এই মন ভালো, এই খারাপ কোন রোগ?

আমাদের মন মেজাজ কখন কেমন থাকে- তার কোনো নিয়ন্ত্রণ আমাদের মধ্যে থাকে না। সকালে ভালো তো বিকেল না হতেই বিষণ্ণতা। কিছুক্ষণ খুব রাগ হচ্ছে, সময় যেতেই আবার সেই রাগ চলেও যাচ্ছে। এই যে মানসিকতার এমন অস্বাভাবিক প্রকাশ হতে পারে কোনো রোগের লক্ষণ। এই অবস্থা নিয়ন্ত্রণ না করলে ঘটতে পারে বিপদও।

এই ধরুন কেউ ভীষণ একগুঁয়ে হতে পারে, কারও যেকোনো কথাতেই রাগ উঠে যেতে পারে। সবার উপরে হুকুম করা, নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলে। অনেক সময়ে ভাঙচুরও চলতে পারে। অথচ এই ব্যক্তিটি একদিন হয়তো একদিন ঠাণ্ডা মেজাজেরই ছিল। হঠাৎই এই পরিবর্তন সবাইকে অবাক করে দিতে পারে।

এই পরিবর্তনগুলো আপনার আশেপাশের মানুষগুলোর মধ্যে খেয়াল করবেন। ধরুন অফিসের কলিগ, যার সঙ্গে আপনার শপিং, ঘুরতে যাওয়া, আড্ডা, অফিশিয়াল থেকে ব্যক্তিগত সমস্যা সবকিছুই শেয়ার করা হতো। কিন্তু হঠাৎ সে কিছুটা বদলে গেলো। তার খরচের হাত খুব বেড়ে গেলো, নিজেকে বেশিকিছু ভাবতে পারে, উদাসীন ভাব চলে আসে। আপনি অবাক হলেন। ভাবলেন হঠাৎ কি হলো?

অনেক দম্পত্তির মধ্যেও এই নেতিবাচকভাবে বদলে যাওয়ার মতো সমস্যাগুলো ঘটে থাকে। শান্ত স্বভাবের কেউ অশান্ত বা অবাধ্য হয়ে গেলে অবাক না হয়ে বুঝে নিন এটা একটা অসুখ। যাকে বাইপোলার ডিসঅর্ডার বলা হয়। শুধু ‘মেজাজ’ দিয়ে বাইপোলারের অনেকটা পরিচয় পাওয়া যায়।

কী হয় এই অসুখে?

বাইপোলারের অর্থ দুটি পোল বা দুটি মেরু। মন ও মেজাজের দুটি দিক হলো বাইপোলার। যার এক মেরুতে থাকে উচ্ছ্বাস, আনন্দ, সঙ্গে বেপরোয়া মন। একে বলে ম্যানিক ফেজ বা এই অবস্থার নাম ম্যানিয়া। আর অন্য মেরুতে থাকবে গভীর শূন্যতা, বিষণ্ণতা। অর্থাৎ ডিপ্রেশন ফেজ। মনের এই দুই মেরু নিয়ে যারা বাস করে তারাই বাইপোলার। কখনো অবসাদগ্রস্ত, কখনো চরম মেজাজ।

ম্যানিক ফেজ

ম্যানিক ফেজের কাউকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এদের মধ্যে ব্যবহারের হঠাৎ পরিবর্তন হয়। হঠাৎ কাজে এনার্জি বেড়ে যায়। এরা নিজেকে বিরাট কিছু মনে করে। খরচের হাত লম্বা হয়ে যেতে পারে। কথা বলার পরিমাণ বেড়ে যাবে। ঘুম কম হবে, খুব রেগে যাওয়া, রেগে ভাঙচুর করা, অন্যকে আঘাত করা শুরু হবে। কেউ যদি রাগে বাধা দেয়, তার সহিংস হয়ে উঠতে পারে। আশেপাশের কাউকে এমন দেখলে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কারণ এদের মধ্যে সবসময়েই কেমন একটা অতিরিক্ত বহিপ্রকাশের মনোভাব চলে আসে।

ডিপ্রেশন ফেজ

এই অবস্থা হলে কোনোকিছুই ভালো লাগে না, শূন্যতা বোধ হয়। ভালো কোনো ঘটনাতেও আনন্দবোধ হয় না। যখন তখন খুব কান্না পায়। বেঁচে থাকার ইচ্ছা কমে যায়, অপরাধবোধ কাজ করে মনের ভেতরে। বেশি সমস্যা হয় আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হয় মনের মধ্যে। আগে যাদের সঙ্গে মিশতে ভালো লাগতো তাদেরকে আর ভালো লাগে না।

আবার যে বিষয়গুলো পছন্দের ছিল, তাতে আর আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায় না। সমাজ, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। চোখে ঘুম থাকলেও ঘুমাতে ইচ্ছে করবে না। আর ঘুমালেও ক্লান্তি ভাব কখনো কাটতে চাইবে না।

খেয়াল রাখবেন, ২ সপ্তাহ ধরে এই সমস্যা থাকলে অবশ্যই তা বাইপোলার ডিপ্রেশন বা মেজর ডিপ্রেশনের লক্ষণ হবে।

কোনো অবহেলা নয়

এই সমস্যা প্রকট হলে জীবনে অনেক দুর্ঘটনাই ঘটে। এই যেমন হঠাৎ করে চাকরি চলে যাওয়া, প্রিয়জনের সঙ্গে বিবাদ-বিচ্ছেদ, প্রিয়জনের মৃত্যু, মারাত্মক স্ট্রেস, হঠাৎ করে অর্থনৈতিক বিপর্যয়, তবে সে সাইক্লোথেমিয়া থেকে হঠাৎ ম্যানিক ফেজে চলে যেতে পারে। এই অবস্থায় মনোবিদের পরামর্শ নিতে হবে।

বাইপোলার ডিসঅর্ডারের কেন হয়

মস্তিস্কের কোনো কারণে এই ডিসঅর্ডার হয় কিনা, তা নিশ্চিত নয়। জিন গঠিত কারণে এটা হতে পারে। পরিবারে কারও অবসাদ, খুব রাগ জাতীয় সমস্যা থাকলে সরাসরিভাবে অন্য সদস্যদেরও এই ডিসঅর্ডারের আশঙ্কা ৪০-৬০ শতাংশ বেশি থাকে। বাবা-মায়ের বাইপোলার ডিসঅর্ডার থাকলে সন্তানেরও ঝুঁকি থাকে। ১৫-৫০ বছর বয়সের মধ্যে যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে এই রোগে।

প্রতিকার কী

ওষুধের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর লাইফস্টাইল মেনে চলুন। পুষ্টিকর খাবার খান পর্যাপ্ত পরিমাণে। মস্তিস্কের কাজ ঠিক রাখতে খুব মিষ্টি খাবার না খাওয়াই ভালো। ভিটামিন, মিনারেল বেশি করে খেতে হবে। প্রচুর শাক সবজি, ফলসহ অ্যান্টি অক্সিডেন্ট জাতীয় খাবার খেতে হবে। স্যাচুরেটেড ফ্যাট জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। নিউরো কেমিক্যালের মাত্রা ঠিক রাখতে প্রোটিন জাতীয় খাবার খেতে হবে। অ্যালকোহল খাবেন না, নিয়মিত শরীরচর্চা করুন, মেডিটেশন করুন। এগুলো মেজাজ আর মানসিকতা ভালো থাকে।

চিকিৎসা

খুব খারাপ অবস্থা হলে রোগীকে ওষুধ দেওয়ার প্রয়োজন হয়। চিকিৎসকের পরামর্শমতো স্টেবিলাইজার জাতীয় ওষুধ খেতে হয়। রোগের লক্ষণ দেখে ঠিক মতো তা নির্ণয় করা জরুরি। রোগীকে শান্ত পরিবেশে রাখতে হবে, উজ্জ্বল আলো এড়িয়ে চলতে হবে। প্রয়োজন রোগীর কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি। পরিবারে বাইপোলারিটি থাকলে আগে থেকে সতর্ক হোন, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করুন।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)