জেলায় মাছ উৎপাদনে নীরব বিপ্লব

মাছের উৎপাদনে সাতক্ষীরায় নীরব বিপ্লব চলছে। জেলার জনগোষ্ঠীর চাহিদা মিটিয়েও অতিরিক্ত প্রায় ৮৯ হাজার মেট্রিক টন মাছের উৎপাদন হচ্ছে। কর্মসংস্থান সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ৫ লক্ষ নারী ও পুরুষের। এখান কার প্রধান পেষা কৃষির পরই মৎস্যের অবস্থান। দেশের বিভিন্ন এলাকায় যাওয়ার পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে জেলার মাছ। হিমায়িত খাদ্য উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। আর এর পেছনে সাতক্ষীরার অবদান অনেক বেশি। তাই মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে জেলার সব মৎস্য চাষিদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনার চেষ্টা করছে জেলা মৎস্য বিভাগ।
মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, জেলায় প্রতিবছর গড়ে এক লাখ ৩১ হাজার ৫১৬ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়। জেলায় মাছের চাহিদা ৪২ হাজার ২৯৩ মেট্রিক টন। ৮৯ হাজার ২২৩ মেট্রিক টনের মধ্যে একাংশ বিদেশে রপ্তানি এবং অবশিষ্ট মাছ দেশের অন্যান্য এলাকায় পাঠানো হয়।
সম্প্রতি বছর গুলোতে জেলায় মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় উপযোগিতাও বেড়েছে। আগে মাথা প্রতি ২০ থেকে ৩০ গ্রাম মাছ ব্যবহার হলেও এখন মাথা প্রতি দৈনিক গড়ে ৬০ গ্রাম মাছ ব্যবহার করছে সাতক্ষীরার মানুষ বলে মৎস্য বিভাগ জানায়।
সূত্র জানায় বর্তমানে জেলাতে ৫০ হাজার ১৮টি পুকুরে কার্পজাতীয় মাছের চাষ হচ্ছে। বছরে জেলাতে কার্পজাতীয় মাছ উৎপাদন হচ্ছে ৬২ হাজার ১২ মেট্রিক টন,মনোসেক্স তেলাপিয়া,পাঙ্গাশ উৎপাদন হচ্ছে ১৬ হাজার ৫ মেট্রিক টন,ঘেরে রুই জাতীয় মাছ উৎপাদন হচ্ছে ৩৩ হাজার ৫০ মেট্রিক টন, লবণাক্ত পানিতে সাদা মাছ উৎপাদন হচ্ছে ৭৩ হাজার মেট্রিক টন, ধানক্ষেতে সাদা মাছ উৎপাদন হচ্ছে ১৪ হাজার ৫০ মেট্রিক টন, নদী, মোহনা, বাওড়, খাল, বিল, বারোপিট, প্লাবন ভূমি এবং সুন্দরবন এলাকায় বছরে মাছ উৎপাদন হয় ৩৭ হাজার ৬০ মেট্রিক টন। এছাড়া অন্যান্য চিংড়ি যেমন হরিণা,চাকা এবং চ্যামা উৎপাদিত হয় ৪ হাজার ২৫ মেট্রিক টন। কাঁকড়া ও কুচিয়া উৎপাদন হয় ৩১শ’ মেট্রিক টন।
জেলাতে মৎস্য হ্যাচারি রয়েছে ২৫টি, মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা রয়েছে ২টি, মৎস্য আড়ৎ রয়েছে ৩২টি। এছাড়া ২৭৮টি মৎস্য ডিপো, ৪৪টি বরফকল, ১৫টি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র এবং ৫৮টি পাইকারি মৎস্য বিপণন কেন্দ্রের মাধ্যমে সারা বছর মাছ বাজারজাত করা হয়।
জেলা মৎস্য বিভাগের বিভিন্ন তথ্য উপাত্তে দেখা যায়, সাতক্ষীরার চিংড়ি বিদেশে রপ্তানির বাজার দখল করেছে। এখানে উৎপাদিত হচ্ছে সব ধরনের সুস্বাদু সাদা মাছ। চিংড়ির পাশাপাশি কৈ, মাগুর, শিং, শোল, পাঙ্গাশ, মনোসেক্স তেলাপিয়া, কার্পজাতীয় মাছ ছাড়াও জেলাব্যাপী কাঁকড়া ও কুচিয়ার চাষ ছড়িয়ে পড়েছে। জেলার ৫৫ হাজার ১২২টি বাগদা চিংড়ি ঘের ও ১১ হাজার ৬৩৮ টি গলদা চিংড়ি ঘেরের এক চতুর্থাংশে আধানিবিড় ও নিবিড় চিংড়ি চাষ করা গেলে জেলার চিংড়ি উৎপাদন ৮ থেকে ১০ গুণ বেড়ে যাবে বলে জানানো হয়। বেসরকারি হিসাবে বাগদা ও গলদা চিংড়ি ঘেরের সংখ্যা আরো বেশি। এসব ঘেরের মিষ্টি পানিতে ধান ও মাছ এক সাথে চাষ করা গেলে সাতক্ষীরায় মাছ উৎপাদনে বৈপ্লবিক উন্নয়ন হতে পারে এ খাতে সংশ্লিষ্টদের দাবী।
সূত্র জানায় জেলায় বাগদা ও গলদা পোনার চাহিদা প্রায় সাড়ে ৩৪৪ কোটি। এর মধ্যে বাগদা পোনার চাহিদা ৩৩৪ কোটি এবং গলদা পোনার চাহিদা ১০ কোটি ৫৫ লক্ষ।
জানা যায়, চলতি ২০১৭-১৮ মৌসুমে সাতক্ষীরার সাতটি উপজেলাতে নিবন্ধিত ৪৯ হাজার ২৩টি ঘেরে মৎস্য চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরায় সদর উপজেলাতে দুই হাজার ১০৫টি, তালায় এক হাজার ২৯৫টি, দেবহাটায় দুই হাজার ৮২৯টি, আশাশুনিতে ১৩ হাজার ২১৭টি, কালিগঞ্জে ১৪ হাজার ৫৫৯টি ও শ্যামনগরে ১৩ হাজার ১৫৮ এবং কলারোয়াতে দুই হাজারটি। চলতি মৌসুমে সাতটি উপজেলায় ৬২ হাজার হেক্টর জমিতে মাছ চাষ করা হয়েছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে জেলায় ৯৩ হাজার মেট্রিক টন সাদা মাছ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা গত মৌসুমের তুলনায় সাত হাজার টন বেশি।
সূত্র জানায়, জেলায় ৭৬ হাজার ৩৯৪ জন মাছ চাষি রয়েছে। মৎস্য খাতকে আরো উন্নত করে তুলতে জেলার ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ জমির মালিককে প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে তাদের মাছ চাষে আগ্রহী করে তোলা হচ্ছে। অপরিকল্পিত চিংড়িঘের বন্ধ করতে পারলে পানি নিষ্কাশন বন্ধ হবে। জলাবদ্ধতার হ্রাস পাবে। বৃদ্ধি পাবে মাছের উৎপাদন। সরকারী হিসাব মতে জেলাতে ২ হাজার ৪৯ জন মৎস্য চাষিকে প্রশিক্ষণের আয়তায় আনা সম্ভব হয়েছে। বাকি মাছ চাষিদের প্রশিক্ষণের আয়তায় আনতে পারলে মৎস্য উৎপাদন বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত।
বর্তমানে বাজারে মাছের মূল দ্বিগুণ হওয়াতে চাষিরা ব্যাপক খুশি। চাহিদার তুলনা উৎপাদন কম ও মাছের ভরা মৌসুম না হওয়াতে বাজারে চড়া দামে মাছ কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। ফলে মাছের পরিবর্তে বিকল্প খাবার খেয়ে আমিষের চাহিদা মেটাচ্ছে সাধারণ মানুষ ।সাতক্ষীরা সুলতান বড়বাজার,বিনেরপোতা মাছের আড়ৎ,শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ মাছের আড়ৎ সহ কয়েকজন মাছ চাষির সাথে কথা বলে জানা যায়,মাছের মৌসুম না হওয়াতে বাজারে সবধরনের মাছের দাম দ্বিগুণ। এক কেজি ওজনের রুই মাছ বাজারে দাম ২৩০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। দেড় থেকে দুই কেজি ওজনের কাতলা মাছের দাম ছিল ৩৫০ টাকা পর্যন্ত। এক কেজি ওজনের মাছ বিক্রি হয়েছে ২০০ টাকা। তেলাপিয়া মাছের দামও একশ এর উপরে। তবে পাঙ্গাশ ও মাগুর মাছের দাম তুলনা মূলক কম।
সাতক্ষীরার তালার খলিশ খালির মঙ্গলানন্দাকাটী গ্রামের মাছচাষি মুক্তাদির শেখ (লিমন) জানান, ১২ বিঘা জমিতে মিশ্র কার্প জাতীয় মাছ চাষ করেছেন। ঘেরে ভাইরাসের আক্রান্ত না হলে ৫ লক্ষ টাকার মাছ বিক্রি করতে পারবে। এতে তার দেড় থেকে দুই লক্ষ টাকা লাভ থাকতে পারে। আধুনিক পদ্ধতিতে সে মাছ চাষ করে। যে কারণে তার ঘেরে মাছের রোগ ব্যাধি কম হয়। তার দাবী সব মাছ চাষিদের প্রশিক্ষণ নেওয়ার ব্যবস্থা করলে মাছের উৎপাদন বাড়বে।
শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জবাজারের নিয়মিত মাছ বিক্রি করেন দাতিনা খালির আব্দুস সাত্তার। তিনি জানালেন, চাষিদের প্রশিক্ষণ দেয়া,মৎস্য বিভাগের তদারকি বাড়ানোসহ মাছের খাদ্যের দাম একটু কমলে মৎস্য চাষে লাভবান হবে চাষিরা।
সাতক্ষীরা জেলা মাছ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আলহাজ আব্দুর রব জানান, চলতি মৌসুমের শুরু থেকে বাজারে বিপুল পরিমাণ সাদা মাছ ওঠেছে। বর্তমানে মাছের মৌসুম না হওয়াতে বাজারে মাছ কম। সে কারণে সব ধরণের মাছের দাম একটু বেশি।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অফিসার মো. শহীদুল ইসলাম জানান, এখানকার মাটি ও আবহাওয়ার কারণে সব ধরনের মাছ উৎপাদন হয়ে থাকে। তবে গত কয়েক বছর ধরে চিংড়ি ঘেরের সাথেও সাদা মাছ চাষ করছেন চাষিরা। তা ছাড়াও পৃথকভাবেও সাদা মাছ উৎপাদন হচ্ছে সাতক্ষীরাতে। চলতি মৌসুমে সাদা মাছের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে উৎপাদন তার অনেক বেশি। বর্তমানে চাহিদার তুলনায় বাজারে মাছের সরবরাহ কম থাকায় দাম একটু বেশি। তবে এতে চাষিরাই লাভবান হচ্ছে ।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)