সাতক্ষীরায় এত দিন মুখ চেপে ছিল অনেক নারী , বেরিয়ে আসছে ডাকাত জলিলের ইতিহাস

এত দিন মুখ চেপে ছিল অনেক নারী। প্রকাশের কোনো ভাষা কিংবা সামাজিক শক্তিও ছিল না তাদের। তবে ডাকাত সর্দার জলিলকে পুলিশের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে জনতা পিটুনি দিয়ে মেরে ফেলেছে- এমন খবর পেতেই যেন তাদের মুখ ফুটল। ভয়ংকর খুনি জলিলের বিকৃত লাশে কেউ থুথু ফেলল। কেউ লাথি মেরে ঘৃণা প্রকাশ করল।

গতকাল শনিবার রাতে ঠিক এমন দৃশ্যই দেখা যায় সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর গ্রামে। হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষ সেই দৃশ্য দেখে।

এ জলিল সেই জলিল যার ছিল একটি ডাকাত বাহিনী। তাদের সর্দার ছিলেন তিনি। কখনো জাতীয় পার্টি, কখনো জামায়াতে ইসলামী, কখনো বিএনপি করে সর্বশেষ ছিলেন আওয়ামী লীগের ছায়াতলে। ছিলেন কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি। তবে শেষ পর্যন্ত কোনো দলই তাঁকে রক্ষা করতে আসেনি। বরং মরার ওপর এক ঘা বসিয়ে দিয়ে যেন বলেছে, ‘জলিলদের মতো মানুষের জন্য এই শাস্তিই অপেক্ষা করছিল।’

কালীগঞ্জের কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের শংকরপুর গ্রামের ইয়াকুব আলী গাইনের ছেলে জলিল গাইন। দরিদ্র দিনমজুর থেকে জলিল আশি লাখ টাকার আলিশান বাড়ি গড়ে তোলেন, সেখানে রয়েছে ১৭টি শীতাতপ যন্ত্র। শনিবার রাতে জলিলের গণপিটুনিতে মৃত্যুর পর বিক্ষুব্ধ জনতা তাঁর সেই বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেছে। তারা তাঁকে সাতক্ষীরার দ্বিতীয় ‘এরশাদ শিকদার’ নাম দিয়েছে। খুন, অত্যাচার, চুরি-ডাকাতিসহ নানা অপরাধের জন্য কুখ্যাত ও সিরিয়াল কিলার এরশাদ শিকদারকে ২০০৪ সালের ১০ মে খুলনা কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

কৃষ্ণনগরের একাধিক লোকজন জানান, ডাকাতি করতে গিয়ে বেশ কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়েছেন ডাকাত সর্দার জলিল গাইন। সেসব নারী ও তাদের পরিবার এ ঘটনা চেপে রেখে কোনো মামলা করার সাহস করেনি। তবে জলিলের চলে যাওয়ার খবর নিশ্চিত করার পর তারা পুলিশকে বারবার টেলিফোন করে জানিয়েছে। কান্নাকাটি করেছে। নিজেদের অব্যক্ত কষ্টের কথা বলেও শেষ হাসি হেসেছে জলিলের শোচনীয় পরিণতিতে।

গ্রামবাসী, পুলিশ ও দলীয় নেতা সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ি ইউনিয়নের জয়নগরের কৃষক মাজেদ পাড় হত্যার মধ্য দিয়ে জলিলের উত্থান। তারপর একে একে ডাকাতি, রাহাজানি করে নিজেকে অপরাধ জগতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলেন জলিল। এরই মধ্যে একটি গণধর্ষণে অংশ নেন জলিল। তাঁর এলাকার ফজলু ডাকাত, ফজর ডাকাত, বারী ডাকাত, আজিজ ডাকাত, মাজেদ ডাকাত, ঘুঘু ডাকাত, রেজাউল ডাকাত, নুরুল ডাকাত, কালাম ডাকাত, জিয়া ডাকাত, ইসলাম ডাকাত, আলেক ডাকাত, এরশাদ ডাকাত, আশাফুর ডাকাত, মোস্তাক ডাকাত, ডাকাত ইয়ার আলী, ডাকাত বাহার আলী, রনজিত ডাকাত, মজিদ ডাকাত, রবি ডাকাত, সিরাজ ডাকাত, আবদুল ডাকাত (নিহত), মতলেব ডাকাত (নিহত) সবাই ছিল জলিলের অনুগত। এদের মধ্যে দুই ডাকাত আবদুল ও মতলেব অন্য ডাকাতদের কোপানলে পড়ে খুন হয়েছিল। এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন ডাকাত সর্দার জলিল।

এর আগে ২০০৩ ও ২০০৪ সালে কৃষ্ণনগরের ডাকাতদের মধ্যে প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে বিরোধ হয়। এ সময় কয়েকজন ডাকাত আহত হয়, কেউ পা হারায়, কেউ হাত হারায়। কার কারো দৃষ্টি শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। আবার বিস্ফোরণে কোনো কোনো ডাকাতের দেহের অঙ্গ উড়ে যায়। জলিল এই ডাকাতদের সহযোগী হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। সর্বশেষ তিনি ছিলেন ডাকাত দলটির সর্দার। রাতের আঁধারে তাঁর ভয়াল মূর্তি নিরীহ গ্রামবাসীকে আতঙ্কিত করে তুলত। তাঁর কাছে ছিল একাধিক বেআইনি অস্ত্র। থাকত বোমা ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম। এত অপরাধের পরও ২০১৬ সালে তিনি কৃষ্ণনগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এখন পর্যন্ত জলিলের বিরুদ্ধে চারটি হত্যাসহ ১২টি বিভিন্ন অপরাধের মামলার খতিয়ান খুঁজে পেয়েছে পুলিশ।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রাতে আশাশুনির গৃহবধূ সাজেদা খাতুনের দুটি গরু চুরি করেন জলিল গাইন। ২০০৭ সালের ২৩ মে সাতক্ষীরা শহরের অদূরে বাঁকাল এলাকায় একটি ওয়ান শ্যুটার গান, একটি পাইপগান ও বিস্ফোরক দ্রব্যসহ পুলিশের হাতে আটক হন জলিল। ২০০৫ সালের ১৯ জানুয়ারি কৃষ্ণনগর বাজারের আল্লাহর দান জুয়েলারি দোকানে ডাকাতি করেন জলিল। ২০০৬ সালের ১৫ নভেম্বর চাঁদাবাজির একটি মামলা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। জলিল এক ব্যক্তির কাছ থেকে সাত লাখ টাকা ছিনিয়ে নেন। তিনি খুলনা ও শ্যামনগরে আরো একটি করে দুটি খুন করেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। সেসব খুন সংক্রান্ত কাগজপত্র অচিরেই পুলিশের হাতে আসবে বলে জানান কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাসান হাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, জলিলের অপরাধের অন্ত নেই। মামলাও অনেক।

সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান কে এম মোশাররফ হোসেন হত্যা মামলার প্রধান আসামি ও গণপিটুনিতে নিহত স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আবদুল জলিল গাইনের গ্রামের বাড়িতে লোকজনের ভিড়। ছবি : এনটিভি

কালীগঞ্জে রয়েছে অসংখ্য চিংড়ি ঘের। ডাকাত সর্দার জলিল এসব ঘেরে প্রায়ই তাঁর বাহিনী নিয়ে ডাকাতি করতেন। কোনো ঘের দখলের বিষয় থাকলে তিনি তাঁর ডাকাত বাহিনী নিয়ে ঝাঁপ দিতেন। ভাড়াটে খুনি হিসেবে যেতেন এলাকার বাইরে। কয়েকদিন পর ফিরে আসতেন। জলিল যার দল করতেন তাঁর সঙ্গে গড়ে তুলতেন দহরম মহরম। ২০১৬ সালেও জলিল করতেন বিএনপি। সে সময় তাঁর নেতা কাশিমাড়ির ওলিউর রহমান ওরফে ওলি মোল্লাকে খুন করার পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। ব্যর্থ হয়ে তিনি পুলিশকে গোপন তথ্য দেন। পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান ওলি।

জলিল ডাকাত এ ঘটনা ঘটাতে গোপনে একটি মহলের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন বলে দাবি ওলির পরিবারের। জলিলের এক সময়কার দল জাতীয় পার্টির জেলা কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক কে এম মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে খুব মেলামেশা করে ভাব জমিয়ে ফেলেছিলেন খুনি জলিল। শেষ পর্যন্ত সেই মোশাররফ হোসেনকে জলিল ও তার সহযোগীরা গত ৮ সেপ্টেম্বর গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে।

একাধিক সূত্র জানায়, জলিল নিজের ভোল পাল্টে একেক সময় একেকজন রাজনৈতিক নেতার কাছাকাছি চলে যেতেন। আবার তারই সর্বনাশ করতেন। কৃষক মাজেদ পাড় হত্যাসহ অন্যান্য মামলায় জলিল যার হাত ধরে রক্ষা পেয়েছিলেন সেই প্রাক্তন জনপ্রতিনিধি এখন জলিলকে গণপিটুনিতে হত্যার কাজে সহযোগিতা দেওয়ায় পুলিশ ও কৃষ্ণনগরের জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এমনকি ফুলের মঞ্চ তৈরি করে তিনি তাঁদের সংবর্ধনা দিতে ঢাকা থেকে এখন এলাকায় অবস্থান করছেন। তিনি এর আগে জলিলের সব অপকর্মকে ধামাচাপা দিয়েছেন। নিজ দল থেকে বহিষ্কৃত এই নেতা এখন এলাকায় এসে মোশাররফ হত্যাকে পুঁজি করে এবং জলিলের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার চেষ্টা করছেন। অথচ তিনি জলিলের অপরাধ জগতে উত্থানে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন।

নাম পরিচয় প্রকাশ না করেই গ্রামের কয়েকজন নারী বলেন, জলিলের কারণে রাতের দিকে নারীরা আতঙ্কের মধ্যে থাকতেন। বিশেষ করে পুরুষ লোক বাড়িতে না থাকার সুযোগ নিয়ে নানা অজুহাতে বাড়িতে ঢুকে পড়তেন জলিল। তারপর নারীরা হতেন ধর্ষণের শিকার। এমন কমপক্ষে ৪০টি ঘটনার সাক্ষীরাই শনিবার রাতে ডাকাত সর্দার খুনে জলিলের গায়ে থু থু দিয়েছে।

নিজের ছবিই কাল হলো জলিলের

গত ৮ সেপ্টেম্বর নৃশংস হত্যার শিকার হন কৃষ্ণনগর ইউপির তিনবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টির নেতা কে এম মোশাররফ হোসেন। এই হত্যার প্রধান আসামি আবদুল জলিল গাইন ওরফে জলিল ডাকাত ওরফে খুনে জলিল পালিয়ে যান। গত ১৩ সেপ্টেম্বর তাঁর ছবিসহ একটি জাতীয় দৈনিকে একটি বিশেষ প্রতিবেদন ‘দিন মজুর থেকে খুনে জলিল’ শীর্ষক খবর ছাপা হয়। শুক্রবার রাতে ওই ছবি দেখে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার একটি মাকের্টের লোকজন জলিলকে শনাক্ত করে। তারাই জলিলকে মৌচাক পুলিশ ফাঁড়ির কর্মকর্তাদের হাতে তুলে দেয়। এরপর শনিবার বিকেলে তাঁকে নিয়ে আসা হয় সাতক্ষীরায়। রাত সাড়ে ৯টায় তাঁকে নিয়ে নিজ এলাকা কৃষ্ণনগরে অস্ত্র উদ্ধারে গেলে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয় জনতা। এর পরই গণপিটুনিতে নিহত হন জলিল। এ সময় বাধা দিতে গিয়ে আহত হন তিন পুলিশ সদস্য।

কালীগঞ্জ থানার ওসি হাসান হাফিজুর রহমান বলেন, শনিবার রাতে গণপিটুনিতে নিহত জলিল গাইনের লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে আজ রোববার। দিনভর পরিবারের কেউ তাঁর লাশ গ্রহণ করতে আসেনি। পরে সন্ধ্যা ৭টার দিকে তাঁর লাশ পুলিশ পাহারায় গ্রামের বাড়ি কৃষ্ণনগরের শংকরপুরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে গ্রামবাসী তাতে বাধা দেয়। জলিলকে গ্রামে দাফন করতে দেওয়া হবে না বলে তারা জানিয়ে দেয়। এমনকি তাঁর জানাজাও করতে দেয়নি। এ অবস্থায় জলিলকে কালীগঞ্জ উপজেলা সদরে সরকারি কবরস্থানে দাফন করা করা হয়েছে।

ওসি জানান, গণপিটুনি দিয়ে জলিলকে হত্যার অভিযোগে অজ্ঞাতনামা পাঁচ থেকে ছয় হাজার ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে কালীগঞ্জ থানায়।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)