পড়ে থাকা ঝুট ইফতারেই যেন তৃপ্তি

ডেস্ক রিপোর্ট:

কখনো টোকাই কখনো পথশিশু কখনোবা পথকলি। কত নামই না তাদের পরিচয়। সময়ের সঙ্গে যাদের পাল্টায় নাম, তারা হলো অসহায় ছিন্নমূল শিশু। শত দুঃখ কষ্টে পরিচয়হীনভাবে জন্ম নেয়া এসব শিশুদের বসবাস ফুটপাতে। অল্পতেই এরা বুঝতে শেখে জীবন সম্পর্কে। তাই অজান্তে কখনো কখনো তাদের ভাবনায় ধরা দেয় প্রশ্ন- জন্মই যেন আজন্ম পাপ! প্রতিদিনের দুঃখ কষ্টে শক্ত হয়ে গেছে তাদের কমল হৃদয়ও।

রমজানে রাজধানী জুড়ে থাকে ভাসমান ইফতারির দোকান। হরেক রকমের ইফতারের পসরা সাজান দোকানীরা। তাদের ক্রেতা মূলত আশে-পাশের দোকানী, কর্মজীবী, পথচারী, ভাসমান মানুষ অথবা বাসায় ফেরত যানজটে আটকাপড়া রোজাদারা। কিন্তু এসবের বাহিরেও অজানা থেকে যায় কিছু হৃদয় কাঁপানো দৃশ্য। যাদের দেখেও আমরা অনেকেই না দেখার ভানধরে, পাশ কেটে চলে যাই। এরাই হলো ছিন্নমূল শিশু। নেই তাদের সঠিক নাম-পরিচয়, নেই বাবা-মা। যাদের সকাল-সন্ধ্যা সবই যেন কাটে হয় ফুটপাত, না হয় ওভারব্রীজ অথবা খোলা আকাশের নিচে পার্কের বেঞ্চে।

সারাদিন এখানে ওখানে পড়ে থেকে ইফতারের ঘন্টাখানেক আগে ২/৩ জনে দল বেধে নেমে পরে ইফতার কুড়াতে। কখনো খেতে হয় মার, কখনো শুনতে হয় বকাঝকা ও গালমন্দ- এ যেন নিত্য উপহাস। এতো কিছুর পরও ইট পাথরের এই শহরে ধনীদের মত না হলেও, কুড়িয়ে নেয়া একটু খানি ইফতারের সাধই যেন তাদের প্রাণের তৃপ্তি।

শুক্রবার ছুটির দিন। কাওরানবাজার পেট্রোবাংলার পাশে জড়ো হয় বেশকিছু পথশিশু। এখানেই ইফতার করবে তারা। অপেক্ষা করছে সঙ্গে যোগ হবে আরো কয়েকজন। যারা আসবে তারা কোথায় জানতে চাইলে মুন্না নামের এক পথশিশু জানায়, “কেউ ইফতারের আগেই আইয়্যা পড়ব, কেউ  আইবো পরে।” পরে আসার কারণ জানতে চাইলে রনি নামের আরেকজন বলে, “ওরা রোজা রাহে নাই। ইফতার শ্যাষ কইর‌্যা কেউ কেউ খাবার রাইখ্যা দ্যায় সেইগুলা লইয়্যা হ্যারা আইবো। হেরপর আমরা সবাই মিইল্যা ইফতার খামু। ”

হঠাৎ চোখে পড়ে, কয়েকজনের হাত পেছনে রেখে নাড়াচাড়া করছে। কি যেন আছে হাতে। আন্দাজ করে জিজ্ঞাস করলাম- কোথায় পেলে ছোলা, মুড়ি পেঁয়াজু? সহজ সাপ্টা উত্তর রনি’র, মাইনসের দোহানে চাইয়্যা এইসব নিয়া আইছি। দোহানদাররা সহজে আমাগো ইফতার দিতে চায় না। দোহানের সামনে গেলে, ধমক দিয়া তাড়াইয়্যা দেয়। হেরা আমগো গালিও দেয়, টোকাইয়ের  বাচ্চা কইয়া। রোজা রাখছি- কইলে অনেকে কয়ডা ইফতার দেয়।” রোজা রাখতে সেহরি খাও কীভাবে জানতে চাইলে সে জানায়, “রাইতের বেলা খুঁইজ্যা খুঁইজ্যা কটা ভাত তরকারি নিয়া আই। এইসব রাতে না খাইয়্যা ভোর রাইতে খাই। কী করমু কন? মুসলমান হইয়্যা জন্ম নিছি রোজা তো রাখতেই অইবো। অহন আপনি কন, আমরা টোকাই হেইড্যা কি আমগো দোস?” ফিরতি এমন প্রশ্নে কোন উত্তর নেই! ধুলোবালি মাখা কোমল চেহারা ক’টার দিকে ফেল ফেল তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না।

মা-বাবার পরিচয় জানতে চাইলে কেউই, তা বলতে রাজি হয় না। উল্টো রনি রেগে গিয়ে বলে, ভাই ম্যালা কথা কইছেন, আর কথা কইয়েন না আপনি অহন যান। কাম আছে। আমাগো পরিচয় দিয়া আপনার কী কাম? তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে অন্যরা বলে “ভাই আমরা রোজা রাখছি, সারাদিন ঘুইড়্যা এহন আর ফাও প্যাচাল পারতে ভাল লাগতাছে না। আপনি চইল্যা যান।”

নিরাশ হয়ে ছোট ছোট পায়ে কারওয়ান বাজার ছেড়ে ফার্মগেটের পথে। ফার্মগেট পার্কের মাঝামাঝি ফাঁকা জায়গায় ৮-১০ জন ছোট্ট ছোট্ট ছিন্নমূল ছেলে-মেয়ে বসে আছে গোল হয়ে। আবারো কৌতহল জাগলো কথা বলার। জানি এবারও হয়তো শুনতে হবে কঠিন বাস্তবতার কড়া কিছু কথা। তারপরও মন টানছে নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধের তাগিদে। কাছে গিয়ে নাম জিজ্ঞেস করলে, একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকায় আর মুচকি হাসে। চেহারা দেখে বুঝতে এতটুকু কষ্ট হওয়ার নয় যে, ওরা সবাই রাজপথের ছিন্নমূল শিশু। নোংরা-ছেঁড়া জামা-কাপড় পরা এসব পথশিশুর এক একটি দিন পার হয় অতিকষ্টে। সবার বয়স ৪ থেকে ১১ বছরের মধ্যে।

শুধু এসব এলাকাতেই নয়; বৃহস্পতিবার নগরীর গুলিস্তান, কমলাপুর রেলস্টেশন, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম, হাতিরঝিলসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রাস্তা ও ফুটপাতের ওপর কাগজে মুড়ি, ছোলা, পেঁয়াজু মিশিয়ে ইফতারের অপেক্ষায় পথশিশুরা। আযান না হওয়া পর্যন্ত ইফতার ঘিরে জমজমাট আড্ডায় মেতে উঠে তারা। কি যেন এক অন্যরকম আনন্দ সবার চোখে-মুখে। যা হয়তো লাখ টাকা দিয়েও পাওয়া যাবে না।

ফুটপাতে শুধুই কি পথশিশু করে ইফতার? না তা নয়। শুক্রবার শাহবাগ, দোয়েল চত্বর, পল্টন, মতিঝিল, ফকিরাপুল, কাকরাইল, শান্তিনগর এলাকা ঘুরে দেখা যায় চলন্ত পথের পেশাজীবী  মানুষ বাধ্য হয়ে রাস্তায় বসেই করছেন ইফতার। কোথাও একজন আবার কোথাও কয়েকজন মিলে সাড়ছেন ইফতার।

কারণ হিসেবে একজন বেসরকারি চাকরিজীবি এহসান আলী  বলেন, ভাই বলার কোন ভাষা নেই, আমার অফিস শেষ হয়েছে সাড়ে ৩টায়। বাসা এয়ারপোট এলাকায়। আমি অনায়াসে বাসায় গিয়ে পরিবার নিয়ে ইফতার করতে পারি। মতিঝিল থেকে এয়ারপোট যেতে ঘন্টা খানিক লাগে। কিন্তু যানজট আমাকে নামিয়েছে রাস্তায়। আসলে কি কোনো দিন শেষ হবে না, রাজধানীর যানজট? প্রশ্ন রেখে যান তিনি।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)