সমন্বয় নেই সেবা খাতে, অজুহাতেরও শেষ নেই

ডেস্ক রিপোর্ট:
জলাবদ্ধতা নিরসনসহ নগর উন্নয়নে সমন্বয় নেই রাজধানীর সেবা খাতগুলোর। বারবার সমাধানের দাবি উঠলেও এখন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও দফতরগুলোর মধ্যে প্রতিষ্ঠা হয়নি সমন্বয়। এক সেবা প্রতিষ্ঠান খোঁড়াখুঁড়ি করলে সাত দিন পর একই সড়কে কাজ করে আরেক সংস্থা। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় নির্দেশনা দেয়া হলেও তৎপরতা নেই সংশ্লিষ্টদের।
কয়েকদিন পর আগের অবস্থায় ফিরে যান তারা। ফলে সমন্বয়হীন এ নগরীতে সামান্য বৃষ্টি হলেই দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। মাসের পর মাস ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে খোঁড়াখুঁড়ি চলছেই। আর তাতে স্থায়ী সংকটে পরিণত হচ্ছে যানজট। রাজধানীর সেবাখাতগুলোর বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দূর করতে প্রধানমন্ত্রী মেয়রদের সমন্বয় করার ক্ষমতা দিলেও কাজে আসছে না তা।
নগরীর জিগাতলা ট্যানারিমোড় এলাকায় দুই মাস আগে ঢাকা ওয়াসা রাস্তা খুড়ে পানির লাইন মেরামতের কাজ করে। এরআগে বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপনে রাস্তা খোঁড়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এদিকে মালিবাগ-মৌচাক এলাকায় পানি-নিষ্কাশনে কাজ করছে ঢাকা ওয়াসা। এছাড়া একই এলাকায় বেশ কয়েকটি সংস্থা কাজ করছে, যার সঙ্গে সিটি করপোরেশনের কোনো সম্পর্ক নেই। এদিকে গুলশান ১ নাম্বার থেকে বাড্ডার পথে রাস্তার বাম পাশে কাটা-ছেড়ো করছে ঢাকা ওয়াসা। এখানেও সিটি করপোরেশনের হদিস নেই। একইভাবে মিরপুর-১০ থেকে কালশী পর্যন্ত একের পর এক ওয়াসা ও বিটিসিএলের খোঁড়াখুড়ি শেষেে এবার ওই রাস্তায় চলছে মেট্রোরেলের কাজ।
শুধু এসব নয়, নগর জুড়ে প্রায় একই। সকালে এক সংস্থা কাজ করে গেলে, বিকেলে করছে অন্যরা। আর এতে বাড়ছে জনদুর্ভোগ। এক সংস্থার সঙ্গে আরেক সংস্থার সমন্বয় খুঁজে পাওয়া যায় না। বরাদ্দ পেলেই যে যার মতো উন্নয়নের নামে যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ির করে। অনেক সময় এসব সেবা সংস্থা সিটি করপোরেশন  বা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অনুমতিও নেয় না। মাঝে মধ্যে ডিসিসি সমন্বয় সভা ডাকলেও তাতে তেমন একটা সাড়া দেয় না অন্য সেবা সংস্থাগুলো।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢাকার উন্নয়নে জরুরি নগর সরকার। সমন্বয় করতে হবে দুই সিটি করপোরেশনকেই। তাদের হাতে দিতে হবে ক্ষমতা। সেবা সংস্থাগুলোকে উন্নয়ন কাজে সিটি করপোরেশনের আওতাধীন করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে আনতে হবে আইনের সংশোধন। এ ছাড়া ওয়াসা, বিদ্যুৎ বিভাগ, পূর্তবিভাগ, রাজউক, মেট্রোপলিটন পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশ, সড়ক ও যোগাযোগ, বাংলাদেশ রেলওয়ে, বিআরটিএসহ সব সেবা প্রতিষ্ঠানের একটা সমন্বয় থাকা জরুরি।রাজধানীর উন্নয়নে সাতটি স্বাধীন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যুক্ত অন্তত ৫৬টি সেবা সংস্থা। উন্নয়ন কাজে এসব সেবা সংস্থার মধ্যে নেই কোনো সমন্বয়। সারা বছরই চলে সংস্কার কাজ। তবে বর্ষা এলেই বেড়ে যায় খোঁড়াখুঁড়ির মাত্রা। আর এতে দুর্ভোগে পড়ে নগরবাসী।
নগর উন্নয়নে যে সাতটি স্বাধীন মন্ত্রণালয় কাজ করে সেগুলো হলো স্থানীয় সরকার, স্বরাষ্ট্র, রেল, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, গণপূর্ত, সড়ক ও যোগাযোগ এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া অর্থ, পরিকল্পনাসহ আরো কয়েকটি মন্ত্রণালয় পরোক্ষভাবে নগর উন্নয়নের অংশীদার। এসব মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২৬টি সেবাদানকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলো হলো- ঢাকা ওয়াসা, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ, তিতাস গ্যাস, ডিপিডিসি, ডেসকো, বিটিসিএল, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি), র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), বাংলাদেশ রেলওয়ে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর, স্বাস্থ্য অধিদফতর, সমাজসেবা অধিদফতর, পরিবেশ অধিদফতর, এনজিও ব্যুরো, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, তথ্য অধিদফতর, বিআরটিসি, সড়ক ও জনপথ বিভাগ প্রভৃতি। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক, জাইকাসহ দেশি-বিদেশি বেশ কিছু নাগরিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা কাজ করে নগর উন্নয়নে।
পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী এমদাদুল ইসলাম বলেন, সরকারের প্রতিটি সংস্থা নিজ নিজ আইনে চলে। মেয়ররা ব্যতিক্রমী কিছু বললে সংস্থাগুলো তাদের আইনের বাইরে চলতে পারবে না। তখনই দেখা দেয় জটিলতা। তবে মেয়রদের ক্ষমতা দিয়ে আলাদা একটা আইন করলেই কার্যকর ফল পাওয়া যাবে বলে মনে করেন তিনি।
সেবা সংস্থার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের আড়ালে জনভোগান্তিতে ক্ষুব্ধ দুই সিটি করপোরেশনও। বিশেষ করে সারা বছর ধরে খোঁড়াখুঁড়ির শেষ থাকে না ওয়াসার।
গত ৯ এপ্রিল, সোমবার নগর ভবনে (ঢাকা দক্ষিন সিটি করপোরেশন) অনুষ্ঠিত হয় সমন্বয় সভা। সেই সভায় মেয়র সাঈদ খোকন সংস্থার প্রধানদের বলেন, সমন্বয় না করে কাজ করার ফলে নোংরা হচ্ছে শহর। বাড়ছে জনদূর্ভোগ। এখন থেকে সমন্বয় করে যে কোনো উন্নয়ন বা মেরামতের কাজ করার পরামর্ দেন তিনি। দরকার হলে ৭ দিন আগে বা পরে করে নিয়েই কাজ করতে বলেছেন দক্ষিণের সিটি মেয়র সাঈদ খোকন।
গেলো বছর এক অনুষ্ঠানে সাঈদ খোকন রাজধানীর জলাবদ্ধতার জন্য ঢাকা ওয়াসাকে দায়ি করেন। তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ওয়াসার। কিন্তু তারা এতটুকু কাজও করে না। ঢা্কা ওয়াসা হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত। অথচ একটি নর্দমা ঠিক করতে খুব বেশি টাকা লাগে না। ঢাকায় বৃষ্টি হলে বিভিন্ন সৃষ্টি হয় জায়গায় জলাবদ্ধতা। তা দূর করার দায়িত্ব ওয়াসার। কিন্তু তাদের কোন পদক্ষেপ দেখা যায় না।
সমস্যা সমাধান ও সমন্বয় বিষয়ে ঢাকা ওয়াসা এমডি তাকসিম এ খান বলেন, সমন্বয় করার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তা পুরোপুরি সম্ভব হয় না। সবার সময় মেলে না। তবে জনগনের দূর্ভোগ কমিয়ে উন্নয়ন ও মেরামতের কাজ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে ওয়াসার কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের।
মেয়র যানজট ও জনদুর্ভোগে সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতাকে দায়ি করেন। তিনি বলেন, এখন থেকে রাস্তা খোঁড়ার ছয় মাস আগে সংশ্লিষ্ট সেবা প্রতিষ্ঠানকে সিটি করপোরেশনের অনুমতি নিতে হবে। পাশাপাশি জাতীয় উন্নয়ন ও মেরামতের ক্ষেত্রে ডিএমপিসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে কমপক্ষে এক মাস আগে জানাতে হবে। বাস্তবতা হলো, ৫৬টি সেবা সংস্থার মধ্যে দু-একটি ছাড়া কেউই অনুমতির বিষয়টি তোয়াক্কা করে না।
এসব বিষয়ে ডিএসসিসি মেয়র সাঈদ খোকন ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, জনদুর্ভোগের কথা বিবেচনায় রেখে সমন্বয়হীনতা দূর করতে প্রতিটি সেবা সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করা হচ্ছে। রাজউক ও ওয়াসার সঙ্গে বেশ কয়েকটি বৈঠক হয়েছে। পুলিশের সঙ্গেও মতবিনিময় করা হয়েছে। এসব সমন্বয় বৈঠকের মধ্যদিয়ে আশা করা যাচ্ছে সমস্যা কিছুটা কমে আসবে।
বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহফুজ উদ্দিন আহমদ বলেন, অন্য সেবাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয় করতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, আমি নিজে বেশ কয়েকবার সংস্থায় সংস্থায় গিয়ে বলে এসেছি। কিন্তু রাস্তা খুঁড়লে বা পোল সরালে আমাদের জানায় না। আমরা সমন্বয়ের চেষ্টা করলেও, অন্যরা আমাদের না জানিয়ে সম্পদের ক্ষতি করেছে।
রাজধানীর অভিভাবক হিসেবে পরিচিত হলেও, এর আওতাধীন অঞ্চলে সড়ক নির্মাণ ও মেরামত, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, মশক নিধন ও সৌন্দর্যবর্ধন ছাড়া তেমন কোনো দৃশ্যমান উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করে না সিটি করপোরেশন। আবাসন সমস্যা, যানজট নিরসন, গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ সরবরাহসহ নগরীর স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগুলো সিটি করপোরেশনের হাতে নেই। ঢাকা ওয়াসা, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও ঢাকা এনার্জি সাপ্লাইকোম্পানি (ডেসকো), ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষসহ সব উন্নয়ন সংস্থা পৃথক মন্ত্রণালয়ের অধীন। সে কারণে কোনো উন্নয়ন কাজ একক সিদ্ধান্তে হয় না। সমন্বয়ও থাকে না কাজে।
সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা কেন জানতে চাইলে সাঈদ খোকন বলেন, সংস্থার প্রধানরা বলছেন সবার সময় এক না হওয়ায় সমন্বয় হচ্ছে না। তবে তারা চেষ্টা করবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন। তাছাড়া সমন্বয় সভায় কিছু কিছু সংস্থাপ্রধান না এসে, তাদের অনেকের নিচের কর্মকর্তাদের পাঠান। যারা হয়তো সংস্থাপ্রধানের কাছে ব্রিফিংটিও ঠিকমতো পৌঁছান না বলে জানান মেয়র।
Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)