রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ছয় বছর

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে প্রতিদিনের মতোই শ্রমিকরা কাজে যোগ দিয়েছিলেন রানা প্লাজার পোশাক তৈরি কারখানায়। কারখানার কাজ চলাকালীন সকাল ৯টার দিকে ধসে পড়ে আট তলা ভবনটি। কিছু বুঝে উঠার আগেই ভবনের নিচে চাপা পড়েন সাড়ে পাঁচ হাজার পোশাক শ্রমিক।

এ ঘটনায় মারা যান ১ হাজার ১১৬ জন পোশাক শ্রমিক। আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন অন্তত দুই হাজার জন। রাজধানীর অদূরে সাভার এলাকায় একসঙ্গে এতো শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্ব-ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ শিল্প-দুর্ঘটনা।

ভয়াবহ এ ট্রাজেডির ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনে দায়েরকৃত দুই মামলার কোনো কূল-কিনারা হয়নি। প্রায় তিন বছর আগে এ দুই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। পরে এ বিষয়ে বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যান কয়েকজন আসামি। বৈধতা চ্যালেঞ্জের আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়ায় আটকে আছে মামলা দু’টির সাক্ষ্যগ্রহণ।

হত্যা মামলার বিষয়ে ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর খোন্দকার আব্দুল মান্নান জানান, অভিযোগ গঠনের পর কয়েকজন আসামি উচ্চ আদালতে গিয়ে মামলাটি স্থগিত করেন। তাদের মধ্যে এখনো সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. রেফাত উল্লাহ ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার হাজি মোহাম্মদ আলীর পক্ষে মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। তাদের পক্ষে মামলার কার্যক্রম স্থগিত থাকায় সাক্ষ্য নেয়া যাচ্ছে না।

এদিকে রিভিশনে ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলামকে অব্যাহতি দিয়েছেন দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত। তবে এ বিষয়ে কিছুই জানে না রাষ্ট্রপক্ষ।

খোন্দকার আব্দুল মান্নান আরো বলেন, মুহাম্মদ আমিনুল ইসলামকে অব্যাহতি দেয়ার বিষয়টি জানি না। তিনি যদি অব্যাহতি পেয়ে থাকেন তাহলে আমরা তার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবো।

ইমারত নির্মাণ আইনে দায়ের করা মামলা প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আনারুল কবির বাবুল বলেন, কয়েকজন আসামি অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিভিশন মামলা করেন। তাদের মধ্যে নিউওয়েব বটমস লিমিটেডের এমডি বজলুস সামাদ ও সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমানের রিভিশন আবেদন নামঞ্জুর করেছেন আদালত।

অপরদিকে ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলামের রিভিশন মঞ্জুর করে অব্যাহতি দেন আদালত। বাকি কয়েকজনের রিভিশনের আদেশ গেল ১৫ এপ্রিল দেয়ার কথা থাকলেও ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত তা দেননি। কবে আদেশ দেবেন তা এখনও আমাদের বলা হয়নি। রিভিশনের বিষয়টি নিষ্পত্তি হলে মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করবো।

আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বলেন, ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলামের অব্যাহতি চেয়ে রিভিশন করি। ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত রিভিশনটি মঞ্জুর করে তাকে এ মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। এছাড়া তাকে দুদকের আরেক মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন আদালত।

শ্রমিক হত্যা মামলা: রানা প্লাজা ট্রাজেডির ঘটনায় সাভার থানার এসআই ওয়ালী আশরাফ বাদী হয়ে ভবন নির্মাণে ‘অবহেলা ও ত্রুটিজনিত হত্যা’ মামলা দায়ের করেন। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলায় সাক্ষী করা হয় ৫৯৪ জনকে। মামলার ৪১ আসামির মধ্যে আবু বক্কর সিদ্দিক ও আবুল হোসেন মারা যান। দু’জনকে বাদ দিয়ে এখন আসামির সংখ্যা ৩৯ জন।

২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। অভিযোগ গঠনের পর থেকে এখন পর্যন্ত একজনেরও সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়নি।

ইমারত নির্মাণ আইনের মামলা: একই ঘটনায় ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন সাভার থানায় মামলাটি করেন।

২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলায় সাক্ষী করা হয় ১৩০ জনকে।

২০১৬ সালের ১৪ জুন ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। বর্তমানে ওই আদালতে মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে। অভিযোগ গঠন হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত একজনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।

দুই মামলার উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন- রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা, তার বাবা আব্দুল খালেক, মা মর্জিনা বেগম, সাভার পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার হাজি মোহাম্মদ আলী, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক (আর্কিটেকচার ডিসিপ্লিন) এ টি এম মাসুদ রেজা, প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসাইন, সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. রেফাতউল্লাহ, সাভার পৌরসভার সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায়, নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, সাবেক উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান রাসেল, সাভার পৌরসভার সাবেক টাউন প্ল্যানার ফারজানা ইসলাম, লাইসেন্স পরিদর্শক মো. আব্দুল মোত্তালিব, পৌরসভার সাবেক সচিব মর্জিনা খান, সাবেক সচিব মো. আবুল বাশার, ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলাম, নিউ ওয়েব বটমস লিমিটেডের এমডি বজলুস সামাদ ও ইথার টেক্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. আনিসুর রহমান।

এদিকে সম্পদের হিসাব দাখিল না করায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলায় রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার তিন বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। একই সঙ্গে তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো তিন মাসের দণ্ড দেয়া হয়। ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬ এর বিচারক কে এম ইমরুল কায়েস এ রায় ঘোষণা করেন।

জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মিথ্যা তথ্য দেয়ার অভিযোগে দুদকের দায়ের করা মামলায় রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার মা মর্জিনা বেগমকে ছয় বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন আদালত। কারাদণ্ডের পাশাপাশি তার ছয় কোটি ৬৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯৯০ টাকা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেন আদালত। ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ ঢাকার ৬ নম্বর বিশেষ জজ আদালত কে এম ইমরুল কায়েস এ রায় ঘোষণা করেন।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)