এবং আপনার যদি কোনো ‘জরুরি শারীরিক তাড়া’ থাকে, তবে আপনাকে মাঠের পাশেই কাজ সারতে হবে। ঠিক এই ঘটনাটিই ঘটেছিল যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে (১৯৯০ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে)। খেলার শেষদিকে আমার সত্যিই প্রচণ্ড চাপ দেখা দিয়েছিল। মাঠের পাশেই এটা করা ছাড়া কোনো গতিও ছিল না। এবং আমরা জিতে গেলাম। তাই সেমিতে ইতালির বিপক্ষে ম্যাচটিও যখন পেনাল্টিতে গেল আমি আবারও একই কাজ করলাম এবং এটা আবারও কাজে দিল। এর পর থেকে আমি প্রতি শুটআউটেই এটা করতাম। এটা ছিল আমার সাফল্যের মূলমন্ত্র!’

রোমিও আনকন্তানিঃ
বিপদে লবণ ছিটালে নাকি খুব দ্রুত সে বিপদ কাটিয়ে উঠা যায়। আর ঠিক এ কাজটিই করেছিলেন সাবেক পিসা প্রেসিডেন্ট রোমিও আনকন্তানি। প্রতিটি ম্যাচের আগে রোমিও নিজ মাঠ অ্যারেনা গ্যারিবল্ডিতে ইচ্ছেমতো লবণ ছিটাতেন। এতে নাকি সব প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে ম্যাচ জয়ের পথ সুগম হতো। ম্যাচ যত গুরুত্বপূর্ণ হবে, লবণের পরিমাণও ততই বাড়বে। একবার প্রতিদ্বন্দ্বী সেসেনার সঙ্গে বেশ গুরুত্বপূর্ণ এক ম্যাচের আগে আনকন্তানি ২৬ কেজি পর্যন্ত লবণ ছিটানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। এ থেকে বোঝা যায় যে এই কুসংস্কারের প্রতি তার বিশ্বাস কতটা তীব্র ছিল।

ইকার ক্যাসিয়াস :
স্পেনের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক তিনি। দীর্ঘদিন সামাল দিয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদের গোলবার। ক্লাব ও জাতীয় দলে অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন অনেকদিন। কুসংস্কার মানার দিক থেকেও খুব বিখ্যাত বর্তমানে পোর্তোতে খেলা এই গোলরক্ষক। ইকার ক্যাসিয়াসের অন্যতম বড় একটি কুসংস্কার হল তিনি মাঠে নামার সময় দুই পায়ের মোজা উলটো করে পড়েন। তাছাড়া তার দল গোল করলে প্রতিবার দুই হাত উঁচিয়ে গোল বার স্পর্শ করেন। আরেকটি মজার বিষয় কোন ম্যাচ হেরে গেলে সেই ম্যাচের জার্সিটি আর গায়ে চাপান না।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)