ঈদে মেহেদি দেয়ার প্রচলন এলো যেভাবে

আমাদের দেশে যেকোনো উৎসবে মেহেদির রঙে হাত সাজানো খুব জনপ্রিয় একটি রীতি। ধর্মীয় যেকোনো উৎসব থেকে শুরু করে বিয়ে-জন্মদিন সহ নানা অনুষ্ঠানে মেহেদির রঙে হাত না রাঙালে অনেকের কাছেই উৎসবের পরিপূর্ণতা পায় না।

মেহেদি গাছের গাঢ় সবুজ রঙের পাতা থেকে যে মিষ্টি গন্ধের টকটকে লাল নির্যাস বের হয়, সেটা সবার মন কেড়ে নেয়। আর উৎসবে বিশেষ করে ঈদ হলে তো কথাই নেই। বিয়েতে বর কনের হাতে মেহেদি থাকা চাই-ই চাই।

নিশাত ইয়াসমিন তার একমাত্র ছোট মেয়েকে নিয়ে মেহেদির রঙে হাত সাজাতে এসেছেন রাজধানীর এক বিউটি পার্লারে। তিনি জানান, মেহেদি না দিলে তার ঈদের আনন্দ পরিপূর্ণতা পায় না।

ইয়াসমিন বলেন, ‘ঈদের সময় আমরা সবাই চাই সুন্দর হয়ে সাজতে। আর মেহেদি আমাদের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়। এ কারণেই মেহেদিটা পরি। এতে ঈদের আনন্দটাও বেড়ে যায়।’

মেহেদি পাতা বেটে, শুকিয়ে, গুড়া করে বা পেস্ট করে শরীরের বিভিন্ন স্থান রাঙানোর ইতিহাস বহু পুরনো। তবে ঠিক কবে কোথায় মেহেদির আবিষ্কার হয়েছিলো তার সঠিক দিনক্ষণের ব্যাপারে কোনো তথ্য মেলেনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক তৌহিদুল হক জানান, লিখিত কোন দলিল না থাকলেও ইসলামের নবী হযরত মোহাম্মদ (স.) এর মেহেদি ব্যবহারের তথ্য মুসলমানদের এই মেহেদি ব্যবহারের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে। পরে ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্য এই মেহেদি দেয়ার প্রথাকে আরো প্রসারিত করে।

তিনি বলেন, মেহেদি ব্যবহারের ক্ষেত্রে হযরত মোহাম্মদ (স.) এর একটি উক্তি রয়েছে। এই বিষয়গুলোর ওপর নির্ভর করে এই ভারতীয় উপমহাদেশে এক সময় মেহেদির ব্যবহার শুধু মুসলিম জনগোষ্ঠী বা মুসলিম সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে মুঘল সাম্রাজ্যের জনগণ এটাকে প্রসারিত করে।

মেহেদির দেয়ার কারণে কখনো কোনো অ্যালার্জি বা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার নজির না থাকায় যুগে যুগে এর জনপ্রিয়তা একবিন্দু কমেনি, বরং বেড়েছে। বরং, অনেকেই চামড়ার বিভিন্ন রোগের জন্য হারবাল ওষুধ হিসেবেও ব্যবহার করছে এই মেহেদি।

রাজধানীর বিভিন্ন বিউটি পার্লারগুলোতে রয়েছে মেহেদি দেয়ার জন্য বিশেষায়িত বিউটিশিয়ান। তারা শুধু মেহেদি দেয়ার কাজ করেন।

তাদেরই একজন জানান, শুধু ঈদ না, সারা বছর জুড়ে নানা ধর্মের মানুষ আসে মেহেদি দিয়ে হাত রাঙাতে। সেজন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ নিতে হয় তাদের।

তিনি বলেন, ‘গ্রাহকরা সুন্দর সূক্ষ্ম ডিজাইন চায়। অনেকে মোবাইলে ডিজাইন ডাউনলোড করে আনে। হাত ছাড়াও পায়েও অনেকে ডিজাইন করেন। কেউ কেউ মেহেদি দিয়ে ট্যাটুও করেন। কারো পছন্দ এক লাইনের ডিজাইন। আবার অনেকে পুরো হাত ভরে মেহেদি দেন। একেকজনের পছন্দ একেক রকম। আমরা ৫-৬ ঘণ্টা বসে টানা মেহেদি দিতেই থাকি। ঈদে তো মেহেদি দেয়া হয়ই। তবে বিয়েতে এটা থাকতেই হয়। বউয়ের হাত মেহেদি রাঙ্গানো না হলে বিয়েটা পূর্ণ হয় না। বউ বউ লাগে না।’

বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে মেহেদির ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এবং আফ্রিকায় যেসব দেশের ভাষা আরবি, সেসব দেশেও ব্যবহৃত হয় এই মেহেদি।

অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মেহেদি ব্যবহার হচ্ছে কিন্তু এর কারণ বা উদ্দেশ্য স্থানভেদে ভিন্ন।

তিনি জানান, ‘শুরুতে মেহেদির প্রচলন ধর্মীয় দৃষ্টিকোণের জায়গা থেকে শুরু হলেও পরে এই প্রথাটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় পেয়েছে। তবে এখন মানুষ এখন এটাকে সার্বজনীন রূপে গ্রহণ করেছে। তবে একেক দেশে একেক ধরনের কারণ আর উদ্দেশ্যে মেহেদি ব্যবহার হয়।’

ইতিহাসের বইগুলোয়, মিসরের ফারাও সাম্রাজ্যে মমির হাতে ও পায়ের নখে মেহেদির মতো রঙ দেখা যায়। তবে সেটা মেহেদি দিয়ে রাঙানো কিনা সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

আবার বর্তমান যুগে বিভিন্ন ধর্মের বিয়ের উৎসবে মেহেদি সন্ধ্যা নামে আলাদা একটি দিনের আয়োজন করা হয়; যেখানে বর কনে থেকে শুরু করে পুরো পরিবার মেতে ওঠে মেহেদির রঙে নিজেকে রাঙিয়ে তুলতে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)