মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত না করে জাতীয় পর্যায়ে দলিতদের উন্নয়ন সম্ভব নয়

২০১১- ২০১২ অর্থবছর থেকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি বয়স্ক ভাতা, শিক্ষা ভাতা ও কর্মসংস্থানের জন্য প্রশিক্ষণসহ দলিতদের জন্য কোটাভিত্তিক বিভিন্ন কর্মসূচি শুরু হয়। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সমাজসেবা অধিদপ্তর সাতক্ষীরাসহ ৪০টি জেলাতে বিশেষ নীতিমালা গ্রহণ করে। কিন্তু ওইসব কার্যক্রম চলমান থাকার পরও দলিতদের পরিচিতি সরকার দিতে চাইছে না। দলিতদের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত না করে সরকার বা রাষ্ট্রের পক্ষে ওই জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন সম্ভব নয়।
সাতক্ষীরার একটি বেসরকারি সংস্থার মতে জেলার মোট জনসংখ্যার প্রায় নয় শতাংশ মানুষ সংখ্যালঘু হিন্দু ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের। এদের মধ্যে দলিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এক শতাংশ। ৯০ শতাংশ দলিত নারী প্রায় অশিক্ষিত। এদের মধ্যে অনেকেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হননি। আবার কেউ বা এসএসসি পর্যন্ত যেয়ে উত্তীর্ণ হতে পারেননি। ঝরে পড়া এসব দলিত জনগোষ্ঠীর জন্য পরিত্রাণ, ভূমিজসহ কয়েকটি সংগঠন কাজ করলেও সরকারিভাবে কোন উদ্যোগ চোখে পড়ে না । তাছাড়া দলিত জনগোষ্ঠীর পুরুষদের মধ্যেও শিক্ষার হার আরো অনেক কম। অনেকেই এখনো টিপ সহি দিয়ে থাকেন। তবে দলিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে পৈতৃক পেশা পরিবর্তন করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে চান তারাও সংখ্যাগুরু ও হিন্দু সম্প্রদায়ের উঁচু বর্ণের মানুষের কাছে অস্পৃশ্য হিসেবে গণ্য হওয়ায় তাদের সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। পরিবর্তিত পেশাতেই তারা ভালভাবে কাজ করতে পারেন না। বিকল্প পেশায় তাদের সামাজিক বাধা থাকায় তারা সেখানে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন না। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না হলে বা সরকারিভাবে বিকল্প ব্যবস্থা না নিলে বিকল্প কর্মসংস্থান ব্যবস্থা পড়ে যায় চ্যালেঞ্জের মুখে। এজন্য সরকারকে দলিত জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ করে নারীদের ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি করে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
সাতক্ষীরার তালা এলাকার একজন আইনজীবী জানান, তিনি কয়েক বছর ধরে এ পেশায় নিয়োজিত। এ পেশায় কাজ শুরুর পর থেকেই ঋষি সম্প্রদায়ের মানুষ হিসেবে পরিচিতি হয়ে যাওয়ায় তার সঙ্গে একই টেবিলে কেউ চা পান করতে চান না। একই কথা বলেন, তালা উপজেলার বরাত এলাকার একাধিক দলিত শিক্ষিতা কলেজ ছাত্রী ও এনজিও কর্মী। তারা জানান, প্রাথমিক স্তর থেকে তারা আত্মমর্যাদার গ্লানিতে ভুগতে থাকেন। শুধু সহপাঠী নয়, শিক্ষকদের কাছে ও তারা অচ্ছুৎ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, কর্মসংস্থানসহ রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্ঠনিক যে সব কর্মসূচি রয়েছে তাতে দলিতদের জন্য পৃথক বিশেষ বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়নি। সেখানে অনগ্রসর হিসেবে দলিতদের একই কাতারে রাখা হয়েছে। এটা দলিতদের উন্নয়নের জন্য একটা বড় অন্তরায়। ২০১১-২০১২ অর্থ বছরে সমাজ সেবা অধিদপ্তর যে প্রকল্প হাতে নিয়েছিল তা জাতীয় বাজেটে অংশ ছিল। সুনির্দিষ্টভাবে বাজেটে প্রকল্প রাখা হয়েছিল। এখন দলিতদের জন্য শিক্ষা ক্ষেত্রে এক শতাংশ কোটা রয়েছে। তবে বিগত বাজেটে অনগ্রসর হিসেবে দেখানো হয়েছে। সমাজ সেবা অধিদপ্তর সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্ঠনিক কর্মসূচিতে দলিত, হরিজন, বেদে উন্নয়ন প্রকল্প সরকার চালু রেখেছে। তা বাস্তবে কতটাই ফলপ্রসূ হচ্ছে তা না দেখলে বলা যাবে না। দলিতদের উন্নয়নে সরকারের যে সদিচ্ছার অভাব সেটাই প্রমাণ করে। বেসরকারি সংগঠনগুলো দলিত জনগোষ্ঠীর প্রকল্পে উল্লেখিত মর্যাদা বা অধিকার নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। দলিতদের মর্যাদা রক্ষায় সরকারকে ওইসব বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে উদ্বুদ্ধকরণ কাজে দায়িত্ব নিতে হবে। তা নাহলে শুধু দলিত শব্দ তুলে দিয়ে সেখানে প্রান্তিক বসিয়ে লাভের পরিবর্তে ক্ষতি ছাড়া কিছুই হবে না।
সাতক্ষীরা জজ কোর্টের আইনজীবী অ্যাড. তাপস কুমার দাস বলেন, দলিত একটি বিশেষ গোষ্ঠীর নাম না ধরে একটি বিশেষ আন্দোলন হিসেবে ধরতে হবে। দলিতকে প্রাথমিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে নীতি নির্ধারকদের দ্বৈতচারিতা পরিহার করতে হবে। মানবাধিকার বা মর্যাদাগত অধিকার সুরক্ষা সমতার জন্য আইন আছে। বিশেষ এই শ্রেণির জন্য বৈষম্য বিলোপ আইন খসড়া হলেও রাজনৈতকিভাবে তার গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। সেকারণে প্রচলিত বৈষম্য চলমান রয়েছে। একই মন্ত্রী একবার দলিত জনগোষ্ঠীর জন্য বাজেট বরাদ্দের কথা বলে পরবর্তী বাজেটে তা বাদ দিয়ে অনগ্রসর শ্রেণির কথা বলে দ্বৈতচারিতার আশ্রয় নিচ্ছেন। বৈষম্য প্রতিকারের জন্য সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। সরকার তার পরিষদে দলিত জনগোষ্ঠীর পরিচিতির জায়গা তৈরি না করে পরিকল্পনা নেবেন কীভাবে। ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিরা যদি সামাজিক উন্নয়নে দলিতদের মতামতকে গুরুত্ব না দেয় তাহলে তাদেরকে মর্যাদাহীন করা হবে। বহুমাত্রিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে দলিত নারীরা পুরুষ শাসিত সমাজে নানাভাবে নির্যাতিত। তাদেরকে নিরক্ষর রাখা হয়। তাদেরকে বাদ দিয়ে সমগ্র জাতির উন্নয়নের চেষ্টা করলে তা ব্যাহত হবে। সেখানে মানবাধিকার সামগ্রিকভাবে বিঘ্নিত হবে। সরকার ঢাকায় বস্তিবাসীদের জন্য আবাসন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কলোনি থেকে তুলে আনা কতজন হরিজন তাতে আশ্রয় নিতে পারবে? পৃথক আবাসন ব্যবস্থা না থাকা অনগ্রসর হিসেবে পরিচ্ছন্ন কর্মীদের সামাজিক মর্যাদার অভাবে সেখানে বসবাস করা সম্ভব হবে না। মর্যাদার সঙ্গে উন্নয়ন না হলে সে উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়বে। এজন্য সরকার ও রাষ্ট্রকে নতুন করে ভাবতে হবে।
বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী বিকাশ দাস বলেন, বংশগত পেশার বাইরে বেরিয়ে পরিবর্তিত পেশায় সামাজিক বাধার শেষ নেই। দলিতদের কোন হোটেলে মানুষ খেতে যেতে চান না। তাহলে সেই হোটেল টিকে থাকবে কিভাবে? একজন সাধারণ নির্যাতিত নারীর চেয়ে দলিত নারীরা ১০ গুন নির্যাতিত। সমাজের একাংশের অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া নারীদের বাদ দিয়ে জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। দলিতদের পরিচয়ে দলিতদের স্বীকৃতি দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সরকারকেই বিশেষ নীতিমালা বা উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা না গেলে শুধুমাত্র মুখে মুখে বড় বড় কথা বলে দলিতদের ভাগ্যের পরিবর্তন করানো যাবে না।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)