রাশিয়া বিশ্বকাপের ‘যদি-কিন্তু’

সদ্য সমাপ্ত বিশ্বকাপকে বলা হচ্ছে অঘটনের টুর্নামেন্ট। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, জার্মানি, স্পেন, পর্তুগাল এর কোনো দলই জায়গা পায়নি শেষ চারে। তাই ভক্তদের মনেও জমে আছে আফসোস। সবাইই ভাবছেন, ইশশ…এমন না হয়ে যদি অমন হতো! চলছে এমন অনেক যদি-কিন্তুর হিসাব নিকাশ। সম্ভাবনাগুলো একটু খতিয়ে দেখতে ক্ষতি কি!

১. লোপিতেগি যদি বরখাস্ত না হতেন! স্পেন দল বিশ্বকাপ খেলতে রাশিয়াতে গিয়েছিলো কোচ হুলেন লোপিতেগির অধীনে। এদিকে চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের পরও রিয়াল মাদ্রিদ ম্যানেজারের পদ থেকে সরে যেতে হয় ফ্রেঞ্চ মাস্টার মাইন্ড জিনেদিন জিদানকে। স্পেন মাঠে নামার আগেই রিয়াল তাদের ম্যানেজারের শূণ্য জায়গায় জিজুর বদলি হিসেবে স্থলাভিষিক্ত করে লোপিতেগিকে। তাতেই বাধে গোলমাল।

টুর্নামেন্টের মাত্র ২ দিন আগে বরখাস্ত হন স্পেন কোচ লোপিতেগি

‘লা রোহা’ দের সাথে চুক্তিবদ্ধ থাকা অবস্থাতেই লোপিতেগির এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি স্প্যানিশ ফুটবলের কর্তারা। টুর্নামেন্ট শুরুর মাত্র দুই দিন আগে বরখাস্ত করা হয় তাকে। প্রায় অভিভাবকবিহীন ভাবেই স্পেনকে নামতে হয়ে বিশ্বকাপ এর মঞ্চে। যদিও পুরো ব্যাপার টির দোষ গিয়ে বর্তায় রিয়াল ও লোপিতেগির ওপরে, তবুও বিশ্বকাপে স্পেনের টালমাটাল পারফরমেন্স দেখে মনে হতেই পারে ইশ,, লোপিতেগি যদি থাকতেন!

২. এ কোন জার্মানি! ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার পর দেশের ফুটবলভক্তদের বড় একটি অংশ জার্মানির সমর্থক। তাদের মনে এখন একটা কথাই ঘুরছে, “এতটা বাজে না হলেও পারতো!” সত্যিই কিসের অভাব ছিলো জার্মানদের? ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে, নাম্বার ওয়ান র‍্যাংকিং নিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে এসেছিলো তারা। অনেক ফুটবল বোদ্ধার বাজির ঘোড়া ছিলেন নয়্যার,টনি ক্রুশ,ওজিলরা। কিন্তু কি কারণে ঘটল এমন বিপর্যয়? তিনটি ম্যাচ দেখেই আসলে তেমন কিছু ধারণা করা কঠিন।

জার্মান পরাশক্তির লজ্জাজনক বিদায়

অনেকেই বলছেন, জার্মানিকে ডুবিয়েছে তাদের গা-ছাড়া মনোভাব। বলা যায়, প্রায় প্রতি ম্যাচেই ধাক্কা খেয়েছে তারা। মেক্সিকোর কাছে হার,সুইডেনের বিপক্ষে কষ্টার্জিত জয় দেখে অনেকেই ভেবেছিলেন, শেষ ম্যাচে অবশ্যই জার্মান জোশের দেখা মিলবে। কিন্তু কোথায় কি! দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে যে ডেডলকই ভাঙতে পারলেন না জার্মান ফুটবলাররা। উল্টা অ্যাডেড টাইমে দুই গোল হজম করে লজ্জার বিদায় নিতে হয় তাদের।দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দলের বিপক্ষে একটা গোলের জন্য শেষ মূহুর্তে ম্যানুয়েল নয়্যারের গোলপোস্ট ছেড়ে ফ্রন্ট লাইনে এসে পড়া জার্মানদের প্রশ্নাতীত সামর্থ্যকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। যদি জার্মানরা তাদের শক্তি অনুযায়ী খেলতে পারতো, কে জানে! বদলেও তো যেতে পারতো বিশ্বকাপের রঙ!

৩. মেসি যদি পেনাল্টি মিস না করতেন! লিওনেল মেসি- বিশ্বকাপ ছাড়া একজন ফুটবলার তার জীবদ্দশায় যা যা জিততে পারেন, সবই প্রায় জেতা হয়ে গেছে তার। একটা বিশ্বকাপ এর জন্য মেসির আকুতি বোঝার জন্য ফুটবল বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই নিশ্চয়! কিন্তু সেই মেসি বিশ্বকাপ এর প্রথম ম্যাচে কি করলেন! গুরুত্বপূর্ণ সময়ে করে বসলেন পেনাল্টি মিস।

আইসল্যান্ডের বিপক্ষে মেসির এই পেনাল্টি মিস হতাশায় ডোবায় পুরো আর্জেন্টিনা শিবিরকে

সোজাসুজি ভাবলে মনে হতেই পারে, আইসল্যান্ড এর বিপক্ষে আর্জেন্টিনা জয় পেলেও তারা গ্রুপ রানার্স আপ হয়েই থাকতো। কিন্তু একটু গভীরে গিয়ে দেখলেই মনে হবে, আইসল্যান্ড ম্যাচে ড্র করার পর কি প্রচণ্ড চাপের মধ্যেই না ছিলো আলবি সেলেস্তে রা। যার প্রমাণ মিলেছে ক্রয়েশিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়দের বডি ল্যাংগুয়েজ এ। কে জানে, প্রথম ম্যাচে জয়টা নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারলে হয়তো বিশ্বকাপের আর্জেন্টাইন পর্বটা আরো লম্বা হতে পারত! সাধেই তো আর যেকোনো টুর্নামেন্ট এর আগে খেলোয়াড়রা বলেন না- প্রথম ম্যাচ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ!

৪.কাভানি যদি ইঞ্জুরিতে না পড়তেন! ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে দর্শক বানিয়ে দ্বিতীয় রাউণ্ডের পর্তুগাল বনাম উরুগুয়ে ম্যাচের সব আলো নিজের দিকে টেনে নেন উরুগুয়ের ফরোয়ার্ড এডিনসন কাভানি। ওই ম্যাচেই ইঞ্জুরিতে পড়েন তিনি। ম্যাচের একটি দৃশ্য এখনো হয়তো সবার মনে পড়বে- কাধে করে ইঞ্জুরড কাভানিকে মাঠের বাইরে নিয়ে আসছেন রোনালদো।অনেকেই এটিকে খেলোয়াড়দের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের নিদর্শন হিসেবে দেখছেন। কিন্তু সিআরসেভেন যে চাচ্ছিলেন, স্ট্রেচার আসার জন্য সময় নষ্ট না করে দ্রুত যাতে কাভানিকে বাইরে পাঠিয়ে দেয়া যায়!

ইঞ্জুরড কাভানিকে মাঠের বাইরে নিয়ে আসছেন রোনালদো

কারণ এরই মধ্যে জোড়া গোল করে পর্তুগালকেই যে বিশ্বকাপ থেকে বের করার ব্যবস্থা করব ফেলেছন কাভানি! যাই হোক ইঞ্জুরিতে পড়ে ফ্রান্সের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে নামতে পারেন নি কাভানি। তাকে ছাড়া উরুগুয়েও আর এগোতে পারেনি, উড়তে থাকা উরুগুয়েরও বিশ্বকাপ যাত্রা শেষ হয়ে যায় শেষ আটে। উরুগুয়ের সমর্থকদের মনে থেকে যায় আফসোস, যদি থাকতেন কাভানি!

৫.জাপান যদি শর্ট কর্ণার নিতো! নিঃসন্দেহে জাপান ও বেলজিয়ামের মধ্যকার রাউন্ড অব সিক্সটিনের ম্যাচটি ছিলো এই বিশ্বকাপ এর অন্যতম শ্বাসরুদ্ধকর খেলা। গোলশূন্য প্রথমার্ধ শেষে দ্বিতীয়ার্ধের এক সময় ২-০ গোলে ফেভারিট বেলজিয়ামকে পেছনে ফেলে জাপান। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি জাপানিদের। উল্টা তিন গোল শোধ দিয়ে কোয়ার্টারের টিকেট ছিনিয়ে নেয় রেড ডেভিলরা। ৯০ মিনিটে গিয়েও খেলায় ছিলো ২-২ সমতা।

এক্সট্রা টাইমে একটা কর্ণার পেয়ে যায় তখন জাপান। হয়তো তাদের উচিৎ ছিলো শর্ট কর্ণার নিয়ে নিজেদের পায়ে বল রেখে খেলাটাকে ১২০ মিনিটে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু কর্ণারে ক্রস করে বসে জাপান, বল যায় সরাসরি বেলজিয়ান গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়ার হাতে। ডি ব্রুইনের কাউন্টার অ্যাটাকে স্কোর করেন বেলজিয়ামের নাসের শ্যাডলি। মূহুর্তেই ভেঙে যায় জাপানিদের সব স্বপ্ন। কিন্তু যদি জাপান আটকাতে পারত বেলজিয়ামকে? এশিয়ান দলটি আর কতদূর যেতো কে জানে! কিন্তু কোয়ার্টারে তাদের অপেক্ষায় থাকা ব্রাজিলের কিছু একটা হলেও কিন্তু হতে পারত!

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)