৯ মাসের রেহান শুধু কাঁদছে, অন্যরা তাও পারছে না
ধানমন্ডির সেন্ট্রাল হাসপাতালের কেবিন নম্বর ৭১৭। বেডে শুয়ে আছে নয় মাসের শিশু রেহান মজুমদার। পাশেই বসে আছেন মা। রেহান কিছুক্ষণ ঘুমাচ্ছে, আবার উঠে কাঁদছে, মুখে নিচ্ছে না কিছুই। জীবনের শুরুতেই শিশুটিকে কামড়ে বসেছে ঘাতক এডিস মশা। ডেঙ্গু জ্বরে হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছে সে।
গত শনিবার সরেজমিন সেন্ট্রাল হাসপাতালে গিয়ে চোখে পড়ে নিষ্পাপ শিশুটির কান্না। সবে খেতে শিখেছিল রেহান। তবে কয়েকদিন ধরে প্রচণ্ড জ্বর, মুখ থেকে খাবার ফিরিয়ে দিচ্ছিল সে। প্যাথলজিক্যাল টেস্টে ধরা পড়ে এডিস মশার কামড়ে রক্তের প্লাটেলেট (অণুচক্রিকা) নেমে এসেছে ২২ হাজারে, যা স্বাভাবিকের ছয় ভাগের এক ভাগ (স্বাভাবিক হলো- দেড় লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ)। কেরানীগঞ্জ থেকে এসে প্রথমে নিবেদিতা হাসপাতাল এবং সেখান থেকে দুদিন আগে সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে।
বাবা সুজন মজুমদার জানান, চারদিন ধরে রেহানের জ্বর, খাওয়ায় অরুচি ও মুখে ক্ষত দেখা দেয়। শরীর দুর্বল হয়ে যায় এবং নড়াচড়া কম করছিল। এ কারণে তাকে হাসপাতালে নিয়ে পরীক্ষা করাই। টেস্টে তার ডেঙ্গু ধরা পড়ে। এখনও সে খুব দুর্বল আর কান্না করছে।
রেহানের চিকিৎসায় দায়িত্বরত সেন্ট্রাল হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক ইনচার্জ অ্যান্ড কনসালটেন্ট ডা. সুজিত কুমার রায় বলেন, নিবেদিতা হাসপাতাল থেকে তাকে যখন এখানে আনা হয়, আমরা তার রক্তে প্লাটেলেট ২২ হাজার দেখতে পাই। আমাদের চিকিৎসা শুরুর পর ও নিয়মিত স্যালাইনের কারণে এখন সেটি ৩৫ হাজারে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু প্লাটেলেট বেড়েছে তাই আপাতত রক্ত লাগছে না। শিশুটির ডেঙ্গু জ্বর ছাড়া আর কোনো সমস্যা নেই। আশা করি সে দ্রুত রিকভার করবে।
এদিকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশু রেহান হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাঁদতে পারলেও দেড় মাস ধরে একই রোগে আক্রান্ত হেনা আক্তার তাও করতে পারছেন না। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আগস্টের ১৬ তারিখ থেকে হাসপাতালে ভর্তি তিনি। পাশে বসেই মার জন্য কাঁদছিল সাড়ে চার বছরের শিশু হামীম। ডেঙ্গুতে কাতরাবেন, সংসার সামলাবেন, নাকি শিশুকে সান্ত্বনা দেবেন- কোনোভাবেই জীবনের হিসাব মেলাতে পারছিলেন না হেনা।
তার স্বামী বলেন, ডেঙ্গু জ্বরে হেনা এতোটাই কাবু হয়ে যায় যে, তাকে কোলে করে আদদ্বীন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চার ব্যাগ রক্ত দেয়ার পর তার প্লাটেলেট কিছুটা বাড়তে থাকে। কয়েকদিন হাসপাতালে রাখা হয়েছিল। প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
গত ৬ সেপ্টেম্বর ডেঙ্গুতে কাবু হন মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা মাহমুদা বিনতে রহমান ওরফে মুক্তি। তার অসুস্থতায় প্রায় স্থবির স্বামী-স্ত্রী দুজনের সংসার। ৬ তারিখ রক্ত পরীক্ষায় ধরা পড়ে প্লাটেলেট ৪৮ হাজারে নেমেছে। সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি হন মোহাম্মদপুরের আল-মানার হাসপাতালে। আটদিনে খরচ হয়েছে ৫৫ হাজার টাকা। প্লাটেলেট বেড়ে দুই লাখ ৬০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। তবে এখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি মুক্তি। দুর্বলতার কারণে নড়াচড়া করতে কষ্ট হয় তার।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা চার হাজার ছাড়িয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আগস্টে আক্রান্ত হয়েছিলেন এক হাজার ৬৬৬ জন এবং মারা গেছেন ছয়জন।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আতিয়া বেগম বলেন, গত বছর চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ অনেক বেশি ছিল। তবে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল কম। এবার ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা আগের চেয়ে প্রায় চারগুণ বেড়েছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। অনেকে ডেঙ্গুর পাশাপাশি অন্য রোগে আক্রান্ত হওয়ায় সুস্থ হতে তাদের সময় লাগছে।