‘আকাম থেকে আবিষ্কার’

ডেস্ক রিপোর্ট:

‘খেলাধুলা আমার কখনোই ভালো লাগতো না। বাড়িতে বসেই এটা-সেটা করে সময় কাটত। পরিত্যক্ত যা কিছু পেতাম তা থেকেই নতুন কিছু করার চিন্তা থাকত সব সময়। সবাই বলতো ‘আকাম’ করে। আমি গা করতাম না। ওতেই পেতাম আনন্দ।’

কথাগুলো বলছিলেন তরুণ বিজ্ঞানী তৌহিদুল ইসলাম তাপস। যিনি পরিত্যক্ত পলিথিন থেকে আবিষ্কার করেছেন তেল, এলপি গ্যাস ও কার্বন। তার ভাষ্যমতে, ‘আকাম করতে করতেই এ আশ্চর্যজনক আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে।’

২৫ বছর বয়সী এ তরুণ উদ্ভাবক এরইমধ্যে জয় করেছেন বিশ্ব। সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ইনভেনশন, ইনোভেশন অ্যান্ড টেকনোলজি এক্সিবিশন (আইটেক্স)-২০১৮ এ অংশ নিয়ে অর্জন করেছেন স্বর্ণ পদক। এরআগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রামে অংশ নিয়ে দেশের সেরা উদ্ভাবক স্বীকৃতি পান। পরীক্ষামূলক প্লান্ট স্থাপনের এটুআই প্রকল্পের ফান্ড থেকে সাড়ে ৬ লাখ টাকা আর্থিক অনুদান দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বর্জ্যশোধানাগার কেন্দ্রের পাশে জমি বরাদ্দ দিয়েছে জামালপুর পৌরসভা।

জামালপুর সদরের কেন্দুয়া ইউনিয়নের কোজগড়ের মঙ্গলপুরে তৌহিদুলের বাড়ি। তার বাবার নাম আবদুল মান্নান ও মা হালিমা খাতুন। মায়ের উৎসাহ তাকে এগিয়ে নিয়েছে বলে জানান তাপস।

তিনি বলেন, ১০ বছর বয়সে বাড়ির আঙিনায় ফুলের বাগান করি। হঠাৎ লক্ষ্য করি একটি গাছ ঠিকমত বাড়ছে না। কেমন অষাঢ় হয়ে আছে। আবার ঠিক মরছেও না। গাছটির প্রতি যত্ন বাড়িয়ে দেই। এতেও কাজ না হলে গোড়ার মাটি খুঁড়ে দেখি শিকড়গুলো একটি পলিথিনের কাছে গিয়ে বিবর্ণ হয়ে দলা পাকিয়ে আছে। পলিথিন সরালে তাজা হয়ে হয়ে ওঠে গাছটি। গ্রামে অনেক পলিথিন ছড়ানো-ছিটানো থাকে। সমস্যাও তাই পিছু ছাড়ে না। পলিথিন ধ্বংস করতে পোড়াতে থাকলাম। কিন্তু চতুর্থ শ্রেণির বিজ্ঞান বইতে পেলাম, ‘কালো ধোঁয়া পরিবেশ দূষণ করে। আমার চিন্তা হলো, পলিথিন পোড়ালেও তো কালো ধোঁয়া হয়। তাহলে কীভাবে পরিবেশের ক্ষতি না করে পলিথিন ধ্বংস করা যা

তাপস বলেন, চিন্তাটা সারাক্ষণই আমাকে তাড়া করতো। এরইমধ্যে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। কলেজের রসায়নের প্রভাষক ইকরামুজ্জামান স্যারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি। তার পরামর্শে কলেজের গবেষণাগারেই শুরু করি গবেষণা। একপর্যায়ে বিজ্ঞানাগার থেকে এসিড, টেস্টটিউব সবশেষে বিজ্ঞানাগারের চাবি দিয়ে দেন। দিনের পর দিন রাতের পর রাত গবেষণায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করি। চিন্তা ও জ্ঞানের সঙ্গে ব্যবহারিক বিষয়টিও মেলানোর চেষ্টা করতে থাকি। দীর্ঘ গবেষণার পর আসে সফলতা।

তরুণ এ বিজ্ঞানী বলেন, পলিথিন চেম্বারে নিয়ে উচ্চ তাপমাত্রায় (৭০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে) উত্তপ্ত করার সময় পলিথিন যখন তরল হয়, তখন স্ববিভাজন বিক্রিয়া ঘটে। স্ববিভাজন বিক্রিয়া ঘটার পর জ্বালানি তেলের বাষ্প সৃষ্টি হয় এবং সেখানে প্রচণ্ড চাপের সৃষ্টির ফলে জ্বালানি তেলের বাষ্প খুব দ্রুত অন্য একটি শীতল চেম্বারে চলে আসে। পরে তা ঠান্ডা হয়ে তরল হয়ে যায় আর মিথেন বা এলপি গ্যাস ও জ্বালানি তেল পৃথকভাবে নিজ নিজ চেম্বারে চলে যায়। তরল জ্বালানি ও এলপি গ্যাস বের হওয়ার পর সেখানে অনেক মুক্ত কার্বন তৈরি হয়, যা পরে ছাপার কাজে কালি হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

প্রধানমন্ত্রীর অনুদানের টাকায় তাপস পরীক্ষামূলকভাবে ১৫০ কেজি সাপোর্টের একটি প্ল্যান্ট বসিয়েছেন। এই পলিথিন থেকে ১০৫ লিটার পেট্টোল, ডিজেল ছাড়াও এলপি গ্যাস উৎপাদন হবে। দিনে তিনবার এভাবে তেল সংগ্রহ করা যাবে। এতে প্রতিদিন ৩১৫ লিটার পেট্টোল, ডিজেল, এলপি গ্যাস ছাড়াও পাওয়া যাবে কার্বন কালি। সরকার যদি সহযোগিতা করে, তাহলে প্রতিদিন ৫ হাজার সাপোর্টের একটি প্ল্যান্ট করে দেশকে পলিথিনমুক্ত করা এবং তেলের জ্বালানি সাপোর্ট দেয়া সম্ভব হবে বলেও জানান তিনি।

‘এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন আগ্রহ প্রকাশ করেছে বাণিজ্যিকভাবে এই জ্বালানি তেল উৎপন্ন করার। তবে আমি মনে করি, কেবল অর্থ উপার্জন নয়। পলিথিন ধ্বংস করে পরিবেশ রক্ষা করাই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে যদি কেউ এ কাজ করতে চায় তবে আমিও তাদের সঙ্গে কাজ করতে চাই।’- বললেন তাপস।

জামালপুর সদরের কেন্দুয়া ইউনিয়নের কোজগড়ের মঙ্গলপুরে তৌহিদুলের বাড়ি। তৌহিদুল ২০০৯ সালে জামালপুর সদর উপজেলার নারিকেলি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও শহীদ জিয়াউর রহমান ডিগ্রি কলেজ থেকে ২০১১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন।

এরপর জামালপুর কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং পলিটেকনিক থেকে ডিপ্লোমা ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে উত্তীর্ণ হন।

শহীদ জিয়াউর রহমান ডিগ্রী কলেজের প্রভাষক মো. ইকরামুজ্জামান বলেন, তাপসের ইচ্ছা, একাগ্রতা, উদ্ভাবনী প্রতিভা দেখে নানাভাবে সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি। পরিত্যক্ত পলিথিন থেকে তেল, গ্যাস ও কার্বন কালি তৈরির প্রকল্পের পাশে সরকারসহ বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।

জামালপুর পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের সভাপতি জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, পরিবেশ রক্ষায় আমরা অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেও সেভাবে সফলতা পাইনি। পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ এই পলিথিন। পলিথিনের কারণে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। তাপসের এ আবিষ্কারের ফলে পলিথিন সমস্যার সমাধান হবে। একইসঙ্গে অনেকের কর্মের সুযোগ হবে। সরকারের ভিক্ষুকমুক্ত দেশ গড়ায়ও এ প্রকল্প কাজে আসবে। ভিক্ষুকের হাত রূপান্তরিত হবে পলিথিন কুড়ানোর হাতে। তারা প্রতিনিদ পরিত্যক্ত পলিথিন কুড়িয়ে বিক্রি করবে। যা দিয়ে তৈরি হবে তেল, গ্যাস ও কার্বন। রক্ষা পাবে পরিবেশ। উন্নত হবে দেশ।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)