কলারোয়ায় মহান মুক্তিযুদ্ধের সাহসী এক যোদ্ধার নাম সৈয়দ আলী গাজী

জুলফিকার আলী,কলারোয়া:
সাতক্ষীরার কলারোয়ায় মহান মুক্তিযুদ্ধের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধকালীন আগুনঝরা দিনগুলোতে কলারোয়ার দামাল ছেলেরা জীবণ বাজি রেখে কলারোয়াকে করেছিলেন পাক হানাদার মুক্ত। মুক্তিযোদ্ধা-জনতার বিজয় উল্লাসে মুখরিত হয় কলারোয়ার পবিত্র মাটি। দেশ স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। একাত্তরে কলারোয়ার রণাঙ্গনে সকল যোদ্ধাই প্রাণপণ যুদ্ধ করেছেন। এরা সকলেই পরম শ্রদ্ধার পাত্র। তবে একাত্তরে ৮ ও ৯ নং সেক্টরে যিনি অবাধ বিচরণ করে যুদ্ধে অসীম সাহসিকতা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়ে কমান্ডারদের দৃষ্টি কেড়েছিলেন, তিনি হলেন কলারোয়া পৌর সদরের গদখালি গ্রামের সৈয়দ আলি গাজী (৬৫)। বর্তমানে তিনি কলারোয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডের সাংগঠনিক কমান্ডার। যুদ্ধকালীন অত্যন্ত ক্ষিপ্র, অস্ত্র চালনায় পারদর্শী অসীম সাহসী ও তেজোদ্দীপ্ত মানুষটি আজ মহান মুক্তিযুদ্ধের ৪৭তম বর্ষে পদার্পণ করেছেন। সঙ্গত কারণেই বয়স কেড়ে নিয়েছে তার সেই অমিত শারীরিক শক্তি। কিন্তু কেড়ে নিতে পারেনি অদম্য মনোবল। সৈয়দ আলি জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসেও স্বপ্ন দেখেন মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত সুখি-সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ বিনির্মাণের। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে চান এ প্রজন্মের মাঝে। বীর যোদ্ধা সৈয়দ আলির সাথে বৃহস্পতিবার কলারোয়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদে একান্ত আলাপচারিতায় উঠে আসে যুদ্ধকালীন নানা প্রসঙ্গ। তিনি বর্ণনা করছিলেন তাঁর যৌবনের দুরন্ত দিনগুলোর যুদ্ধকালীন নানা স্মৃতির কথা। কথা বলে আরো জানা গেলো, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্দীপ্ত হন। এর একদিন পরই কলারোয়া থানার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইপিআর এর লরিতে তিনি উঠে যান। সৈয়দ আলি গাহী আরো বলেন, ইপিআর এর সাইদুর রহমান নামের এক নায়েব সুবেদার তাঁর পূর্ব পরিচিত ছিলো। তিনিই তাঁকে সাথে করে নিয়ে যান। যাবার আগে তাকে বিদায় দেন যুদ্ধকালীন কমান্ডার মোসলেম উদ্দিন, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বিএম নজরুল ইসলাম, শেখ আমানুল্লাহ সহ আরো অনেকেই। সৈয়দ আলি ইপিআরদের সাথে রওয়ানা হন সম্পূর্ণ খালি হাতে। তাকে পৌঁছে দেওয়া হয় যশোরের ঝিকরগাছায়। সেখানে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা শত শত মুক্তিকামী জনতা ও যোদ্ধা সমবেত হন। একজন মেজরের নেতৃত্বে সৈয়দ আলিসহ এক প্লাটুন যোদ্ধাকে পাঠানো হয় যশোর সেনানিবাস আক্রমণের জন্য। কিন্তু নানা প্রতিকূলতায় সেই অপারেশন করা যায়নি বলে সৈয়দ আলি গাজী জানান। এরপর যশোর থেকে পিছু হটে তারা আসেন যশোরের মালঞ্চির মোড় এলাকায়। কিন্তু সেখানে আকস্মিক পাক বাহিনী হামলা চালিয়ে ৭০/৭৫ জন নিরস্ত্র মানুষকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। সেই সাথে চালায় পাশবিক নির্যাতন ও গণ ধর্ষণ। তাঁর সাথে থাকা অনেক সতীর্থ শহীদ হলেও তিনি ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান। তারপর সেখান থেকে তাঁরা ঘাঁটি গড়েন বেনাপোল এলাকায়। এরপর সৈয়দ আলি ভারতে যান। কিন্তু সেখানে তাঁর ট্রেনিং নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। কারণ ফায়ারিংএ তাঁর ছিলো দুর্দান্ত দক্ষতা। এরপর চলে আসেন কলারোয়া উপজেলার কাঁকডাঙ্গা এলাকায়। সেখানে বাঙ্কার নির্মাণ করে পরিচালনা করতে থাকেন যুদ্ধ। যুদ্ধকালীন সবচেয়ে বড় সম্মুখ যুদ্ধ হয় কলারোয়ার বালিয়াডাঙ্গায়। পাক বাহিনীর সাথে একাত্তরের ১৮ সেপ্টেম্বর হওয়া এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। সৈয়দ আলি এই যুদ্ধে সবচেয়ে ভারী অস্ত্র মর্টার গান পরিচালনা করেন। অন্যরা হালকা অস্ত্র ব্যবহার করতেন। বালিডাঙ্গার এই যুদ্ধ যখন পুরোপুরি শুরু হয় তখন বেলা ১১টার বেজে ছিলো। আরো জানান, এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা একচেটিয়া দাপট দেখিয়ে ২৯ জন পাক সেনাকে হত্যা করে। কিন্তু একই সময়ে প্রতিপক্ষের গুলিতে জাকারিয়াসহ শহীদ হন ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা। এরপর গোটা কাঁকডাঙ্গা এলাকা পাক হানাদান বাহিনী মুক্ত হয়। নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। সফল এই সম্মুখ যুদ্ধ ও সাময়িক বিজয় শেষে সৈয়দ আলি ও সতীর্থরা চলে আসেন উপজেলার কেঁড়াগাছি ইউনিয়নের বোয়ালিয়া এলাকায়। সৈয়দ আলি আরো বলেন, তিনি কমান্ডো যোদ্ধা হওয়ায় কমান্ডার আব্দুল গফ্ফারের নির্দেশে অন্যান্য কয়েকটি স্থানে অপারেশনে যান। তিনি ও সতীর্থরা কলারোয়ার ব্রজবাকসা ব্রীজ উড়িয়ে দিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিলো, পাক সেনাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। এছাড়া তারা টেলিফোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য হঠাৎগঞ্জ এলাকায় তার কেটে দিয়েছিলেন। কমান্ডার আব্দুল গফ্ফার ও তাঁর নেতৃত্বে ইলিশপুর এলাকা থেকে ৯ রাজাকারকে আটক করা হয়েছিলো বলে তিনি জানান। তিনি বোয়ালিয়ায় অবস্থানকালীন টার্গেট করেছিলেন দমদম পাক বাহিনী ক্যাম্পে হানা দেওয়ার। কিন্তু সেটি বাস্তবে রূপ নিতে পারেনি। যাহোক, বোয়ালিয়া এলাকায় থেকে তাঁরা একে একে খবর পাচ্ছিলেন চন্দনপুর, খোরদোসহ বিভিন্ন এলাকা পাক বাহিনী মুক্ত হওয়ার। অবশেষে ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ ৬ ডিসেম্বর। যেদিন কলারোয়া পাক হানাদার বাহিনী মুক্ত হয়। স্বাধীন দেশের মাটিতে উড়ানো হয় সবুজের বুকে রক্ত খচিত জাতীয় পতাকা। এই খবর পেয়ে সৈয়দ আলিসহ সতীর্থ মুক্তিযোদ্ধারা পায়ে হেঁটে বোয়ালিয়া থেকে ঝাউডাঙ্গা হয়ে কলারোয়ায় চলে আসেন। শরিক হন মুক্তিযোদ্ধা-জনতার বিজয় উল্লাসে। সৈয়দ আলিরা কলারোয়ার মাটিতে জাতীয় পতাকা উড়িয়েছিলেন যৌবনের সোনাঝরা দিনে। আর স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও জীবনের পড়ন্ত বেলায় জাতীয় পতাকা উড়িয়ে চলেছেন সৈয়দ আলিরা। তাঁদের আত্মত্যাগ ও অবদান মুক্তিকামী মানুষ কখনো ভুলবেন না, ভুলতে পারেন না। মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আলি গাজীর মতো সকল মুক্তিযোদ্ধাই দেশ ও জাতির গর্ব, অহংকার ও নিরন্তর শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে চিরদিন আমাদের মাঝে বেচে থাকবেন।
Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)