এবার মাঠে নামছেন সম্পাদকরা

নানা দাবিদাওয়া নিয়ে সাংবাদিকরা প্রায়ই রাজপথে নামলেও সম্পাদকদের মাঠে নামার তেমন নজির নেই৷ তবে এবার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছেন তাঁরা৷

২৯ সেপ্টেম্বর দেয়া হয়েছে মানববন্ধনের কর্মসূচি, পরবর্তীতে আসতে পারে আরো বড় ধরনের আন্দোলনের ডাক৷ এনিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে সাংবাদিকদের মধ্যেও৷

শনিবার সম্পাদক পরিষদের কর্মসূচি ঘোষণার পাশাপাশি সম্পাদক পরিষদের মহাসচিব মাহফুজ আনাম, টেলিভিশন চ্যানেল মালিকদের সংগঠন অ্যাটকোর সহ-সভাপতি মোজাম্মেল হক বাবু এবং বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন৷

তাঁরা বিবৃতিতে বলেন, ‘‘জাতীয় সংসদে বহুল বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা বিলটি ১৭ সেপ্টেম্বর একতরফাভাবে উত্থাপন করেছে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও আইসিটিবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি৷ এতে যথাযথভাবে সাংবাদিক সম্প্রদায়ের সুপারিশ প্রতিফলিত হয়নি৷ জাতীয় সংসদের স্থায়ী কমিটি সংসদে বিলটি উত্থাপনের আগে স্বার্থ-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনার প্রতিশ্রতি দিলেও তা রক্ষা করা হয়নি৷ সরকার বিতর্কিত এই বিলটি একতরফাভাবে গ্রহণ করায় আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন৷”

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘কিছু পরামর্শ গ্রহণ করা হলেও আইনের কয়েকটি ধারা সংবাদপত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিপক্ষে গেছে৷ সংবাদমাধ্যমে কর্মরত ব্যক্তিদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়নি আইনে৷ বরং ‘তথ্য অধিকার আইন’ ও ‘অফিসিয়াল সিক্রেসি আইনের’ অস্তিত্বেপ কারণে একটি পরস্পরবিরোধী অবস্থান তৈরি করা হয়েছে৷ পুলিশকে বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি চালানো ও গ্রেফতার করার ক্ষমতা দেয়ার মাধ্যমে স্বাধীন সাংবাদিকতার বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে৷”

অতীতে এমন আইনের অপপ্রয়োগ হয়েছে উল্লেখ করে সরকারকে আইন সংশোধনে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে বিবৃতিতে৷ বলা হয়েছে, ‘‘আমরা মনে করি আইনটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে সামঞ্জস্য বিধানের সুযোগ এখনো আছে৷”

এদিকে, শনিবারই সম্পাদক পরিষদ বৈঠক করে এই আইনের প্রতিবাদে মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করে৷ ২৯ সেপ্টেম্বর সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এই কর্মসূচি পালন করা হবে৷ সম্পাদকরা সব সাংবাদিকদের এই কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছ

‘সৎ, বস্তুনিষ্ঠ, ভয়ের কোনো কারণ নেই, এগুলো আপেক্ষিক কথা’

যুগান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সংবাদপত্র বলতে আমরা বুঝি মুক্ত গণমাধ্যম৷ সেখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকবে, সাংবিধানিক স্বাধীনতা থাকবে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, বহু মতের প্রকাশ থাকবে৷ ৫৭ ধারার আমরা অবলোপ চেয়েছি৷ এরপর যখন ডিজিটাল আইন সামনে এলো তখনই আমরা সাংবাদিকরা বেশ কয়েকটি ধারা উল্লেখ করে এর প্রতিবাদ জানিয়েছি৷ সাংবাদিক সমাজ, সাংবাদিক ইউনিয়ন নেতা এবং সম্পাদকরা একাধিকবার বিবৃতি দিয়েছেন, এবং কোথায় কোথায় স্বাধীন সংবাদপত্রের ব্যত্যয় ঘটবে কিংবা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করা যাবে না সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে৷”

তিনি বলেন, ‘‘তারই ধারাবাহিকতায় আইনমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী, সংসদীয় কমিটিসহ সরকারের অন্য আরো অনেক পর্যায়ে বসেছেন সম্পাদক -সাংবাদিক নেতারা, মত বিনিময় করেছেন৷ তারা নিজেরাও উপলব্ধি করেছেন, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২- এই ধারাগুলো স্বাধীন সংবাদপত্রের জন্য অনুকুল নয়৷ সাংবাদিকতার ওপর একটি নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দেয়ার যথেষ্ঠ সুযোগ এই ধারাগুলোতে রয়েছে৷ আমরা এই ধারাগুলোর প্রতিবাদ করেছি৷ আমাদের বলা হয়েছে বিবেচনা করা হবে৷ যখন আইনের পর্যায়ে আসবে তখন এগুলো থাকবেনা৷ কিন্তু আমরা দু:খজনকভাবে দেখলাম, যখন আইনটি সংসদে পাশ হলো. এর অনেকগুলো ধারাই রয়ে গেছে৷ এর মধ্যে অনেকগুলো ধারা অজামিনযোগ্য৷ কিছু ধারায় শাস্তি কমানো হয়েছে৷ কিন্তু তল্লাশির নামে পুলিশের যে বিশেষ ক্ষমতা সেটি আবার প্রদান করা হয়েছে৷”

তিনি বলেন, ‘‘এরকম একটি পরিস্থিতিতে আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি হিসেবে মানববন্ধন ছাড়া আর কোনো কর্মসূচির কথা ভাবতে পারিনি৷”

তিরি আরো বলেন, ‘‘সরকার বলছে, যারা সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করবে তাদের এই আইন নিয়ে ভয়ের কোনো কারণ নেই৷ কিন্তু সৎ, বস্তুনিষ্ঠ, ভয়ের কোনো কারণ নেই, এগুলো আপেক্ষিক কথা৷ এগুলো কখন কিভাবে কার ওপর প্রয়োগ হবে তা বলা কঠিন৷”

যুগান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আরো বলেন, ‘‘আমরা জানি বিশেষ ক্ষমতা আইন আওয়ামী লীগের আমালে করা হয়েছিল৷ কিন্তু আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল না তখন তাঁদের ওপর তা বিশেষভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে৷ যাঁরা আইনটি করেছেন তাঁরা যখন ক্ষমতার বাইরে গেছেন তখন তাঁদের ওপরই এ আইন বেশি মাত্রায় প্রয়োগ হয়েছে৷ কাজেই আইনটি কিভাবে প্রয়োগ হবে, কতটা অপপ্রয়োগ হবে এটাতো আর কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেনা৷ কেউ তো গ্যারান্টি দিতে পারেনা৷ এমন কোনো গ্যারান্টি ক্লজ যদি থাকতো যে এই আইনটি অপব্যহার হবেনা, সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ হবেনা, এভাবেতো আইন করা যায়না৷ তাই আমি মনে করি এই আইনটি স্বাধীন সাংবাদিকতার অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে৷”

সম্পাদকদের এই কর্মসূচিতে মাঠের সাংবাদিকরা উৎসাহ দেখাচ্ছেন৷ তাঁরা মনে করেন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য সম্পাদকদের মাঠে নামার এই কর্মসূচি ভালো ফল বয়ে আনবে৷

ইত্তেফাকের সিনিয়র রিপোর্টার জামিউল আহসান সিপু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এর আগে সাংবাদিকদের আন্দোলন-সংগ্রামে সম্পাদকরা মাঠে থাকতেন না৷ আমরা মাঠের সাংবাদিকরাই থাকতাম৷ এবার সম্পাদকরাই মাঠে নামছেন, মানববন্ধন কর্মসূচি দিয়েছেন৷ এটা ভালো  একটা দিক৷ আন্দোলন কর্মসূচিতে সম্পাদকরা যেহেতু একতাবদ্ধ হয়েছেন, এটা অবশ্যই নতুন একটি ডায়মেনশন সৃষ্টি করবে৷ সংসদে পাশ হওয়া ডিজিটাল আইনের প্রতিবাদে সম্পাদকরা যে কর্মসূচি দিয়েছেন, আমি মনে করি এটা সফল হবে এবং ফল বয়ে আনবে৷”

তিনি বলেন, ‘‘সকল সাংবাদিকের উচিত হবে এই কর্মসূচিতে যোগ দেয়া৷ আমি নিজেও যোগ দেব৷”

তবে একাত্তর টেলিভিশনের সাংবাদিক নাদিয়া শারমিন মনে করেন, সম্পাদকদের আরো কঠোর কর্মসূচি দেয়া উচিত ছিল৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সম্পাদকরা ক্ষমতাবান এবং শক্তিশালী৷ বাংলাদেশে এখন যারা দুর্বল বা শক্তিহীন তারাই মানববন্ধনের মত কর্মসূচি দেন৷ সম্পাদকদের ক্ষমতার যে পরিধি তার সঙ্গে এই মানববন্ধন কর্মসূচি কতটা শক্তিশালী কর্মসূচি তা নিয়ে আমি সন্দিহান৷ তবে তাঁরা প্রথমবারের মত মাঠের কর্মসূচি দিয়েছেন সেটা অবশ্যই আশার কথা৷”

‘আমরা দেখতে যাব তাঁরা আরো কোনো কঠোর কর্মসূচি দেন কিনা’

তিনি বলেন, ‘‘আমরা যারা মাঠের সাংবাদিক তারাই প্রথম কোনো আইন বা ঘটনার শিকার হই৷ সেই প্রেক্ষাপট থেকে একজন মাঠের সাংবাদিক হিসেবে সম্পাদকদের এই কর্মসূচিতে অবশ্যই যোগ দেব৷ আমরা দেখতে যাব তাঁরা আরো কোনো কঠোর কর্মসূচি দেন কিনা৷  তারা আসলেই শক্তিশালী কোনো প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কাজ করেন কিনা৷ যে প্রেসার গ্রুপ হিসেবে আসলে তাঁদের কাজ করারই কথা৷”

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মোল্লা জালাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সম্পাদক মালিকরা মনে করেছেন তাঁরা এই আইনে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন৷ তাই তাঁরা মানববন্ধনের কর্মসূচি দিয়েছেন৷ আমাদের ইউনিয়নকে তাঁরা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার আহ্বান জানাননি৷ আহ্বান জানালে আমরা ইউনিয়নে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব৷”

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘সম্পাদকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন মনে করেন বলেই কর্মসূচি দিয়েছেন৷ আমরাও দেখছি৷ আমাদের সাংবাদিকরা যদি এই আইনের শিকার হন, সেই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাহলে আমরা মাঠে নামবো৷ রুখে দাঁড়াবো৷”

সম্পাদকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন মনে করেন বলেই কর্মসূচি দিয়েছেন’

পাকিস্তান আমলে সম্পাদকদের এরকম ঐক্যবন্ধ কর্মসূচি দেখা গেছে৷ বাংলাদেশে এরশাদ সরকারের পতনের আগে সম্পাদকরা সম্মিলিতভাবে পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ করে দিয়েছিলেন৷ এর বাইরে সম্পাদকদের কোনো কর্মসূচিতে মাঠে নামতে দেখা যায়নি বলে সাংবাদিকরা জানান৷ তরুণ সাংবাদিকদের অনেকেই এই প্রথম সম্পাদকদের মাঠের কর্মসূচি দিতে দেখলেন৷

তবে সাইফুল আলম বলেন, ‘‘এই প্রথম না, আমরা পকিস্তান আমলেও লক্ষ্য করেছি এরকম একটি পরিস্থিতিতে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় সম্পাদকরা অবস্থান নিয়েছেন৷ তখন সম্পাদকরা সম্মিলিতভাবে ‘পূর্ববাংলা রুখিয়া দাড়াও’ এই শিরোনামে সম্পাদকীয় লিখেছেন৷ স্বাধীন বাংলাদেশেও সম্পাদকরা দু-একবার রাজপথে নেমেছেন এবং প্রতিবাদ করেছেন৷ সম্পাদকদের জাতীয় প্রেসক্লাবে সেই প্রতিবাদ অনুষ্ঠানে আমিও ছিলাম৷ যদিও তখন আমি সম্পাদক ছিলাম না৷ যখনই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রশ্ন এসেছে, মুক্ত গণমাধ্যমের প্রশ্ন এসেছে, তখনই কিন্তু সাংবাদিকরা, সম্পাদকরা স্বাধীন সংবাদপত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন৷”

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)