লিখন পদ্ধতির উদ্ভব ও বাংলা লিপি যেভাবে এসেছিলো

সৃষ্টির পর থেকেই মানুষ নিজেদের মাঝে ভাব আদান প্রদানের জন্য নানা ধরণের পদ্ধতি অবলম্বন করে এসেছে ,যা এখনো বিদ্যমান। চিত্রকলার মাধ্যমে এটির সূচনা হলেও পরবর্তীতে মানুষ অন্য মাধ্যম খুঁজে নেয় কারন চিত্রের মাধ্যমে শুধুমাত্র বস্তু প্রকাশ করা যায় কিন্তু মানব মনের সূক্ষ্ণ অনুভূতির প্রকাশ ঘটানো যায় না। এরই প্রেক্ষিতে সাংকেতিক চিহ্ন তথা বর্ণমালা বা লিখন পদ্ধতির উদ্ভব ঘটে। লিপিবিশারদেরা মনে করেন চিত্র ভিত্তিক লিপি থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে বর্ণলিপির সৃষ্টি হয়েছে। এদের মাঝে সবচেয়ে প্রাচীন যে লিপির সন্ধান পাওয়া যায় তা হলো ফিনিশীয় লিপি এবং সেখান থেকেই সব ভাষার লিখন পদ্ধতির সূচনা হয়েছে বলে ঐতিহাসিকরা মনে করে থাকেন।

লিখন পদ্ধতির ইতিহাসঃ

বর্ণমালা নিয়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন উপকথা প্রচলিত আছে। অনেকেই মনে করেন ভারতের ব্রাক্ষ্মীলিপি হিন্দু দেবতা ব্রক্ষ্মা আবিষ্কার করেছিলেন ,মিশরীয় লিপি পাখির মতন মাথা ও মানুষের মতন দেহের দেবতা থথ্‌ সৃষ্টি করেছিলেন ,চীনা অক্ষরগুলো সাং চিয়েন নামক এক ড্রাগন মুখো লোক সৃষ্টি করেছিলেন। তবে ঐতিহাসিকদের মতে পৃথিবীর সবথেকে প্রাচীন বর্ণমালা যার অস্তিত্ত্ব পাওয়া যায় তা হলো ফিনিশীয় বর্ণমালা। এটি থেকেই লিখন পদ্ধতির সৃষ্টি হয়েছে যার অস্তিত্ত্ব পাওয়া যায় খ্রিষ্টপূর্ব ১০৫০ সালেরও আগে। ফিনিশীয় বর্ণমালা ছিলো ভূমধ্যসাগরের তীরে বসবাসরত ফিনিশীয় জাতীর বর্ণমালা। এই বর্ণমালায় ছিলো ২২টি অক্ষর, যার সবই ছিলো ব্যঞ্জনবর্ণ। ফিনিশীয় ভাষা লুইখতে এটি ব্যবহৃত হতো যা ফিনিশীয় সভ্যতার একটি সেমেটিক ভাষা ছিলো।

ফিনিশীয় বর্ণমালাতে কোনো স্বরবর্নের উপস্থিতি ছিলোনা। গ্রীক ও ইহুদিরা ফিনিশীয়দের কাছ থেকে বর্ণমালা ধারণা নিয়ে স্বরবর্ণের ধারণা সৃষ্টি করে যা গ্রীকদের কাছ থেকে পরবর্তীতে আবার ফিনিশীয়রা গ্রহণ করে। গ্রীক বর্ণমালায় বর্ণের সংখ্যা ছিলো ২৪। এই সামগ্রিক বর্ণমালার ধারণা পরবর্তীতে রোমানরা গ্রহণ করে এবং রোমান বর্ণমালা থেকেই পরবর্তীতে ইউরোপ তথা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার বর্ণমালা উদ্ভব হয়। ২০০৫ সালে ইউনেস্কো ফিনিশীয় ভাষাকে “মেমোরি অব দা ওয়ার্ল্ড” প্রোগ্রামে লেবাননের একটি ঐতিহ্য হিসেবে সংযুক্ত করে।

সংখ্যা লিখন পদ্ধতিঃ

সংখ্যা লিপির ধারণা সর্বপ্রথম কোথা থেকে এসেছে সে সম্পর্কে সঠিক কোনো ধারণা পাওয়া না গেলেও মনে করা হয় আরবদের থেকেই সংখ্যাতত্ত্বের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু প্রখ্যাত আরব গণিত শাস্ত্রবিদ মুসা আল খাওয়ারিজমি ও আল কিন্দী তাদের লেখা গ্রন্থে বলেছেন পাটিগণিত তথা সংখ্যাতত্ত্ব মূলত ভারতীয়রা সৃষ্টি করেছে। তারা সংখ্যাতত্ত্বকে “ইলমে হিন্দ” বা “হিন্দুদের জ্ঞান” বলে আখ্যায়িত করেছেন। স্বাধীন সংখ্যা লিখন পদ্ধতি ,শূন্য ও দশমিকের ব্যবহার ভারতীয়রাই আবিষ্কার করেছেন। ভারতীয় বিখ্যাত পণ্ডিত ভাস্কর তার “বাসনা” গ্রন্থে বলেছেন সংখ্যাতত্ত্ব সরাসরি হিন্দু দেবতা ব্রাক্ষ্মের কাছ থেকে এসেছে। অনেকে মনে করেন লিখন পদ্ধতির আগেও সংখ্যা পদ্ধতির সৃষ্টি হয়েছে। ভারতীয়দের এই সংখ্যাতত্ত্বের প্রথম নিদর্শন পাওয়া যায় মৌর্য সম্রাট অশোকের শিলালিপিতে। আরব তথা মধ্যপ্রাচ্যের আরামিক বা সেমেটিক সংখ্যালিখন পদ্ধতির সাথে ভারতীয়দের সংখ্যা লিখন পদ্ধতির মৌলিক পার্থক্য হলো ,আরবরা ডান থেকে বামে লিখে থাকে আর ভারতীয়রা বাম থেকে ডানে লিখে থাকে।

1.লিখন পদ্ধতির উদ্ভব ও বাংলা লিপি যেভাবে এসেছিলো

বাংলালিপির ইতিহাসঃ

বাংলা ভাষা পৃথীবিতে প্রচলিত ভাষা গুলোর মধ্যে চতুর্থ বৃহত্তম ভাষা। এই ভাষাটির বর্ণমালা গুলো দুটি ভাগে বিবর্তনের মাধ্যমে এসেছে। একটি হলো ব্রাক্ষ্মীলিপি ও অপরটি হলো খরোষ্টিলিপি। এই দুটি লিপিই ছিলো ভারতীয় লিপি। যদিও খরোষ্টিলিপি এসেছিলো মধ্যপ্রাচ্যের আরামিক লিপি থেকে যেটি লেখা হতো ডান থেকে বাম দিকে। ব্রাক্ষ্মী লেখা হতো বাম থেকে ডান দিকে। এই ব্রাক্ষ্মীলিপি থেকেই বাংলা লিপি এসেছে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৭ অব্দের পরে। ব্রাক্ষ্মীর প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায় নেপালের তরাই অঞ্চলের প্রিপাবা স্তূপ থেকে। প্রিপাবা একটি কৌটার উপর খোদিত ছিলো যার ভেতরে বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা গৌতম বুদ্ধের অস্থি রক্ষিত ছিলো। মৌর্য সম্রাট অশোকের বিভিন্ন শিলালিপি ও স্তম্ভেও এই লিপির নিদর্শন পাওয়া যায়। ১৮৩৭ সালে জেমস প্রিন্সেস নামক একজন ব্রিটিশ পন্ডিত ব্রাক্ষ্মী লিপির পাঠোদ্ধারে সক্ষম হন।

বাংলা লিপির উদ্ভব ঘটেছে উত্তর ভারতীয় ব্রাক্ষ্মী থেকে। উত্তর ভারতীয় ব্রাক্ষ্মী কালক্রমে বিবর্তত হয়ে পূর্বীধারা ও পশ্চিমীধারা নামক দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। বাংলা লিপির নিদর্শন এই পূর্বীধারা থেকেই এসেছে। বাংলায় এর প্রধান যে দুটি নিদর্শন পাওয়া যায় তার একটি হলো মহাস্থান লিপি ও অপরটি হলো নোয়াখালী জেলায় প্রাপ্ত শিলুয়া মূর্তিলেখ। মৌর্য যুগে ব্রাক্ষ্মীলিপির ব্যাপক প্রচলন দেখা গেলেও এটি মূলত গুপ্ত যুগে ব্যাপক উন্নয়ন লাভ করেছিলো। সময়ের বিবর্তনে এটি বর্তমান বাংলা লিপিতে পরিণত হয়েছে।

2.লিখন পদ্ধতির উদ্ভব ও বাংলা লিপি যেভাবে এসেছিলো

বাংলা সংখ্যালিপিঃ

বাংলা সংখ্যালিপি প্রথম গুপ্ত যুগের তাম্রলিপিতে পাওয়া যায়। বাংলা সংখ্যালিপির বিবর্তন তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। গুপ্তযুগে বিবর্তনের মাধ্যমে নাগরী সংখ্যা লিপির উদ্ভব হয় এবং পালযুগে মধ্যগাঙ্গেয় সংখ্যালিপির প্রভাবে বাংলা সংখ্যালিপি নতুনভাবে দেখা যায়। সেন–বর্মন যুগে যে পরিবর্তন হয় তাকে প্রোটো বাংলা সংখ্যালিপি বলা হয়। এই তিনটি ধারার মাধ্যমে বাংলা সংখ্যালিপির উদ্ভব ঘটেছে যার প্রথম পূর্ণাঙ্গ পনের, ষোল, সতেরো ও আঠারো শতকের পান্ডুলিপিতে।

১৭৭৮ সালে চার্লস উইলকিন্স ও পঞ্চানন কর্মকার প্রাচীন পুঁথি থেকে বাংলা অক্ষরগুলো নিয়ে বর্ণমালা তৈরির মাধ্যমে প্রথম বাংলা মুদ্রণযন্ত্র সৃষ্টি করেন ঐ বছরই হ্যালহেড “A grammar of the bengali language” শীর্ষক গ্রন্থ প্রকাশ করেন এবং এভাবেই ধীরে ধীরে বাংলা ভাষা বিবর্তনের মাধ্যমে এই অবস্থানে এসে পৌঁছায়।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)