ইটের ভাঁটার শিশু শ্রম থেকে লেখাপড়ায় ফিরে আসা আসমার কথা

জি.এম আবুল হোসাইন :

মেয়েটির নাম আসমা খাতুন। বয়স ১৩ বছর, ২নং কুশখালী ইউনিয়ন পরিষদের ভাদড়ায় নানার বাড়িতে থাকে। আসমাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৪ জন। তাদের ছোট একটা ঘর আছে, ঘরটি মাটির বেড়া দিয়ে ঘেরা। আসমার মা বাবার ছাড়াছাড়ি হওয়ার কারণে সে মা ও নানীর সাথে থাকে। তার মা প্রতি বছর ঢাকার বিভিন্ন ইটের ভাঁটায় রান্নার কাজ করে। যে সামান্য টাকা তাদের উপার্জন হয় সেটা দিয়ে সংসার চালানো খুবই কষ্টকর। তার ছোট একটি ভাই আছে। সে ৩য় শ্রেণির ছাত্র। তাদের স্বল্প আয়ে নিজেদের সংসার চালাতে অসুবিধা হয়। যার কারণে সে তার মায়ের সাথে ইটের ভাঁটায় কাজে যায়। আসমা ২০১৫ সালে ভাদড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণিতে ভর্তির কিছুদিন পরে তার পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়। আসমা পড়ালেখায় ভালো ছাত্রী হলেও তার মা তাকে আর পড়াতে চায় না, কাজে নিতে চায়। এক পর্যায়ে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মায়ের সাথে ইটের ভাঁটায় কাজ ঠিক করে। তার পড়ালেখা করার আশার প্রদীপ প্রায় নিভে যায়। এক সময় লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। সে ইটের ভাঁটায় তার চাচার সাথে ভ্যান ঠেলার কাজ করত। ছোট মেয়ে হওয়ায় তাকে কাজের বিনিময়ে কোন টাকা দিত না। শুধুমাত্র ৩বেলা খেতে দিত। এভাবেই তার জীবন থেকে একটি বছর কেটে যায়। সে খেলাধুলা ও লেখাপড়া করতে পারে না। যা তার জন্য খুবই কষ্টের।

পলাশ শিশু কেন্দ্রের কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা কমিটি (সিএমসি) সদস্য মোছাঃ হেনা খাতুন জানান, প্রথমে বিষয়টি জানতে পারি। গতবার আসমা তার মায়ের সাথে ঢাকার একটি ইটের ভাঁটায় কাজে গিয়েছিল। এবারো তার মায়ের সাথে যাওয়ার জন্য কথাবার্তা হচ্ছিল। এবিষয়ে তিনি আসমার মা ও নানীর সাথে কথা বলেন। পরবর্তিতে কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা কমিটি (সিএমসি) এর মাসিক সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়। কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও সমাজ ভিত্তিক শিশু সুরক্ষা কমিটির সভাপতি মোছাঃ মনজুরা খানম (ইতি) এবং অন্যান্য সদস্যের সহযোগিতায় তাকে আবারো স্কুলে ভর্তি করা হয়।
এর প্রেক্ষিতে মহিলা মেম্বর ও সমাজ ভিত্তিক শিশু সুরক্ষা কমিটির সভাপতি মোছাঃ মনজুরা খানম (ইতি) ও হেনা খাতুন আসমার নানীর সাথে কথা বলেন। তিনি সহ সকল সদস্যদের সাথে নিয়ে আসমাদের বাড়িতে যান। তার মাকে ও নানীকে বুঝিয়ে ইটের ভাঁটায় কাজে যাওয়া বন্ধ করেন। তাদের সকল কথা শুনে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তাদের জন্য আগামীতে ভিজিএফ ও ভিজিডি কার্ডের ব্যবস্থা করবেন বলে আশ্বস্ত করেন। চেয়ারম্যান সাহেব তার পড়াশুনার বিষয়ে পরবর্তিতে কিছু করা যায় কি না দেখবেন বলে জানান। বর্তমানে সে ও তার ভাই নানীর কাছে থাকে।

আসমা এখন ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’র পলাশ শিশু ক্লাবের নিয়মিত সদস্য। সে সব মিটিং এ অংশগ্রহণ করে। সে শিশু ক্লাবের সভায় তার নিজের বিষয়টি সকলকে জানায়। সে আরো জানায়, এখন আর সে ইটের ভাটায় কাজ করতে যেতে চায় না, পড়াশুনা করবে। সে এবং শিশু ক্লাবের সদস্যরা মিলে পলাশ সোস্যালাইজেশন সেন্টারে নিয়মিত খেলাধুলা করে। টিউশন সাপোর্ট নেয়।

এর ফলে সে আবার পড়ালেখা শুরু করতে পেরে খুবই আনন্দিত। সে লেখাপড়া নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করছে না। এখন সে নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছে এবং মনোযোগ সহকারে লেখাপড়া করছে। সে বর্তমানে খুবই আনন্দিত।এ প্রসঙ্গে আসমা খাতুন বলেন, ‘আমি ঢাকার বাহিরে ইটের ভাঁটা থেকে ফিরে এসে আবারো পড়াশুনা করতে পারছি এজন্য খুবই আনন্দিত। আমি চাই আমার মত কোন শিশু যেন তার মা বাবার সাথে কাজে গিয়ে লেখাপড়া থেকে ঝরে না পড়ে।’

পলাশ শিশু ক্লাবের সভাপতি মোছাঃ তন্নি খাতুন (১৩) বলেন, “আমরা ইতিপূর্বে জানতাম না যে ইউনিয়ন পরিষদ শিশুদের জন্য এত বেশি আন্তরিক। যে কোন সমস্যার কথা জানালে এত দ্রুত সমাধান হয়। এছাড়া ঝরে পড়া শিশুদের ও স্থানান্তরিত হওয়া শিশুদের লেখাপড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।”

আসমার নানী হাসিনা বেগম বলেন, আমাদের এলাকার ছেলে মেয়েরা আগে ইউনিয়ন পরিষদে এসে সরাসরি কথা বলতে পারত না। ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’র শিশু ফোরামে সদস্য হওয়ার পর থেকে তারা তাদের ইচ্ছা ও অধিকারের কথা বলতে পারছে।
পলাশ অভিভাবক দলের সভাপতি ক্বারী মিজানুর রহমান বলেন, “ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স এর শিশু ক্লাবের মিটিং এ গিয়ে আমাদের সন্তানরা তাদের অধিকার গুলো সম্পর্কে অনেক সচেতন হয়েছে। তারা তাদের যে কোন সমস্যা সমাধানের জন্য জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলছে। তাদের মাধ্যমে আমরাও অনেক কিছু জানতে পেরেছি। আমরা চাই আমাদের সন্তানরা দেশের মুখ উজ্জল করুক।”

২নং কুশখালী ইউনিয়ন পরিষদের ৭,৮,৯নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্যা ও সমাজ ভিত্তিক শিশু সুরক্ষা কমিটির সভাপতি মোছাঃ মনজুরা খানম (ইতি) বলেন, আমরা সব সময় সকল শিশুদের নিজের সন্তানের মত ভালবাসি। কিছু কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের সকল চাওয়া সব সময় পূরণ করা সম্ভব হয়না। তারপরেও যথা সাধ্য শিশু সংশ্লিষ্ট বিষয় গুলি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করি।

কুশখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ শফিকুল ইসলাম (শ্যামল) বলেন, আমি ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স এর অনুপ্রেরণায় শিশুদের স্বপ্ন পূরণে তাদের পাশে দাঁড়াতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করছি। শিশুদের লেখাপড়া, খেলাধুলা ও সুরক্ষার বিষয়ে আমরা আন্তরিকতার সাথে কাজ করছি। শিশুদের কল্যাণে আলাদা বাজেট বরাদ্দ রাখছি।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)