স্কুল ফাঁকি দিয়ে প্রেম আড্ডা,অতঃপর……

বেলা ১১টা। স্কুলের শিক্ষার্থীদের তখন ক্লাসে থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। রাজধানীর বিভিন্ন পার্কে, উদ্যানে স্কুলের ইউনিফর্ম পরেই প্রেমে মজে কিছু শিক্ষার্থী। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প- আড্ডা দিয়ে বাসায় ফেরে তারা। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বেপরোয়াগতিতে মোটরসাইকেলে আরোহণ করতে দেখা যায় টিনেজ জুটিকে।

তাদের দামি বাইকের হাইড্রোলিক হর্ণের বিকট শব্দ প্রতিনিয়ত সহ্য করতে হয় পথচারীদের। কখনও কখনও রাতের বেলাও বাইরে আড্ডা দিতে দেখা যায় এসব জুটিকে।

রাত তখন প্রায় দেড়টা। দুই কিশোর ও এক কিশোরী। এরমধ্যে এক কিশোরের পরনে স্কুলের ইউনিফর্ম। কাঁধে ব্যাগ আছে দুজনেরই। দীর্ঘক্ষণ বসে আছেন হাতিরঝিলের রামপুরা ব্রিজ এলাকায়। আশেপাশে হাতে গোনা আরো কয়েক তরুণ-তরুণী। একজন চা বিক্রেতা। ফেরি করে চা বিক্রি করছেন। ব্রিজে পার্কিং করা কয়েকটি মোটরসাইকেল। তিন কিশোর-কিশোরী গল্প করছিলো। হাসছিলো। আবার কখনও বিষণ্নতার ছাপ দেখা যাচ্ছিলো এক কিশোরের চোখে-মুখে। পূর্ব রামপুরা হাই স্কুলের শিক্ষার্থী বলে পরিচয় দেয় তারা। কিশোরী জানায়, পরিবারকে জানিয়েই ঘুরতে বেরিয়েছে তারা। রাতে একসঙ্গে তিন বন্ধু আড্ডা দেবে, এটা তাদের ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তিন জনের কথায় মিল পাওয়া যাচ্ছিলো না। কথা বলার এক পর্যায়ে তারা জানায়, মায়ের সঙ্গে অভিমান করে বাসা থেকে বের হয়ে এসেছে কিশোরী। ফোনে দুই বন্ধুকে ডেকে এনেছে। এক পর্যায়ে রামপুরা ফাঁড়ি পুলিশের সহযোগিতায় অভিভাবকদের ডেকে তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয় তাদের।

এরকম একটি ঘটনার কথা জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোৎস্না পারভীন। তিনি বলেন, বেলা ১১টায় হাতিরঝিলের একটি সংযোগ সড়কের ফুটপাথ সংলগ্ন দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে উবারের জন্য অপেক্ষা করছি। গন্তব্য মতিঝিল। স্কুল ইউনিফর্ম পরিহিতা দুই কিশোরী দোকানের খানিকটা ভেতরে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খাচ্ছে আর মোবাইলফোনে কিছু দেখছে। একটু খটকা লাগলো এই ভেবে যে, স্কুল ইউনিফর্ম পরে আছে সেটা মর্নিং শিফট স্কুল। ভাবলাম পরীক্ষা চলছে হয়তো তাই। যাই হোক, আমি গলি দিয়ে আসার সময়ই দুটি মোটরবাইক আমার ঠিক পাশ দিয়ে এসেছে। বাইকের চার আরোহীই কিশোর। উবারের গাড়ির চালকের ফোনকল রিসিভ করতে যাচ্ছি আর ঘুরে দেখি দুই ছেলে দুই মেয়েকে দোকান থেকে টেনে বার করতে উদ্যত হচ্ছে। এক মেয়ে বলছে ‘আমি যাবো না।’ আমি এগিয়ে গেলাম।

একটি ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে? ছেলেটি উত্তরে বললো যে সে জুস কিনবে। দুই মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম যে, তোমরা এখানে কি করছো? আমার বলার ধরনটা এমন ছিল যে এতে ছেলেগুলো সহ অন্যেরা ভাবলো আমি তাদের চিনি। একটা মেয়ের হাত থেকে আমি চট করে মোবাইল নিয়ে নেই। নিজেই বলতে থাকি যে, তোমার মাকে বলছি এসে তোমাদের নিয়ে যাক। ছেলেরা বাইক স্টার্ট দিতে শুরু করলো। আমি তাদের থামতে বললাম। কিন্তু ছেলেরা দ্রুত চলে গেল। একটি মেয়ের মোবাইলফোন থেকে তার মায়ের নাম্বারে কল দিলাম। প্রায় ২০ মিনিট পর তাদের দুজনের মা-ই এলেন। দুজনের কোলে ছোট বাচ্চা। মা দু’জনেরই সঙ্গে কথা হলো তারা স্কুলের গেইট অবধি মেয়েদের দিয়ে এসেছেন। মায়েরা চলে যাবার পরপরই স্কুলে না গিয়ে এদিকে চলে এসেছে মেয়ে দুজন। জ্যোৎস্না পারভীন জানান, এই কিশোর-কিশোরীদের কোথাও বেড়াতে যাবার প্ল্যান ছিল। ওই ঘটনা যখন দেখছিলাম চোখে ভাসছিলো পতেঙ্গার তাসফিয়ার লাশের ছবি। আমি সেই শঙ্কা থেকেই সাহস করে এগিয়ে যাই। গত মে মাসে পতেঙ্গায় বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে আর ফিরেনি তাসফিয়া। পরে তার লাশ উদ্ধার করা হয়।

গতকাল দুপুরে হাতিরঝিলের এফডিসি সংলগ্ন মগবাজার ব্রিজ এলাকায় নীল-সাদা ইউনিফর্ম পরা দুই কিশোরীকে বসে থাকতে দেখা যায়। কিছুটা দূরে দাবাঘরের পাশে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো ছয় কিশোর। এছাড়াও আশেপাশে প্রাপ্তবয়স্ক বিভিন্ন জুটিকে দেখা গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কিশোরীদের মুখোমুখি বসে কিশোররা। তাদের উদ্দেশ্য করে টিজ করতে থাকে। বাধ্য হয়েই দুই কিশোরী স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র গিয়ে বসে। পাশেই বসেছিলো টিনেজ জুটি। কিশোরীর কাঁধে হাত রেখে গল্প করছিলো কিশোর।

একই দৃশ্য দেখা গেছে, বোটানিক্যাল গার্ডেন, রমনা পার্ক ও চন্দ্রিমা উদ্যান এলাকায়। তালতলা ও আশেপাশের এলাকার স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা ভিড় করে চন্দ্রিমা উদ্যানে। ক্লাসের সময়েই জমিয়ে আড্ডা দেয়। ওই এলাকায় ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালনকারী এক সার্জেন্ট জানান, সোমবার বৃষ্টির সকালে চন্দ্রিমা উদ্যানে কেউ বসতে পারেনি। ওই সময়ে স্কুলপড়ুয়া জুটিগুলো রিকশা ভাড়া করে ওই এলাকা দিয়ে ঘুরে বেরিয়েছে।

উত্তরায় গত বছর অভিভাবকদের সঙ্গে পরামর্শ করে স্কুলের ইউনিফর্ম পরে যত্রতত্র ঘোরাফেরায় নিষেধ করে পুলিশ। ১লা ফেব্রুয়ারি থেকে এ বিষয়ে অভিযান শুরু করে। এতে ওই এলাকায় স্কুলপড়ুয়াদের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে অবাধে ঘোরাফেরা কমে যায়। ওই বছরের ৬ই জানুয়ারি উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর রোডে ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবিরকে খেলার মাঠে পিটিয়ে এবং কুপিয়ে হত্যা করে একটি কিশোর গ্রুপ। ওই ঘটনার পর পুলিশ তৎপর হলেও আবারো উত্তরায় বেপরোয়া হয়ে উঠছে কিশোররা। ওই এলাকার প্রায় দুই শতাধিক স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই বন্ধুদের বাইকে চড়ে ক্লাসের সময়ে বিভিন্নস্থানে আড্ডায় মেতে উঠে। এমনকি উত্তরা, বারিধারা, ধানমন্ডির বিভিন্ন সিসা লাউঞ্জেও এই টিনেজদের আড্ডা দিতে দেখা যায়।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞানী তৌহিদুল হক বলেন, তথ্য-প্রযুক্তি ও স্যাটেলাইট চ্যানেলের এই যুগে অভিভাবকদের আরো বেশি সচেতন হতে হবে। ভিন দেশের সংস্কৃতির খারাপ দিকটা বাদ দিয়ে ভালো দিকটা গ্রহণ করতে হবে। শিশুদের মধ্যে নৈতিকতার চর্চা করতে হবে। এতে অভিভাবকদের সচেতনতার বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি। সূত্র: মানবজমিন।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)