৩০ বছর স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছে সাতক্ষীরার তালার পানি কমিটি

ইয়ারব হোসেন: পানি কমিটি একটি নাগরিক কমিটি। জলাবদ্ধতা ও পরিবেশ রক্ষাসহ নদী-নালা সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে দীর্ঘ ৩০ বছর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় এ কমিটি স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করে আসছে। সাতক্ষীরার তালা উপজেলা সদর পানি কমিটির মূল কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বিগত শতাব্দীর আশির দশকে গঠিত এ কমিটি বর্তমানে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের সচেতন নাগরিক সমাজের একটি প্রাণের প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠেছে। সমগ্র জলাভূমি এলাকা বিশেষ করে খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার নিম্নাংশ অর্থাৎ উপকূলীয় এ এলাকার জলাভূমি তথা পরিবেশ সংরক্ষণের মাধ্যমে নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উক্ত কমিটি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠির সক্ষমতা বিকাশে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা, বিশেষভাবে জলাভূমির জীববৈচিত্র সংরক্ষণ করা, পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা, সুন্দরবন রক্ষাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডে জনগণের অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাশ্রম অব্যাহত রেখেছে। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে অত্র এলাকার জনগণ একটি কমিটি গঠন করে। উক্ত কমিটির সক্রিয় ভূমিকার কারণে কোন রকম সংঘাত-সংঘর্ষ ছাড়াই সফলতার সাথে পানি নিষ্কাশিত হয়। জলাবদ্ধতা নিরসনে গঠিত উক্ত কমিটি পরবর্তীতে পানি কমিটি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

পানি কমিটি উপকূলীয় ১১টি উপজেলায় ও উক্ত কমিটির সমন্বয়ে ১টি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করে দীর্ঘ সময় ধরে দক্ষতার সাথে নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। উপকূলীয় এ অঞ্চলের নদ-নদী রক্ষায় অবাধ জোয়ারভাটা (Tidal River Management-TRM) বাস্তবায়নে ন্যায় সংগত দাবী, দাবীর পক্ষে আন্দোলন ও সরকারের স্বীকৃতি প্রদানে পানি কমিটির ভূমিকা অপরিসীম। উপকূলীয় জনপদ রক্ষায় নদী অববাহিকায় টিআরএম অন্তর্ভূক্ত করে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে Asian Development Bank-ADB প্রধানের সাথে বৈঠক, এডিবি প্রধান কর্তৃক সরকারের টিআরএম কার্যক্রমের উপর সমীক্ষার পরামর্শ প্রদান, সমীক্ষা বাস্তবায়নে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান ঈঊএওঝ কে দিয়ে পরিচালিত সমীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সরকারের টিআরএম কার্যক্রম গ্রহণ করা এবং তা বাস্তবায়নে হাইকোর্টের রায় প্রকাশ পানি কমিটির এক অনন্য সফলতা।

তালা উপজেলার পাখিমারা বিলে টিআরএম চলমান অবস্থায় বিল অধিবাসীদের জমির ফসলের ক্ষতিপূরণের দাবীর পক্ষে বিভিন্ন সভা, সেমিনার, রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স, সংবাদ সম্মেলনসহ বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের স্বীকৃতি প্রদান ও বাস্তবায়ন পানি কমিটির গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। এ ছাড়া পানি কমিটি উত্তরণ এর সহায়তায় গত দশকে কপোতাক্ষ অববাহিকার ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দূরীকরণে টিআরএম কে সংযুক্ত করে প্রকল্প গ্রহণের জন্য বিভিন্ন জনসম্পৃক্ত কর্মসূচী বাস্তবায়ন এবং সরকারের জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প গ্রহণও একটি অন্যতম সফলতা। এছাড়া দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল অঞ্চলের ১১টি নদী অববাহিকার সমস্যা ও সমাধান বিষয়ক রিভার ম্যানেজমেন্ট পরিকল্পনা প্রকাশে উত্তরণ, সিইজিআইএস ও আইডব্লিউএমকে পানি কমিটি পূর্ণ সহযোগিতা করে। এ অঞ্চলের জলবায়ু ও পরিবেশ বিষয়ে নদী ভিত্তিক বিভিন্ন পরিস্থিতি রিপোর্ট, মিটিং, ওয়ার্কশপ, সেমিনার, রাউন্ড টেবিল, সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদানের মাধ্যমে জনগণের মতামত সংগ্রহ পূর্বক জনগণের পরিকল্পনা প্রকাশ এবং তার উপর ভিত্তি করে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রকল্প প্রণয়নে সহায়তা করে। তাছাড়া পানি কমিটি উত্তরণ এর সহায়তায় পোষ্টার, লিফলেট, পত্রিকা বিজ্ঞপ্তি, বিলবোর্ড প্রদর্শনীর মাধ্যমে পরিবেশ সহনশীল দাবী প্রচার করে নাগরিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছে।

বিভিন্ন দিবস পালন, নীতি নির্ধারণী কর্মকর্তা, সংবাদকর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীসহ দেশী বিদেশী প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন, নদীখনন ও টিআরএম বাস্তবায়নে সহায়তামূলক তদারকি কার্যক্রম, জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোতে উত্তরণ এর অর্থ সহায়তা কার্যক্রম বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা, টিআরএম প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার ও জনগণকে সহায়তা প্রদান, বিভিন্ন দূর্যোগে ত্রাণ ও পুনর্বাসনে সহযোগিতা প্রদান, জলাবদ্ধতা সমাধানে বিকল্প নিষ্কাশন ব্যবস্থা বাস্তবায়নে অংশগ্রহণ করা এবং এ অঞ্চলের সকল এনজিও নেটওয়ার্কের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার মাধ্যমে পানি কমিটি দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি এলাকায় ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। সুদীর্ঘ সময় ধরে জনপদ রক্ষায় জনগুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রদানে জনগণের পক্ষে ন্যায় সংগত প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখার কারণে সরকারের বিভিন্ন কমিটিতে পানি কমিটির সদস্য অন্তর্ভূক্তি করা হয়ে থাকে। এ অঞ্চলে পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতি, অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলে সঠিকভাবে ভুমিকা রাখার মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে পানি কমিটি।

তালা উপজেলা পানি কমিটির সাধারণ সম্পাদক মীর জিল্লুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের সকল নদ-নদী রক্ষায় পলি ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত কার্যক্রম বাস্তবায়ন দরকার। সে লক্ষ্যে বে-সরকারী সংস্থা উত্তরণ এর সহযোগিতায় পানি কমিটি টিআরএম বাস্তবায়নের মাধ্যমে সকল শ্রেণী পেশার মানুষের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

কেন্দ্রীয় পানি কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ এবিএম শফিকুল ইসলাম বলেন, পানিকে আমরা অর্থনীতি, প্রকৃতি এবং অস্তিত্ব হিসেবে মনে করি। কাজেই পানি প্রবাহ সচল রাখতে না পারলে আমাদের অর্থনীতির চাকা অচল হয়ে পড়বে, প্রকৃতি বিপর্যস্ত হবে এবং সর্বোপরি অস্তিত্ব বিলীয়মান হতে বসবে এই সত্যকে মাথায় রেখে পানি কমিটি দীর্ঘদিন কাজ করে চলেছে।

দৈনিক সাতক্ষীরা/জেডএইচ

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)