মানুষের স্মৃতিশক্তিকে নিয়ন্ত্রণের পথে বিজ্ঞান

অনলাইন ডেস্ক :
ভাবুন তো, আমাদের যদি স্মৃতি না থাকত তাহলে কী হতো? একটা ঘটনা ঘটার পরে আমরা আর তা কোনো দিনও মনে করতে পারতাম না। সুস্বাদু বিরিয়ানী খাবার পরে ২য় বার আর তা কখনোই খেতে চাইতাম না। কারণ সেই বিরিয়ানী খাওয়ার কোন স্মৃতিই যে আমাদের মস্তিষ্কে নেই। কিংবা নিজের প্রেমিক বা, প্রেমিকাকেই কিছুক্ষণ পর চিনতে পারতাম না।
অর্থাৎ, স্মৃতি যে আমাদের জীবনের কত গুরুত্বপূর্ণ এক অংশ তা আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি। আর বিজ্ঞানীরা এখন আমাদের সেই স্মৃতিকেই নিয়ন্ত্রণের পথে। হয়ত অদূর ভবিষ্যতেই তারা আমাদের অতীতের কোনো স্মৃতিকে ধ্বংস করতে সক্ষম হবেন কিংবা কোনো মিথ্যা স্মৃতিকে আমাদের মস্তিষ্কে সত্য হিসেবে ঢুকিয়েও দিতে পারবেন।
পথের শুরুটা হয়েছিল কার্ল ল্যাশলি নামের একজন বিখ্যাত মনোবৈজ্ঞানির হাত ধরে। তিনি ধারণা করেছিলেন যে, আমাদের স্মৃতিগুলো আমাদের মস্তিষ্কের কিছু নির্দিষ্ট অংশের কোষে কিছু নির্দিষ্ট বিন্যাসে সংরক্ষিত হয়ে থাকে। মস্তিষ্কের এই অঞ্চলের কোষের যে সমাবেশ তাকে এনগ্রাম বলে। মস্তিষ্কের এই অংশে পরিবর্তন দেখা যায় যখন আমরা কোন কিছু শিখি আবার মস্তিষ্কের এই অংশ উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে যখন আমরা কোনো কিছু মনে করার চেষ্টা করি।
বিভিন্ন ধরনের স্মৃতি আমাদের মস্তিষ্কের সেই নির্দিষ্ট নিউরন কোষগুলোর মাঝের সংযোগগুলোকে শক্তিশালী করে তোলে। যখন আমাদের মস্তিষ্ক সেই স্মৃতিগুলোকে মনে করার চেষ্টা করে তখন আমাদের মস্তিষ্কের সেই অংশটি আগের সেই সন্নিবেশে উজ্জ্বিবীত হয়।
ল্যাশলি তার জীবনভর গবেষণায় দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন যে, আমাদের মস্তিষ্কের কিছু নির্দিষ্ট অংশের টিস্যু নষ্ট করে দিলে আমাদের স্মৃতিরও কিছু অংশ সারা জীবনের জন্য নষ্ট হয়ে যাবে। তিনি তার এই মতবাদ প্রমাণের উদ্দেশ্যে বেশ কিছু অসাধারণ পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। তিনি ইঁদুরদের একটি গোলকধাম বা, গোলকধাঁধা থেকে কীভাবে বের হতে হয় এর উপর প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন এবং তারপর তাদের মস্তিষ্কের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ নষ্ট করে দিচ্ছিলেন। তিনি ধারণা করেছিলেন তিনি যদি স্মৃতির সেই নির্দিষ্ট অংশ ধ্বংস করতে সক্ষম হন তবে ইঁদুরগুলো তাদের জানা পথ ভুলে যাবে এবং আর গোলকধাম থেকে বের হতে পারবে না।
কিন্তু এরপরও ইঁদুরদের মস্তিষ্কের ঠিক কোথায় তাদের স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে তা তিনি বের করতে পারছিলেন না। ল্যাশলী তার সারা জীবন গবেষণার পরেও তার এই মতামতের পক্ষে কোনো প্রমাণ জোগাড় করতে ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত ১৯৫০ সালের দিকে এসে ল্যাশলি পরাজয় মেনে নেন এবং তার নতুন মত প্রকাশ করেন। নতুন করে তিনি বলেন, আমাদের স্মৃতি আমাদের মস্তিষ্কের ছোট একটি নির্দিষ্ট অংশে নয় গোটা মস্তিষ্কেই ছড়িয়ে থাকে।
ল্যাশলির ব্যর্থ গবেষণার প্রায় ৫০ বছর পর এসে টরোন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানী শিলা জোসেলিন এক দল ইঁদুরের উপর চালানো একটি পরীক্ষার ফলাফল দেখে বিভ্রান্ত হন এবং ল্যাশলির মতবাদের দিকে নতুনভাবে তাকাতে বাধ্য হন। ইঁদুরের মস্তিষ্কের এক পাশে অ্যামিগডালা নামক অংশে এমন কিছু কোষ রয়েছে যা তাদের স্মৃতির সাথে সংযুক্ত। জোসেলিন দেখলেন অ্যামিগডালা অংশের মাত্র কিছু কোষের বিন্যাস পরিবর্তনে ইঁদুরের স্মৃতিশক্তি নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়।
ইঁদুরগুলোকে একটা নির্দিষ্ট শব্দ শোনানোর পরে ইলেক্ট্রিক শক দেয়া হতো। এরপর একদল ইঁদুরের অ্যামিগডালা অংশের কোষে পরিবর্তন করা হয়েছিল। আরেক অংশের উপর এই পরিবর্তনের কাজ করা হয়নি। দেখা গেলো, যে ইঁদুরগুলোর মস্তিষ্কের কোষে পরিবর্তন করা হয়েছিল তারা এই ভয়ের স্মৃতি খুব ভালোভাবে মনে রাখতে পারে। কিন্তু অন্য ইঁদুরগুলোর ক্ষেত্রে এই উন্নতি দেখা গেলো না।
এর ফলে আমাদের মস্তিষ্কে স্মৃতিগুলো যে একটি নির্দিষ্ট অংশে থাকে এ ব্যাপারে জোসেলিন একটি আশার আলো দেখতে পেলেন। কিন্তু একটি সত্যিকারের প্রমাণ জোগাড় করতে তার প্রায় ১০ বছর সময় লেগে গেলো।
২০০৯ সালে এসে জোসেলিন এবং তার দল একদল ইঁদুরের মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কিছু কোষ ধ্বংস করে দিয়ে তাদের মস্তিষ্ক থেকে কিছু স্মৃতি চিরদিনের জন্য মুছে দিতে সক্ষম হলেন। অবশেষে ল্যাশলির মস্তিষ্কের এনগ্রাম অঞ্চলের খোঁজ শুরুর ১০০ বছরের বেশি সময় পর এসে স্নায়ুবিজ্ঞানী জোসেলিন সেই অঞ্চল খুঁজে পেলেন।
জোসেলিনের দলের এই সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল এক ধরণের আণবিক যন্ত্র, যা নতুন স্মৃতির সাথে যে নিউরন কোষগুলো উদ্দীপ্ত হত সেগুলোকে চিহ্নিত করতে সক্ষম ছিল।
শব্দ শোনার পর এবং ইলেক্ট্রিক শক দেয়ার আগে ইঁদুরের মস্তিষ্কের একটি নির্দিষ্ট অংশ উদ্দীপ্ত হয়। সেই অঞ্চলটাকেই খুঁজে বের করল ল্যাশলি এবং তার দল। এরপর ইঁদুরের মস্তিষ্কের সেই অঞ্চলের কোষগুলোকে মস্তিষ্ক থেকে সরিয়ে ফেলা হলো। কিন্তু অন্যান্য কোষগুলোকে আগের মতই রাখা হলো। দেখা গেল ইঁদুরগুলো আর শব্দ শুনে বিচলিত হচ্ছে না। তাদের শব্দ শোনার সাথে সাথে ভয়ের যে অনুভূতির স্মৃতি তা হারিয়ে গেছে।
এরপর আরো উন্নত পরীক্ষাও এসব ইঁদুরদের উপর চালানো হয়েছে। এনগ্রাম অঞ্চলের কোষের কাজ বিশেষ পদ্ধতিতে বন্ধ এবং পুনরায় চালু করে দেখা হয়েছে। এমনকি ইঁদুরদের স্মৃতি শুধু ধ্বংস করতেই বিজ্ঞানীরা সক্ষম হননি, তাদের মস্তিষ্কে মিথ্যা স্মৃতি ঢুকিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রেও তারা সাফল্য পেয়েছেন।
স্মৃতিকে নিয়ন্ত্রণের পথে এই এগিয়ে চলা একই সাথে অনেক উত্তেজনাপূর্ণ এবং অন্যদিকে খুবই ভীতিজনক। এ ধরনের প্রযুক্তি এতদিন শুধু বিজ্ঞান কল্পকাহিনীতেই দেখা যেত, যেখানে এই প্রযুক্তি কখনো সুখের সন্ধানে আবার কখনও ধোঁকা দিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে এ ধরনের গবেষণা বিভিন্ন স্মৃতিজনিত রোগের চিকিৎসা বা, মাদকাসক্তির চিকিৎসায় অবদান রাখতে সক্ষম হবে বলে গবেষকরা আশাবাদী।
Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)