ফুলন: একজন দস্যুরাণী বনাম মায়াদেবী

একজন দুর্ধর্ষ নারী দস্যু, কিন্তু তার কাহিনী জানার পর আপনার ভেতরেও জেগে উঠতে পারে শ্রদ্ধাবোধ। সমাজ ব্যবস্থা যখন দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় এবং কিছু মানুষ সুবিচার থেকে বঞ্চিত হয়, তখন কেউ কেউ নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নেয়ার দায়িত্ব হাতে তুলে নেন। ঠিক তেমনই একজন ফুলন দেবী। যিনি গণধর্ষনের স্বীকার হয়েছেন, খুন করেছেন, ডাকাত দলের সঙ্গে মিশে তাদের দলনেত্রী হয়েছেন, পুলিশের মোস্ট ওয়ান্টেড অপরাধী থেকে দুবার এমপিও হয়েছেন।

জন্ম ও বিয়ে:

১৯৬৩ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের জালৌন জেলার ঘোড়া কা পুরয়া নামে এক অজপাড়া গাঁয়ে হিন্দু ধর্মের নিম্নবর্ণ মাল্লার সম্প্রদায়ের এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম হয় এক কন্যা শিশুর। যার নাম রাখা হয় ফুলন। মাল্লা সম্প্রদায়ে কন্যা শিশু হয়ে জন্ম নেয়া ছিল এক ধরনের অভিশাপ। গরীব মাল্লা যাদের প্রধান পেশাই ছিল নৌকা চালানো, তাদের জন্য মেয়ে বোঝা ছাড়া বেশি কিছু ছিল না। কিন্তু সেদিন কেউ কল্পনাও করেনি এই শিশু একদিন কিংবদন্তি হয়ে উঠবে।

ফুলন: একজন দস্যুরাণী বনাম মায়াদেবী

ফুলনের পিতার মাত্র এক একর জমি ছিল, যাতে তিনি নীম চাষ করতেন। ইচ্ছা ছিল, এতে করে দুই মেয়ের বিয়ের জন্য যৌতুকের টাকা জোগাড় হয়ে যাবে। ফুলনের বড় চাচা ও চাচাতো ভাই মায়াদিন মিলে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে সকল সম্পত্তি থেকে ফুলনের পিতাকে বঞ্চিত করে। ফুলনের পিতা তাদের এই প্রতারণার তেমন প্রতিবাদ না করলেও সে সময় ফুলন এর তীব্র প্রতিবাদ করে। মায়াদীন কে চোর, প্রতারক বলে সারা গ্রামে প্রচার করতে থাকে। সে সমাজে কোন নারীর প্রতিবাদ করা যেনতেন ব্যাপার ছিল না। পুরুষদের কাজের ব্যপারে নাক গলানোর কথা তারা ভাবতেও পারত না। এমনকি মায়াদীন ফুলনের গায়ে হাত তুলতে গেলে ফুলনও তার গায়ে হাত তুলে। ফলে ফুলনের প্রতি সমাজের সকলেরই খারাপ ধারণা হতে থাকে।

ফুলনের চাচা ও চাচাতো ভাই প্রতিবাদি ফুলনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তার বিয়ে ঠিক করে। মাত্র ১১ বছরের ফুলনের বিয়ে হয় ৩০ বছর বয়সী পুট্টিলালের সঙ্গে। ফুলনের আত্মজীবনীতে পাওয়া যায়, “পুট্টিলাল অসৎ চরিত্রের লোক। শ্বশুরবাড়িতে জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন এবং নির্যাতন চলত নিয়মিত। বাবার বাড়িতে ফিরে গেলেও সমাজের দিকে চেয়ে তাকে আবার শ্বশুরবাড়িতে রেখে আসা হয়। অবস্থার কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় ফুলন এবার মুখের উপর প্রতিবাদ জানিয়ে স্থায়ীভাবে চলে আসে বাবার বাড়িতে। মাল্লা সমাজে স্বামী পরিত্যাগ করা নারীকে চরিত্রহীনা বলা হতো। কাজেই ফুলনকে নিয়ে একের পর এক কুৎসা রটতে থাকে।”

পিতৃগৃহে ফিরে আসার পর আবারো চাচাতো ভাই মায়াদিন এর রোষানলে পড়েন ফুলন। পূর্বের অপমান ও সম্পত্তির ব্যাপারে প্রতিশোধ নিতে মায়াদীন ফুলনের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ এনে মামলা করে। থানার কর্তা পরিচিত হওয়ায় অর্থ খরচ করে গ্রেফতার করায়। থানায় টানা তিনদিন নির্মম ভাবে গণধর্ষন করা হয় তাকে। কোন উচ্চবাচ্য না করার হুমকি দিয়ে সাধারণ নারীর মত জীবন যাপনের পরামর্শ দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় ফুলনকে। গ্রামে ফিরে আসার পর পরিবার ও গ্রামবাসী এই ধর্ষিতা মেয়েকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়।

ফুলনের পরিবার তার শ্বশুরবাড়ি ও স্বামীকে অনুরোধ করে পুনরায় তাকে গৃহে তোলার জন্য। তখন তার বয়স ১৬। তাদের বোঝানো হয় তখন শিশু ছিল, এখন বড় হয়েছে, বুঝতে শিখেছে। তাই আরেকটিবার সুযোগ যেন তাকে দেয়া হয়। কোনভাবেই যখন রাজি হচ্ছিল না তখন কিছু উপহার দেয়ার শর্তে রাজি করানো হয়। তাছাড়া হিন্দু সমাজে স্ত্রী বর্তমান থাকলে দ্বিতীয় বিয়ের নিয়ম না থাকায় রাজি হয় তারা। স্বামীগৃহে প্রত্যাবর্তন ঘটে কিশোরী ফুলনের। কিন্তু নির্যাতন অব্যহত থাকার অভিযোগ তুলে স্থায়ীভাবে স্বামীর ঘর ছেড়ে পিতৃগৃহে চলে আসে ফুলন। সেখান থেকে উপহার ফেরত দিয়ে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়া হয় এরপর আর কোনভাবেই ফুলনকে গ্রহণ করবে না তারা।

ডাকাত দলে জীবন:

ডাকাত দলে অংশ নেয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়। ১৯৭৯ সালে এক ডাকাত দলের সাথে জড়িয়ে যান ফুলন। কিভাবে তা নিয়ে রয়েছে রহস্য। মালা সেনের লেখা “ইন্ডিয়া’স ব্যান্ডিট কুইন: দ্য ট্রু স্টোরি অফ ফুলন দেবী” বইয়ে লেখা আছে, গ্রাম থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর স্থানীয় ডাকুরা তাকে অপহরণ করে।” আবার কেউ কেউ বলেন, ডাকাত দলে যোগ দেয়ার জন্যই নাকি তিনি প্রথম স্বামীকে পরিত্যাগ করেন। কেউ বলেন ডাকাত দল ফুলনের সাহসী স্বভাবের কারনে অপহরণ করে। আবার কেউ বলেন ফুলন সমাজের নির্যাতন ও অপমানের প্রতিশোধ নিতে স্বেচ্ছায় ডাকাত দলের সাথে যোগ দেয়। এ বিষয়ে নিজের আত্নজীবনীতে পরিষ্কার করে কিছু বলেননি ফুলন দেবী। শুধু লিখেছেন “এটা ছিল ভাগ্যের লিখন”।

ফুলন: একজন দস্যুরাণী বনাম মায়াদেবী

ডাকাত দলে যোগ দিয়েও সে নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। ডাকাত দলের দলনেতা বাবু গুজ্জর ধর্ষনের চেষ্টা করে। কিন্তু ফুলনের জীবনে নায়ক হিসেবে আবির্ভাব ঘটে এক পুরুষের! ডাকাত দলের দ্বিতীয় দলনেতা বিক্রম মাল্লা। বাবু গুজ্জরকে হত্যা করে ফুলনকে রক্ষা করে বিক্রম হয় দলনেতা। ফুলন এবং বিক্রম একে অন্যের প্রেমে পড়েন। অবশেষে বিক্রম তাঁকে বিবাহ করে স্ত্রীর মর্যদা দেন। ফুলন দেবী স্বামী বিক্রম মাল্লার কাছ থেকে থেকে বন্দুক চলানো শিখে নেয়। স্বামীর সাথে উত্তর প্রদেশ ও মধ্য প্রদেশ বসবাসকারী উচ্চ বর্ণের লোকদের গ্রামে লুন্ঠন, ভূস্বামীদের অপহরন, রেল ডাকাতি ইত্যাদি বিভিন্ন অভিযান চালান। প্রতিবার ডাকাতি করে আসার পর দুর্গাদেবীর মন্দিরে গিয়ে প্রাণ রক্ষার জন্য দেবীকে ধন্যবাদ জানিয়ে আসতেন ফুলন।

যাতে আর কোন মেয়ের জীবন নষ্ট করতে না পারে সে জন্য ফুলন তার পুট্টিলালকে শাস্তি দেন ফুলন। গাধার পিঠে উল্টো করে বসিয়ে পুরো গ্রাম ঘুড়িয়ে নির্জন স্থানে নিয়ে পিটিয়ে প্রায় মৃত অবস্থায় পুট্টিলালকে ফেলে রেখে যান। যাওয়ার সময় কম বয়সী বালিকাদের বিবাহ করা ও নির্যাতন করা পুরুষদের উদ্দেশ্যে করে সাবধানবানী লিখে একটি পত্র রেখে যায়।

ঠাকুর সম্প্রদায়ের হত্যা:

ঠাকুর সম্প্রদায়ের শ্রী রাম নামক এক ডাকাত ছিল ফুলনের স্বামী বিক্রম মাল্লার গুরু কিন্তু পরবর্তীতে হয়ে উঠে প্রতিপক্ষ। শ্রী রাম জেল থেকে ফিরে আসার পর দলের নেতা কে হবে এ নিয়ে বিভাজন দেখা দেয় দলের মাঝে।

শ্রী রাম বিক্রেমকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সুযোগ খুঁজতে থাকে। একবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর দ্বিতীয় চেষ্টায় সে বিক্রমকে হত্যার পর প্রচার করে দলনেতা হওয়ার লোভে ফুলনই বিক্রমকে হত্যা করেছে।

শ্রী রাম ফুলনকে আটক করে প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় ঠাকুরদের গ্রাম বেহমাই এ নিয়ে যায়। বিক্রমকে হত্যা করার অপরাধে ফুলনকে শাস্তি দেওয়ার জন্য গ্রামবাসীদের আহবান করে। শাস্তিস্বরুপ প্রথমে শ্রী রাম ফুলনকে ধর্ষণ করে। তারপর এক এক করে ঠাকুর সম্প্রদায়ের অনেকে তাঁর উপর যৌন ও শারীরিক নির্যাতন চালায়। ৩ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে তাঁর উপর চলে এই অমানুষিক অত্যাচার। ২৩ দিন পর মৃত ভেবে ফুলনকে ফেলে রেখে যাওয়া হয়। জ্ঞান ফিরে আসার পর ফুলন এক গরুর গাড়ির সাহায্যে ব্রাহ্মণ ব্যক্তির সাহায্যে ফুলন বেহমাই গ্রাম থেকে পালাতে সক্ষম হয়।

তবে ফুলন দেবী নিজমুখে কখনো এই গণধর্ষণের কথা সরাসরি স্বীকার করেননি। তার আত্মজীবনীর লেখিকা মালা সেনকে বলেছেন, “ওরা আমার ওপর অনেক অন্যায়-অত্যাচার করেছে।” এই একটি লাইনকেই অবশ্য ফুলন দেবীর সার্বিক অবস্থার প্রতীকীরূপ বলে বিবেচনা করা যায়। তবে ধরে নেয়া যায়, যতই দুর্ধর্ষ হোক না কেন নারীদের চিরাচরিত নিয়ম মেনে নিজের ধর্ষনের কথা স্বীকার করে নিতে পারেননি। লোকলজ্জার ভয়কে দস্যুরাণী নিজেও উপেক্ষা করতে পারেনি। স্থানীয়রা বিভিন্ন সময়ে ধর্ষনের ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তবে ধর্ষণের শিকার অন্যান্য নারীদের মতো চুপ করে বসে থাকেনি ফুলন। নিজের অপমানের প্রতিশোধ নিতে তৎপর হয়ে ওঠে। বিক্রমের বন্ধু, মান সিংহ, ফুলনের দুর্দশার খবর পায়। তার সাহায্যে মুসলিম ডাকু সর্দার বাবা মুস্তাকিমের কাছে পৌঁছায় সে।

১৯৮১ সনের ১৪ ফেব্রয়ারী রাম ভাতৃদ্বয়কে হত্যা করার জন্য বেহমাই গ্রামে প্রবেশ করে। সেই সময় বেহমাই গ্রামে ঠাকুরদের এক পরিবারে চলছিল এক বিবাহ উৎসব। ফুলন ও দলের সদস্যরা সম্পূর্ন গ্রাম খুজেও রাম ভাতৃদ্বয়কে পায়নি। ফুলন রাম ভাতৃদ্বয়কে তাঁর হাতে তুলে দেয়ার জন্য অন্যদের প্রতি আদেশ করেন। ফুলনের দল ক্রোধে ঠাকুর সম্প্রদায়ের যুবকদের গুলি করে। এতে ২৩ জন ঠাকুর নিহত হয়। কিন্তু পরে ফুলন দেবী দাবী করেন যে তিনি নিজহাতে কাউকে গুলি করেননি। অন্য সদস্যরা ক্ষিপ্ত হয়ে গুলি চালায়। এটিই হচ্ছে কুখ্যাত বেহমাই হত্যাকাণ্ড বা বেহমাই গণহত্যা। যা বেশ হইচই ফেলে দিয়েছিল এবং বাধ্য হয়ে সেই সময়ের উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ভিপি সিং পদত্যাগ করেছিলেন।

এই ঘটনায় অত্যাচারী ঠাকুরদের নির্যাতনের শিকার জনতার কাছে দস্যুরাণী ফুলনদেবী জনপ্রিয় হয়ে উঠে মায়াদেবী নামে। সেই সময়ে উত্তর প্রদেশের শহরগুলিতে দুর্গার বেশে ফুলনের মূর্তি বিক্রয় হয়েছিল।

আত্মসমর্পন:

৪৮টি অপরাধের জন্য, যার মধ্যে ৩০টি ডাকাতি এবং অপহরণের অভিযোগ, প্রায় দু’বছর পর শর্তসাপেক্ষে পুলিশে কাছে ধরা দেয় ফুলন দেবী। সরকার তাঁর সব শর্ত মেনে নিয়ে আত্মসমর্পনে আহবান জানায়।

ফুলন: একজন দস্যুরাণী বনাম মায়াদেবী

১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিপুল জনতার মাঝে ফুলন আত্মসমর্পন করেন। মঞ্চে উঠে হাতজোড় করে তিনি জনসাধারনকে নমস্কার জানিয়ে মহাত্মা গান্ধীর ছবির সামনে সঙ্গের অস্ত্র রেখে আত্মসমর্পণ করেন।

রাজনীতিতে আগমন:

১১ বছর কারাভোগের পর ফুলন সমাজবাদী পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৯৬ এবং ১৯৯৯ সালে লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন।

ফুলন: একজন দস্যুরাণী বনাম মায়াদেবী

মৃত্যু:

২০০১ সালের ২৫ জুলাই সংসদ থেকে বের হয়ে আসার সময় নয়া দিল্লীতে ফুলন দেবীকে হত্যা করা হয়। ঠাকুর পরিবারের তিন ছেলে শের সিং রাণা, ধীরাজ রাণা এবং রাজবীর ফুলন দেবীকে এলোপাতাড়ি গুলি করে পালিয়ে যায়। হত্যাকারীরা পরবর্তীতে প্রকাশ করেন যে বেহমাই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এই হত্যা করা হয়েছিল।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)